শুরুতেই খোলাসা করে নিই জেন্ডার বাজেট বলতে আসলে আমরা কি বুঝি। জেন্ডার বাজেট মানে নারীর জন্য আলাদা কোনো বাজেট নয়, বরং এটি একটি বিশেষ পদ্ধতি যার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় হিসাব–নিকাশের সাহায্যে জাতীয় বাজেটের জেন্ডার–সংবেদনশীলতা বিশ্লেষণ করা যায়। জেন্ডার বাজেটের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের জেন্ডার–সংবেদনশীলতা চিহ্নিত করা যাতে বাজেটে সম্পদের বণ্টনের মাধ্যমে নারী–পুরুষের সমতা বৃদ্ধি বা অসমতা হ্রাস করা যায়।
এবারের ২০২৩–২৪ অর্থবছরে মোট বাজেটের ৩৪.৩৭ শতাংশ নারী উন্নয়নে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। মাননীয় অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ২০২৩–২৪ অর্থবছরে নারী উন্নয়নে দুই লাখ একষট্টি হাজার সাতশ সাতাশি কোটি টাকার জেন্ডার বাজেট উপস্থাপন করেছেন। এ–অর্থবছরে নারী উন্নয়নে বরাদ্দ বেড়েছে বত্রিশ হাজার একশ দশ কোটি টাকা। ২০২৩–২৪ অর্থবছরের বাজেট অধিবেশনে সাতশটি মন্ত্রণালয় ও সতেরটি বিভাগের জন্য এই জেন্ডার বাজেট উপস্থাপিত হয়। জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদনে নারী স্বার্থকে সামনে রেখে বাজেট প্রক্রিয়ার সর্বস্তরে জেন্ডার সমতার বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে নারী উন্নয়নে বরাদ্দকৃত অর্থের সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং সরকারি উদ্যোগের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে। নারী উন্নয়নে বাজেট বরাদ্দের পাশাপাশি বরাদ্দকৃত অর্থের যথাযথ ব্যবহার এবং জেন্ডার বৈষম্য হ্রাসের হার পর্যালোচনার ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
উক্ত জেন্ডার বাজেটকে তিনটি থিমেটিক বা বিষয়ভিত্তিক বিভাগে ভাগ করে বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এবছরের জেন্ডার বাজেটে ‘নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি’ খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এ–খাতে জেন্ডার সম্পৃক্ত মোট বাজেটের ৫৮.৪ শতাংশ, ‘উৎপাদন, শ্রমবাজার ও আয়বর্ধক কাজে নারীর অধিকতর অংশগ্রহণ’ খাতে ৮.১ শতাংশ এবং ‘সরকারি সেবা প্রাপ্তিতে নারীর সুযোগ বৃদ্ধি’ খাতে ৩৩.৫ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ছয়টি মন্ত্রণালয় ও ছয়টি বিভাগের জন্য বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে। এগুলো হলো; প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, খাদ্য মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ ও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ।
দ্বিতীয় অংশে উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং শ্রমবাজার ও আয়বর্ধক কাজে নারীর অধিকতর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নয়টি মন্ত্রণালয় ও দুইটি বিভাগের জন্য বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
জেণ্ডার বাজেটের তৃতীয় অংশে সরকারি সেবা প্রাপ্তিতে নারীর সুযোগ বৃদ্ধির ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এতে বারটি মন্ত্রণালয় ও নয়টি বিভাগের জন্য জেণ্ডার বাজেটের প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে নির্বাচন কমিশন, আইন ও বিচার বিভাগ, জননিরাপত্তা বিভাগ, সুরক্ষা সেবা বিভাগ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, তথ্য ও সমপ্রচার মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয়, নৌ–পরিবহন মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, বিদ্যুৎ বিভাগ এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।
সবই ঠিক আছে। নারী উন্নয়ন বিষয়ে সরকারের সদিচ্ছা কোনো কমতি পরিলক্ষিত হয় না। তবে বাজেটে বরাদ্দ বাড়লেও যে প্রক্রিয়ায় জেন্ডার বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন হচ্ছে, তা নারী–পুরুষ সমতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সহায়ক হচ্ছে কি? পিছিয়ে পড়া নারীদের উন্নয়নে গত কয়েক অর্থবছর থেকে জাতীয় বাজেটের সঙ্গে আলাদা করে জেন্ডার বাজেট ঘোষণা করা হলেও এর ফলাফল জানা যাচ্ছে না। নারীর প্রতি সহিংসতা–নির্যাতন ও বৈষম্য কি কমছে? সরকারের বিভিন্ন স্তরে যারা কাজ করছেন, তারা কি যথেষ্ট জেন্ডার সংবেদনশীল? সবচেয়ে বড় ব্যাপারে হলো, সরকার জেন্ডারবান্ধব বাজেট করলেও এর বাস্তব অগ্রগতি নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনও পর্যালোচনা বা সমীক্ষা পাওয়া যায় না। পর্যবেক্ষণের অভাবে বাজেট বরাদ্দের কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে, নারীর জীবনের কোন কোন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলো, সে বিষয়েও কোনও তথ্য–উপাত্ত নেই। জেন্ডার বাজেট নিয়ে ধারণাগত অস্পষ্টতাও রয়েছে। এমতাবস্থায় জেন্ডার বাজেটের ফলাফল ও কার্যকারিতা মূল্যায়ন করে দেখা দরকার। দরকার আগামী অর্থ বছর আসার আগেই চলতি অর্থ বছরের জেণ্ডার বাজেটের মোট বরাদ্দের কতটুকু পরিকল্পনা মোতাবেক খরচ করা গেলো এবং এসময় কি কি প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে সেগুলো খতিয়ে দেখা। সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের পাশাপাশি গুণগত বিশ্লেষণ করার জন্য পরিমাপক নির্ধারণ করতে হবে। বিশেষত জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদনে, সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে বরাদ্দ দেখানোর পাশাপাশি সেই বরাদ্দকৃত বাজেট আসলে নারীর কোন কৌশলগত জেন্ডার চাহিদা পূরণ করছে এবং তার অগ্রগতি কতটুকু হয়েছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ থাকতে হবে। তবেই আসবে জেণ্ডার বাজেটের কাঙ্ক্ষিত সাফল্য।