জুম্‌’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৬:১৫ পূর্বাহ্ণ

আল কোরআন ও ছাহেবে কোরআন

ইসলামই একমাত্র আল্লাহর মনোনীত সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ জীবন বিধান। ইসলামের প্রবর্তক মানবতার কান্ডারী মুক্তির দিশারী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীর সর্বাধিক আলোচিত ও প্রভাব বিস্তারকারী একমাত্র ব্যক্তিত্ব। আর তাঁর উপর অবতীর্ণ মহাগ্রন্থ আল ক্বোরআনই একমাত্র অদ্বিতীয় গ্রন্থ। যা গোটা বিশ্বমানব গোষ্ঠীর মুক্তির সনদ। সর্বোপরি যাতে রয়েছে গোটা বিশ্ববাসীর সমস্যার সমাধান ও সব জিজ্ঞাসার জবাব, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, জাতীয়, আন্তর্জাতিক, সকল বিভাগ ও শাখা প্রশাখার সুস্পষ্ঠ ও চূড়ান্ত সমাধান রয়েছে এতে। রাষ্ট্রনীতি পররাষ্ট্রনীতি, সমরনীতি, কূটনীতি, বাণিজ্যনীতি, আইন ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, ফৌজদারী দন্ডবিধি, স্বাস্থ্য নীতিসহ মানব জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগের নিরেট নির্ভুল ক্রটিমুক্ত বিবরণ সম্বলিত এক অদ্বিতীয় অতুলনীয় গ্রন্থ আল ক্বোরআন। অমুসলিম দার্শনিক, চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, গবেষক, সমালোচকগণ ও এ বাস্তব সত্যকে অকুণ্ঠ চিত্তে স্বীকার করেছেন। সুতরাং একথা স্বীকার্য যে, আল ক্বোরআনই একমাত্র জ্ঞান বিজ্ঞানের উৎস। আজকের আলোচনায় সংক্ষিপ্ত পরিসরে আল ক্বোরআনের পরিচিতি মুলক বর্ণনাদি উপস্থাপনের মাধ্যমে কিছু তত্ত্ব ও তথ্যের আলোকপাত করার প্রায়াস পাচ্ছি।
পারা, সূরা, আয়াত, শব্দ, অক্ষর পরিসংখ্যান ও আয়াতের প্রকারভেদ:
গোটা ক্বোরআন ৩০টি পারায় বিভক্ত। হিজরী ৮৬ সালে এভাবে পারা, অর্ধেক, এক চতুর্থাংশ, ইত্যাদি চিহ্নিত করা হয়। মোট সুরা সংখ্যা ১১৪টি। মোট রুকু সংখ্যা ৫৪০টি। এর আয়াতের বিশুদ্ধ মতানুসারে ২৭৭৫টি আয়াতের পুনরাবৃত্তি আছে। শব্দ সংখ্যা-মতান্তরে ৭৬৪৩০ অথবা ৭৬৩২০ বা ৭০২৫০ বা ৭৭৪৩৯টি। অক্ষর সংখ্যা মতান্তরে ৩১২৬৯০ বা ৩১১২০০ বা ৩২৩৩১৫টি।
হরকত সমুহের পরিসংখ্যান: যবর-৪৫৩৪৩, যের-৩৯৫৮৬, পেশ-৮৮০৪, নোকতা-১০৫৬৮৪, মদ-১৭৭১, তাশদীদ-১২৭৪।
আয়াতের প্রকার ভেদ: আয়াতের ওয়াদা (প্রতিশ্রুতি মূলক আয়াত) ১০০০, আয়াতে ওয়ীদ (ভীতি প্রদর্শন ও শাস্তিমূলক আয়াত) ১০০০, নাহী (নিষেধাজ্ঞা সুচক আয়াত) ১০০০, আমর (আদেশ সুচক আয়াত) ১০০০, মেছাল (দৃষ্টান্ত বর্ণনা মূলক আয়াত) ১০০০, কছছ (ঘটনা প্রবাহ মূলক আয়াত), ১০০০, হালাল সংক্রান্ত আয়াত ২৫০, হারাম সংক্রান্ত আয়াত ২৫০, তছবীহ (আল্লাহর প্রশংসা সূচক আয়াত) ১০০, বিবিধ আয়াত ৬৬, সর্বমোট:৬৬৬৬।
আল-কোরআনের সাত মনজিলের বিরবরণ: সুরা ফাতিহা হতে সুরা নিসা পর্যন্ত ১ম মনযিল, সুরা মায়িদা হতে তওবা পর্যন্ত ২য় মনযিল, সুরা ইউনুছ হতে সুরা নহল পর্যন্ত ৩য় মনযিল, সুরা বনী ঈসরাইল হতে সুরা ফোরকান পর্যন্ত ৪র্থ মনযিল, সুরা শোয়ারা হতে সুরা ইয়াছিন পর্যন্ত ৫ম মনযিল, সুরা সাফফাত হতে হুযরাত পর্যন্ত ৬ষ্ঠ মনযিল, সূরা ক্বাফ হতে নাস পর্যন্ত ৭ম মনযিল।
মক্কী ও মদনী সূরার সংখ্যা:
সর্বমোট ১১৪টি সুরার মধ্যে ১৭টি সুরা সম্পর্কে মতভেদ দেখা যায়। এর মধ্যে ৫টি সুরা নিয়ে ব্যাপক মতভেদ রয়েছে। অবশিষ্ট ১২টির মধ্যে অধিকাংশের মতে ৪টি মাদানী ও ৮ আটটি মক্কী। নিম্নোক্ত পাঁচটি সুরা সম্পর্কে মতভেদ আছে। আল বাইয়্যনাহ (৯৮), আল আদিয়াত (১০০), আল মাউন (১০৭), আল ফালাক (১১৩), আননাস (১১৪), অধিকাংশের মতে যে ৪টি সুরা মাদানী তা হলো-আররাদ (১৩), আররহমান (৫৫), আদদাহর (৭৬), আল যিলযাল (৯১), অধিকাংশের মতে যে আটটি সুরা মক্কী তা হলো আততীন (৯৫), আলক্বদর (৯৭), আততাকাছুর (১০২), আলআছর (১০৩), আলকুরাঈশ(১০৬), আল কাউছার (১০৮), আল কাফিরুন (১০৯), আল ইখলাস (১১২), মক্কী সুরার সংখ্যা অধিকাংশের মতে ৮৯টি এবং মাদানী সুরা ২৫টি। কারো মতে, মক্কী ৯২টি মাদানী ২২টি, প্রথমোক্ত মতানুসারে ক্বোরআনের শেষ দু’পারায় অধিকাংশ মক্কী সূরা রয়েছে: ২৯ পারার শেষে ১১টি সুরার সবই মক্কী, আমপারার ৩৭টির মধ্যে ৩৪টি মক্কী মোট=৮৯টি। মক্কী সুরার ৪৫টিই শেষ দুপারায়, বাকী ৪৪টি সমগ্র কোরআনে ছড়িয়ে আছে। নবুয়তের সম্পূর্ণ ২৩ বৎসরের মক্কীযুগ প্রথম ১৩ বৎসর এবং মাদানী যুগ হিজরতের পর ১০ বৎসর। মহাগ্রন্থ আল ক্বোরআনের একাধিক স্থানে বিভিন্ন শব্দাবলীর পরস্পর সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। যেসব শব্দসমূহের মধ্যে পরস্পর সামঞ্জস্যতা দেখা যায় তা নিম্নে লিপিবদ্ধ করা হল এবং সে সব শব্দ সমূহ ক্বোরআনে কতবার উল্লেখ হয়েছে তাও উল্লেখ করা হল।
আল কোরআনে শব্দ সমূহের সামঞ্জস্যতা: কোরআন ও সমার্থক ৭০বার, ওহী সমার্থক শব্দ ৭০ বার। মালাইকাতুন (ফেরেস্তা) শব্দ ৬৮ বার, শুধুমাত্র ক্বোরআন শব্দ ৬৮ বার। রসুলুন (রসুল) ও সমার্থক শব্দ ৩৬৮ বার। নাছুন, ইনছানুন, ইনছুন, উনাছুন, এবং বশরুন ও সমার্থক শব্দ ৩৬৮ বার। রুহুল কুদুছ জিবরাঈল (আ:) এর উপাধি ৪ বার।‘মুহাম্মদ’ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ৪ বার। ‘রুকু’ শব্দ ১৩ বার, হজ্ব শব্দ ১৩ বার, যহীম (জাহান্নাম) শব্দ ২৬ বার, একাব (শাস্তি) শব্দ ২৬ বার, আছনাম (প্রতীমা) ৫ বার, খামরুন শব্দ ৫ বার, খিনযির (শুকুর) শব্দ ৫ বার, ছালেহাত (সৎকর্ম শীল) ১৬৭ বার, সাইয়্যাত (অসৎকর্ম) ১৬৭ বার, হাররুন (গরম) শব্দ ৪ বার, বরদুন (ঠাণ্ডা) শব্দ ৪ বার, নফউন (উপকারিতা) ৫০ বার, ফাসাদ (অপকারিতা অশান্তি) ৫০ বার, বছর ও বছীরত, চক্ষু ও দৃষ্টি শক্তি শব্দ ১৪৫ বার, শয়তান শব্দ ৮৮ বার, ফেরেস্তা শব্দ ৮৮ বার। দুনিয়া (ইহকাল) শব্দ ১১৫ বার, আখেরাত (পরকাল) শব্দ ১১৫, ঈমান (বিশ্বাস) শব্দ ২৫ বার, কুফরুন (অবিশ্বাস) ২৫ বার, রহমান (দয়ালু) ৫৭ বার, রহীম (দয়ালু) ১১৪ বার, (রহমান শব্দের দ্বিগুণ), ফুজজার (গুনাহগার) শব্দ ৩ বার, আবরার, (নেককার) শব্দ ৬ বার, যাকাত শব্দ ৩২ বার, বরকত (বৃদ্ধি) শব্দ ৩২ বার, সউমুন (রোজা) ১৪ বার, ছবর (ধৈর্য্য) শব্দ ১৪ বার, দ্বীনুন (ধর্ম) ৮২ বার, সুজুদুন (সিজদা) ৯২ বার, ছালামুন (শান্তি) ৫০ বার, তৈয়্যবাতুন (পবিত্রতা) ৫০ বার, মুসলিমুনা (মুসলমান) ৪১ বার, জিহাদ (ধর্মযুদ্ধ) ৪১ বার, নবুয়ত শব্দ ৮০ বার, সুন্নাত শব্দ ১৬ বার (নবুয়ত শব্দের ৫ গুণ)। সালাত ও মুসাল্লা (নামায) ৬৮ বার, নাজাতুন (মুক্তি)৬৮ বার। মহব্বত (ভালবাসা) ৮৬ বার, তাআতুন (আনুগত্য) ৮৬ বার। সামাউন (আসমান) শব্দ ৭ বার, আসমানের সংখ্যা ও ৭টি। উপরোক্ত তত্বমুলক আলোচনার প্রেক্ষিতে সহজে অনুমেয় যে, আল ক্বোরআনই একমাত্র অদ্বিতীয় গ্রন্থ, যার প্রতিটি সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয় পর্যন্ত আজো অপরিবর্তনীয় ও চির অম্লান। দুনিয়ার সর্বত্র এমন একটি গ্রন্থ কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না যার দাড়ি, কমা, সেমিকোলন, হাইপেন, বিরামচিহ্ন, থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি বিষয় সুনিপুন ভাবে সংরক্ষিত আছে। এটা আল ক্বোরআনের অন্যতম বিশেষ মুজিযা। এই গ্রন্থের সংরক্ষনের জিম্মাদার একমাত্র আল্লাহই। রব্বুল আলামীন স্বয়ং এরশাদ করেছেন, “আমি নিজেই ক্বোরআন অবতীর্ণ করেছি, এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষণকারী। (এজাজে কুরআন কৃত: আল্লামা মুহাম্মদ শরীফ)
ছাহেবে ক্বোরআন প্রসঙ্গ: চিরন্তন শাশ্বত সর্বজ্ঞ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা, মহান রাব্বুল আলামীন ধরাধামে বিভ্রান্ত মানব গোষ্ঠীর হেদায়তের জন্য সর্বোপরি তার একত্ববাদ ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য অসংখ্য নবী রাসূল প্রেরণ করেছেন, নবীকুল সরদার বিশ্ব মানবতার কান্ডারী, মুক্তির দিশারী সাম্যের মূর্ত প্রতীক, সর্বকালের, সর্বযুগের, সর্বশ্রেষ্ঠ, সর্বোত্তম, সর্বশেষ নবী মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করে গোটা বিশ্ববাসীকে ধন্য করেছেন। সর্বগুণে গুণান্বিত এ মহান ব্যক্তিত্বের সামগ্রিক জীবন ছিল সফলতায় পরিপূর্ণ। তিনিই বিশ্বের একমাত্র ব্যক্তিত্ব যার জীবনের সামগ্রিক দিক ও বিভাগ সুস্পষ্টরূপে সংরক্ষিত, তিনিই মানব জাতির জন্য একমাত্র উসওয়াতুন হাসানা বা সর্বোত্তম আদর্শ। প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পিতা আবদু্‌ল্লাহ ৫৪৫ খৃস্টাব্দে জন্ম লাভ করেন। ২৪ বৎসর ৭ মাস বয়সে তিনি মদীনার খ্যাতনামা ব্যবসায়ী ওয়াহাবের কন্যা আমিনার সাথে দাম্পত্য জীবনে আবদ্ধ হন। ৫৭০ খৃস্টাব্দে জানুয়ারী মাসে প্রিয়নবীর পিতা আবদুল্লাহ ইহধাম ত্যাগ করেন। (নবীয়ে রহমত এক নযর মে কৃত: মাওলানা মুহাম্মদ আলী)
প্রিয় নবীর আবির্ভাব: পিতা আবদুল্লাহর ইন্তেকালের ৫ মাস পর সোমবার ১২ই রবিউল আউয়াল ৫৭০ খৃস্টাব্দে সুবহে ছাদেকের সময় কুরাইশ বংশের হাশেমী গোত্রে মহানবী সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুভাগমন করেন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

আবদুল মুকতাদির
বাহুলী, পটিয়া, চট্টগ্রাম।

প্রশ্ন: মহিলাদেরকে জুমা’আর নামায পড়তে হবে কিনা? সঠিক মাসআলা জানালে কৃতার্থ হবো।
উত্তর: জুম’আর নামায ওয়াজিব হওয়ার জন্য এগারটি শর্ত রয়েছে, তন্মধ্যে একটিও পাওয়া না গেলে জুমা ফরজ হবে না। তন্মধ্যে একটি হলো প্রাপ্ত বয়স্ক জ্ঞান সম্পন্ন পুরুষ হওয়া, সুতরাং মহিলাদের জন্য জুম’আর নামায ওয়াজিব নয়। মহিলা মসজিদে নয় ঘরে জোহর পড়াটা উত্তম। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মসউদ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, মহিলারা ঘরে নামায পড়া উত্তম। (আবু দাউদ শরীফ)
আমাদের হানফী মাযহাবে মহিলাদের নামাযের জন্য মসজিদে গমনে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। ফিতনার আশঙ্কায় তাদের সর্বপ্রকার নামায ঘরে পড়া উচিৎ। (ওয়াকারুল ফাতওয়া, ২য় খন্ড, পৃ: ১৫৭, ১৫৮)
তবে মহিলার ঘর যদি একেবারে মসজিদের সাথে সংযুক্ত হয় এবং আপন ঘরের ভেতর থেকেই ইমামের এক্তেদা করা যায়, তখন ওই মহিলার জন্য জুম’আ পড়া উত্তম। (বাহারে শরীয়ত, ৪র্থ খন্ড, পৃ: ১৩৩, দুররুল মুখতার, রদ্দুল মুখতার)
মহিলাদেরকে মসজিদে গমনে নিষেধ করাটা ‘ইযনে আম’ এর শর্তে পড়েনা। ফিতনা ফাসাদ থেকে নিরাপদ ও মুক্ত থাকার লক্ষ্যে তাদের নামায ঘরে পড়া উত্তম। (বাহারে শরীয়ত, খন্ড ৪র্থ, পৃ: ৯৯)

পূর্ববর্তী নিবন্ধআসন্ন দুর্গাপূজা ও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা
পরবর্তী নিবন্ধআবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ : মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নির্মাণকারী