জুম্’আর খুতবা

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ২৯ এপ্রিল, ২০২২ at ৮:৩১ পূর্বাহ্ণ

সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা!

আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন! তাঁর নির্ধরিত পুণ্যময় দিন ও রাতগুলোকে স্মরণ করুন। মহান আল্লাহর শান্তি নিরাপত্তা অর্জনের লক্ষ্যে সেই নিয়ামতপূর্ণ সৌভাগ্যময় দিন ও রাতগুলোতে ইবাদত বন্দেগীর মাধ্যমে স্রষ্টার সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি করুন। ব্যক্তি জীবন ও সামষ্টিক জীবনে পরিশুদ্ধি অর্জনে সম্মানিত বিশেষ দিন ও রাতগুলোর সঠিক মূল্যায়ন করুন। আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের আনুগত্য অর্জনে ক্বদরের রজনী ও দিবসের প্রকৃত তাৎপর্য অনুধাবণ করুন, সৌভাগ্যময় জীবন লাভে নিজকে ধন্য করুন।

সূরা ক্বদর প্রসঙ্গ:

সূরা ক্বদর মাদানী, অন্য এক বর্ণনামতে সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ। রুকু সংখ্যা এক, আয়াত সংখ্যা পাঁচ, শব্দ সংখ্যা ত্রিশ, বর্ণ সংখ্যা একশত বারটি।

সূরার অনুবাদ:

. নিশ্চয়ই আমি তা (আল কুরআন) ক্বদরের রাতে অবতীর্ণ করেছি। ২. এবং আপনি কি জানেন ক্বদর রাত্রি কি? . ক্বদরের রাত হাজার মাস থেকে শ্রেষ্ঠ। ৪. এতে ফিরিশ্‌তাগণ ও জিব্রাইল আ: অবতীর্ণ হয়ে থাকে, প্রত্যেক কাজে তাদের প্রভূর অনুমতিক্রমে। ৫. শান্তিশান্তি সে রজনীতে ভোর উদয় হওয়া পর্যন্ত। (সূরা: ক্বদর, আয়াত: )

সূরার আলোচ্য বিষয়:

. আল কুরআন নাযিলের রাতের গুরুত্ব ও মর্যাদা। ২. হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ রজনীর আলোচনা। ৩. জমীনে ফিরিস্তারাজি ও জিব্রাইল (.) অবতরনের আলোচনা। ৪. বরকতময় সময় ভোরের আলোচনা।

শানে নুযুল:

প্রখ্যাত তাফসীরকার হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নাঈমী (.) প্রণীত “তাফসীরএ নূরুল ইরফান” এ উপরোক্ত সূরার নিম্নোক্ত শানে নুযুল বর্ণনা করেন। একদা রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামের সামনে “শামসুন” ই.স্রাইলী নামক এক বুজুর্গ ব্যক্তির আমল সম্পর্কে সকলকে অবহিত করেন যে, যিনি এক হাজার মাস যাবত দিনের বেলায় রোযা রাখতেন হাজার মাস যাবত সারা রাত জাগ্রত থেকে ইবাদত বন্দেগীতে অতিবাহিত করতেন। এক সাহাবী আরয করলেন ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা কমহায়াত লাভ করে কিভাবে তাঁর সমকক্ষ হতে পারি? কিয়ামতের দিন সেতো আমলের দিক থেকে আমাদেরকে এগিয়ে যাবে। তখনি আল্লাহ তা’আলা নবীজির উম্মতের সান্ত্বনার জন্য সূরা ক্বদর নাযিল করেন। এতে আল্লাহ তা’আলা তাঁর প্রিয় হাবীবকে জানিয়ে দেন মনঃক্ষুন্ন হওয়ার কোন কার নেই। আপনাকে এমন এক রজনী দান করেছি যে মুসলমান এ রজনীতে ঈমানের সাথে সওয়াব লাভের আশায় জাগ্রত থেকে ইবাদত করবে সে হাজার মাসের চেয়েও বেশী ইবাদতের সওয়াব লাভ করবে। (তাফসীরে নূরুল ইরফান, পৃ: ১৬৬২, তাফসীরে ইবন কাসীর, একাদশ খন্ড: পৃ: ৫৫০)

ক্বদর শব্দের অর্থ ও তাৎপর্য:

ক্বদর শব্দটি আরবি, এর অর্থ সম্মান, মর্যাদা, ইমাম যুহরীর বর্ণনা মতে লায়লাতুল কদর বা ক্বদর রজনী অন্যসব রজনীর তুলনায় অধিক সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ (কুরতুবী ২০:১৩০)

ইমাম ফখরুদ্দীন রাযি (.)’র বর্ণনা মতে লায়লাতুল কদর শব্দটি সূরায় তিনবার উল্লেখ করা হয়েছে, এর তাৎপর্য হচ্ছে সম্মানিত কিতাব মহাগ্রন্থ আল কুরআন, সম্মানিত রাসূলের মাধ্যমে সম্মানিত উম্মতের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। (তাফসীরে কবীর)

ক্বদর এর এক অর্থ পরিমাণ, যেহেতু এ মহিমান্বিত রজনীতে ফিরিস্তাদের মধ্যে গোটা বছরের কর্মের তালিকা ও তাদের কাজের পরিমাণ জানিয়ে দেওয়া হয়। (তাফসীরে নুরুল ইরফান)

হাদীস শরীফের আলোকে লায়লাতুল ক্বদরের ফযীলত:

পূর্ববর্তী আম্বিয়ায়ে কেরামের উম্মতরা দীর্ঘ হায়াত লাভ করতেন যে কারণে তারা অধিক ইবাদত বন্দেগী ও জিহাদ করার সুযোগ পেতেন। সে তুলনায় সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের হায়াত কম। তাঁরা যেন কম হায়াতে অধিক মর্যাদা সম্মান ও সওয়াব অর্জন করতে পারেন আল্লাহ তা’আলা নবীজির ওসীলায় তাঁর উম্মতদেরকে লায়লাতুল ক্বদর দান করে ধন্য করেন। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাঁর পূর্ববর্তী লোকদের বয়স দেখানো হয়। অথবা আল্লাহ যা ইচ্ছা করেছেন তা দেখিয়েছেন, এতে তিনি তাঁর উম্মতের আয়ুকে সংক্ষিপ্ত মনে করলেন, যার কারণে আমলের ক্ষেত্রে তাঁর পূর্ববর্তীদের সমপর্যায়ে পৌছতে সক্ষম হবেনা। অত:পর আল্লাহ তাঁকে হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ রজনী লায়লাতুল ক্বদর দান করলেন। (মুয়াত্তা ইমাম মালিক: হাদীস নং: ৬৯১)

লায়লাতুল ক্বদরে পূর্ববর্তী গুনাহ মাফ হয়:

হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে(সাওয়াব লাভের আশায়) লায়লাতুল ক্বদরে কিয়াম (ইবাদত বন্দেগী) করবে তার পূর্ববর্তী গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং: ২০১৪)

ক্বদর রজনীতে ক্ষমাপ্রার্থী ক্ষমা পাবে:

মহিমান্বিত রজনীতে যারা আল্লাহর ইবাদত বন্দেগীতে নিয়োজিত থাকবে। আল্লাহ তাদেরকে বঞ্চিত করবেন না, মহান প্রভূ স্বীয় ক্ষমা ও সাহায্য দ্বারা তাদেরকে ধন্য করবেন। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “আছে কি কেউ যে আমাকে আহবান করবে? আমি তার আহবানে সাড়া দিব। প্রর্থনাকারী কেউ আছে কি? আমি তাকে প্রদান করব। এস্তেগফার তথা ক্ষমা প্রার্থী কেউ আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দিব। (সহীহ বুখারী, ৬৩২১, মুসলিম ৭৫৮)

রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে লায়লাতুল কদর:

রমজানের প্রতিটি রাত মর্যাদাপূর্ণ বরকতময় ও সম্মানিত। এতে রয়েছে লায়লাতুল ক্বদর। রমজানের শেষ দশকে ক্বদর অনুসন্ধান করার নির্দেশ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। উম্মুল মু’মেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা রমজানের শেষ দশকে বিজোড় রজনীতে লায়লাতুল ক্বদর তালাশ করো। (সহীহ বুখারী, ২০১৭)

লায়লাতুল ক্বদরে ইবাদতকারীদের জন্য ফিরিস্তাদের প্রার্থনা:

ক্বদর রজনীতে যমীনে ফিরিস্তাদের অবতরণ হওয়াটা পবিত্র কুরআন দ্বারা প্রমাণিত। প্রসিদ্ধ সাহাবী হযরত আনাস রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, ক্বদর রজনীতে জিবরীল (.) ফিরিস্তাদের বিরাট জমাতসহ যমীনে অবতরণ করেন, প্রত্যেক বান্দা যারা দাঁড়িয়ে ও বসে আল্লাহর স্মরণ করেন, তাদের জন্য আল্লাহর রহমত প্রার্থনা করেন। (মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদীস: ২০৯৬)

লায়লাতুল ক্বদর’র তারিখ সম্পর্কে সংখ্যা গরিষ্ঠদের অভিমত:

তাফসীরকার ও হাদীস বিশারদদের সংখ্যা গরিষ্ঠ মতানুসারে সাতাশতম রজনীতে লায়লাতুল ক্বদর। ইমাম মুসলিম (.) হযরত উবাই ইবন কাব (রা.) হতে এ মর্মে হাদীস বর্ণনা করেছেন, হযরত মুয়াবিয়া (রা.) ইবন ওমর (রা.) ও ইবন আব্বাস (রা.) প্রমূখ সাহাবায়েকেরাম বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, রমজানের সাতাশতম রাত লায়লাতুল ক্বদর। এটাই হযরত ইমাম আযম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি’র অভিমত। এমর্মে তিনি দলীল পেশ করেন যে, লায়লাতুল ক্বদর শব্দটি কুরআনে তিনবার উল্লেখ হয়েছে শব্দটিতে নয়টি অক্ষর আছে গুণফলে দাড়ায় সাতাশ। (তাফসীরে আযিযী, পৃ: ২৫৯)

এ ছাড়াও সূরা ক্বদরে শব্দ সংখ্যা ত্রিশ তন্মধ্যে “হিয়া” শব্দটি সাতাশতম। (তাফসীরে ইবনে কাসীর, একাদশ খন্ড, পৃ: ৪৫৫)

শব্দে ক্বদরের আমল: উম্মুল মু’মেনীন হযরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজানের শেষ দশকে রাত জেগে ইবাদত করতেন, পরিবার পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন। এ রাতে অধিক পরিমাণ নফল নামায পড়া উত্তম। অধিক পরিমাণ দুআ করা মুস্তাহাব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আয়েশা (রা.) কে তাঁর প্রশ্নের উত্তরে এ দুআ পাঠ করার নির্দেশ দিয়েছেন, “ আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউবুন করীম তুহিব্বুল আফওয়া ফাআফু আন্নী” হে আল্লাহ আপনি বড় ক্ষমাশীল আপনি ক্ষমা করা পছন্দ করেন। অতএব আমাকে ক্ষমা করুন। (মুসনাদে আহমদ ইবন হাম্বল, ৬১৭১, তাফসীরে ইবনে কাসীর, একাদশ খন্ড, পৃ: ৫৫৩)

এ রাতে কিয়ামুল লায়ল, কুরআন তিলাওয়াত, যিকর আযকার, অধিক হারে দরুদ শরীফ পাঠ, সালাতসালাম, মুরব্বীদের কবর যিয়ারত, দানসাদকা ইত্যাদি এ রজনীর বরকতময় ও পুণ্যময় আমল।

পবিত্র জু’মআতুল বিদা ও রমজানের বিদায়ী বার্তা:

আজ জুম্‌আতুল বিদা রমজানের শেষ জুমা হাদীস শরীফের আলোকে রমজানে প্রতিটি নেক আমলের প্রতিদান ১০গুণ থেকে সাতশগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। এ বিশ্বাসে জুমাতুল বিদার একটি জুমাতে ন্যূনতম ৭০০টি জুমার সমতুল্য সওয়াব নিহিত রয়েছে। আজকের জুমার মিম্বরে খতীবের কণ্ঠে রমজানের বিদায়ের করুণ সুর অনুরণিত হবে। আলবিদাউ, আল বিদাউ ইয়া শাহরা রামদান।

লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআল বেদা রমজান
পরবর্তী নিবন্ধঅনেক স্ফুলিঙ্গের ঐক্য