জামালপুরের ছেলেটি যেভাবে বোমা মিজান

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ৪ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:১৯ পূর্বাহ্ণ

২০০০ সালে ঢাকায় মেসে থাকার সুবাদে সুমন নামে এক রুমমেটের সংস্পর্শে এসে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েন জাহিদুল ইসলাম মিজান। ২০০১ সালে জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) আনুষ্ঠানিক যাত্রার শুরু থেকেই এই সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন মিজান। প্রথমে তিনি সংগঠনের শুরা সদস্য বা গায়েরি এহসার হিসেবে যোগ দেন। ধীরে ধীরে বোমা তৈরির কারিগর হিসেবে দক্ষ হন। ২০১৮ সালের ৬ আগস্ট ব্যাঙ্গালুর থেকে ভারতীয় দুই সহযোগীসহ বোমা মিজানকে গ্রেপ্তার করে ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ। বর্তমানে ভারতে বন্দি জীবন কাটছে।
কে এই বোমা মিজান : ২০০৯ সালে র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর বোমা মিজান তার জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া এবং বিভিন্ন হামলায় অংশ নেওয়ার কথা স্বীকার করে ১৬১ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালে জামালপুরের মাদারগঞ্জের ধলীবন্ধ গ্রামে জন্ম মিজানের। জঙ্গি সংগঠনে যোগদানের পর সুমন, হারুন ও কামরুল নামেও তিনি পরিচিত ছিলেন। ১৯৮৪ সাল থেকে গ্রামের বাড়ি ধলীবন্ধ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও সবশেষে জামালপুর ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে পড়াশুনা করেন।
১৯৯৬ সালে ক্রিকেট খেলা নিয়ে মারামারিকে কেন্দ্র করে ১৯ দিন জেল খাটতে হয় তাকে। এরপর পড়া বাদ দিয়ে বাবার ব্যবসায় যোগ দেন। ১৯৯৯ সালের ২৯ মে বাবা মারা যাওয়ার পর ব্যবসার হিসাব নিয়ে বড় ভাই রফিকের সঙ্গে দ্বন্দ্ব হয়। ২০০০ সালে রাগ করে ঢাকায় চলে আসেন। ঢাকা খিলগাঁওয়ের চৌধুরীপাড়ার অ্যাথলেটিকস গার্মেন্টসে কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর হিসেবে কাজ শুরু করেন মিজান। পাশের তালতলা এলাকায় একটি মেসে থাকতেন। সেখানে থাকা অবস্থায় সুমন নামে এক তরুণের সঙ্গে পরিচয় হলে সে-ই তাকে জঙ্গিবাদের পথে নিয়ে যায়। মিজান বলেছিলেন, সুমনের নির্দেশে সংগঠনের দাওয়াতি কাজ করি। আমার দাওয়াতে প্রথম আমার বাল্যবন্ধু আমির জেএমবিতে যোগ দেয়।
যেভাবে বোমা মিজান : ২০০১ সালের ডিসেম্বরে সংগঠনের নির্দেশে ঢাকায় আসেন মিজান। তখন জেএমবিতে বোমা তৈরির প্রধান কারিগর ছিল শাকিল আহমেদ ওরফে মোল্লা ওমর। মূলত মোল্লা ওমরের কাছেই বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ নেন মিজান। শুরুর দিকে ডাকাতির সময় সঙ্গে হ্যান্ড গ্রেনেড নেওয়া হতো। গ্রেনেডগুলো সংগঠনের জন্য তৈরি করত মোল্লা ওমর ও মারুফ। ধীরে ধীরে নিজেও বোমা তৈরিতে দক্ষ হয়ে উঠেন মিজান। বিশেষ করে হ্যান্ড গ্রেনেড ও টাইম বোমা তৈরিতে দক্ষ ছিলেন। এক পর্যায়ে বোমা তৈরির জন্য সংগঠনে তার নাম হয়ে যায় বোমা মিজান।
টাইম বোমা ও গ্রেনেড তৈরিতে দক্ষ : টাইম বোমা ও গ্রেনেড তৈরিতে অল্প ক’দিনের মধ্যেই মিজানের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। বোমাগুলো এতটাই কার্যকর ছিল যে তার ডাক পড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে। ২০০২ সালে সাতক্ষীরায় দুটি টাইম বোমা তৈরি করেন মিজান; যার একটি রক্সি সিনেমা হলে তিনি নিজেই বিস্ফোরণ ঘটান। তার সহযোগী লোকমান ওরফে শহীদুল্লাহ দ্বিতীয় বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটান সার্কাস প্যান্ডেলের ভেতরে। একই বছর ডিসেম্বরে জামালপুর জেলার দায়িত্বশীল তারেকের নির্দেশে ময়মনসিংহে যান তিনি। সেখানে ময়মনসিংহের দায়িত্বশীল ফারুক তাকে পাওয়ার জেল ও ডেটোনেটর সংগ্রহ করে দেয়। মিজান নিজে চারটি টাইম বোমা তৈরি করেন। ৭ ডিসেম্বর ভাগ্নে শহীদ, গালিব, লোকমান ও মিজান চারটি বোমা নিয়ে সন্ধ্যার শো-তে চারটি সিনেমা হলে বিস্ফোরণ ঘটান। ২০০৩ সালের জানুয়ারিতে মিজান প্লাস্টিক বডির একটি হ্যান্ড গ্রেনেড তৈরি করে মোয়াজকে সঙ্গে নিয়ে শেরপুরের সার্কাস প্যান্ডেলে বিস্ফোরণ ঘটান।
জামিনে বের হয়ে বেপরোয়া : মিজান সম্পর্কিত নথিপত্রে জানা যায়, ২০০৩ সালে মিজান ঢাকার বাসাবোতে কিছুদিন থাকার পর আবারও সাতক্ষীরা গিয়ে বর্ডার থেকে অস্ত্র, গুলি নিয়ে খুলনা আসার পথে ঝিকরগাছা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ২২ মাস পর ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে জামিনে বের হন। জেল থেকে বের হয়ে বাসাবো এলাকায় শায়খ রহমানের বাসায় থাকতে শুরু করেন।
২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ময়মনসিংহ জেলার চেচুয়া বাজারে ব্র্যাক অফিসে আতাউর রহমান সানির নেতৃত্বে কাওসার, ভাগ্নে শহীদ, তারেক, সালাউদ্দিনসহ ১০-১২ জন ডাকাতি করে ও দুটি মোটর সাইকেল লুট করেন। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারা দেশের ৬৩ জেলায় একযোগে যে বোমা হামলা চালিয়েছিল জেএমবি, সেই হামলায় কক্সবাজার এলাকায় থেকে অংশ নিয়েছিলেন মিজান।
নিত্য নতুন বোমা তৈরিতে পারদর্শী : মিজানের ভাষ্য, আমি কক্সবাজারে বসে ৫/৭টি বোমা তৈরি করি। এরপর চট্টগ্রামে গিয়ে জাবেদ ইকবালের তত্ত্ব্বাবধানে সিটি গেট এলাকায় দুটি বই বোমা, একটি ফ্লাক্স বোমা, ২-৩টি জ্যামিতি বক্স বোমা ও ১৪-১৫টি হ্যান্ড গ্রেনেড তৈরি করি। আমার তৈরি করা বোমা দিয়ে ২০০৫ সালের ৩ অক্টোবর সাড়ে ১১টায় কোতোয়ালী থানা বাজার এলাকায় জাবেদ ও মাসু এবং দুপুর ১২টায় চট্টগ্রামের কোর্ট বিল্ডিং নতুন ভবনের দ্বিতীয় তলায় জজ আদালতে আনাস ও মাসু বিস্ফোরণ ঘটায়। এছাড়া ২৯ নভেম্বর সকাল ৯টায় চট্টগ্রাম জজ শিপ কর্মচারী কল্যাণ পরিষদ ক্যান্টিনের সামনে রাস্তায় জাবেদ বিস্ফোরণ ঘটায়।
আগেও পালিয়ে ভারতে ছিলেন : ২০০৫ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকার সবুজবাগে র‌্যাবের এক অভিযানে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক উদ্ধারের পর অন্যদের সঙ্গে দুটি মামলা হয় মিজানের বিরুদ্ধে। গ্রেপ্তারের ভয়ে ওই বছরের ডিসেম্বরে নওগাঁ হয়ে ভারতে চলে যান মিজান। মুর্শিদাবাদে কাপড়ের ব্যবসা করেন। ব্যবসার পাশাপাশি ২-৩ জন বাংলাদেশি ও ১৪-১৫ জন ভারতীয় নাগরিক মিলে সেখানে সাংগঠনিক কার্যক্রমও করেন। ২০০৬ সালে একবার দেশে ফিরে এসে কোরবানির ঈদের পর কুষ্টিয়া সীমান্ত দিয়ে আবারও ভারতে প্রবেশ করেন। এক সপ্তাহ পর তার স্ত্রী হালিমা নুসাইরও অবৈধ পথে ভারতে প্রবেশ করেন। সাইফ নামে এক সহযোগীর মাধ্যমে নদীয়া জেলার করিমপুর থানা এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেন। ২০০৮ সালের মে পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করেন। পরে দেশে ফিরে সংগঠনকে শক্তিশালী করার কাজ করতে গিয়ে ২০০৯ সালের ১৫ মে ধরা পড়েন ঢাকার মিরপুরে।
প্রিজন ভ্যানে হামলার পর পালিয়ে আবার ভারতে : মিরপুর থেকে গ্রেপ্তারের পাঁচ বছর পর ২০১৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে বোমা মিজানসহ তিন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয় জেএমবির নাসরুল্লাহ ব্রিগেড। ওই ঘটনার পরদিনই মিজানের দুই সহযোগীর একজন রাকিবুল হাসান ওরফে হাফেজ মাহমুদ পুলিশের হাতে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। তখন থেকেই সালাউদ্দিন সালেহীন ও বোমা মিজান ভারতে আত্মগোপনে থেকে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছিলেন।
অবশেষে ভারতীয় গোয়েন্দা জালে ধরা : ভারতে আত্মগোপনে যাওয়ার পর ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের খাগড়াগড়ের হামলায় নাম আসে মিজানের। ভারতীয় গোয়েন্দাদের কাছে তার নাম ‘কাওসার’। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে বুদ্ধগয়ায় বৌদ্ধ ধর্মগুরু দালাইলামাকে হত্যা পরিকল্পনা এবং বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় বোমা মিজানের নাম পায় গোয়েন্দারা। সেই সূত্র ধরে অনুসন্ধান করতে গিয়ে একই বছর ৬ আগস্ট ব্যাঙ্গালুর থেকে ভারতীয় দুই সহযোগীসহ বোমা মিজানকে গ্রেপ্তার করে ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমূল নকশায় বর্তমান স্থানেই হবে শহীদ মিনার
পরবর্তী নিবন্ধবোমা মিজানের মৃত্যুদণ্ড