জাদুর বাক্স

রেজাউল করিম | বুধবার , ২৩ জুন, ২০২১ at ১০:৩৪ পূর্বাহ্ণ

বাপজানের বায়োস্কোপ সিনেমাটির সাথে অনেকে পরিচিত। রিয়াজুল রিজু পরিচালিত ও প্রযোজিত ২০১৫ সালের বাংলাদেশী নাট্য চলচ্চিত্র। কারুকাজ ফিল্মসের ব্যানারে নির্মিত চলচ্চিত্রটি রিজু পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র। ছবিটির কাহিনি লিখেছেন মাসুম রেজা এবং চিত্রনাট্য লিখেছেন মাসুম রেজা ও রিয়াজুল রিজু। এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন শহীদুজ্জামান সেলিম, শতাব্দী ওয়াদুদ ও সানজিদা তন্ময়। এক বায়োস্কোপওয়ালার জীবনকাহিনি নিয়ে তৈরি বাপজানের বায়োস্কোপ।
এমন একটা সময় ছিল যখন বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিলো সার্কাস ও যাত্রাগান। কিন্তু সেই বিনোদনেও ছিল সীমাবদ্ধতা। লালদীঘি চত্বরে ঐতিহ্যবাহী আবদুল জব্বারের বলী খেলায় সার্কাসের দল আসত। বলী খেলা ও মেলা শেষ হলেও লালদীঘি মাঠে সার্কাসের দল থাকত। লেখা থাকত ‘শুধুমাত্র প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য।’ কিন্তু সবার জন্য উন্মুক্ত ছিলো একটি লাল বাক্স। অনেকেই সেই লাল রঙের বাক্সকে জাদুর বাক্স নামে ডাকতো। সে যুগের সেই জাদুর বাক্সই হলো বায়োস্কোপ।
বায়োস্কোপ শব্দের অর্থ চলচ্চিত্র, ছায়াছবি, সিনেমা বলা হলেও বাংলাদেশে বায়োস্কোপ নামে যা প্রচলিত তার যাত্রা শুরু হয়েছিল আধুনিক সিনেমা বা চলচ্চিত্রেরও বেশ আগে। বাংলায় বায়োস্কোপকে প্রথমে টকি বা টগিও বলা হতো। স্টিফেন্স নামক এক বিদেশি বাংলায় প্রথম বায়োস্কোপ দেখান। ১৮৯৬ সালে একটি থিয়েটার দলের সঙ্গে স্টিফেন্স কলকাতায় এসেছিলেন। আর তখনই তিনি কলকাতায় প্রথম দেখিয়ে যান বায়োস্কোপ। তারপর তার অনুপ্রেরণায় মানিকগঞ্জের হীরালাল সেন দুই বছর পর ১৮৯৮ সালে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিকভাবে বায়োস্কোপ দেখানো শুরু করেন। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে।
বায়োস্কোপের সেই লাল বাক্সের সামনের দিকে দুই পাশে চোঙার মতো থাকতো কয়েকটি মুখ। প্রতিটি মুখেই লাগানো থাকতো লেন্স। আর বাক্সের ভেতর কাপড়ে লাগানো থাকতো ছবি। কাপড়টা পেঁচানো থাকতো পাশের দুটি কাঠিতে। কাঠির ওপরের মাথায় বাক্সের বাইরে লাগানো ছিল একটা হ্যান্ডেল। এই হ্যান্ডেল ঘোরালে ছবিসহ কাপড়টা একপাশ থেকে গিয়ে যখন আরেক পাশে পেঁচাতে থাকতো তখন চোঙায় চোখ লাগিয়ে দেখা যেতো ছবিগুলো। লেন্সের সুবাদে তখন সেই ছবিগুলো দেখাতো কাছে এবং বড় করে। ছবির সঙ্গে সঙ্গে করতাল বাজিয়ে সুরে সুরে দেয়া হতো ছবিগুলির ধারাবর্ণনা। কাহিনিতে বায়োস্কোপ ‘কী চমৎকার দেখা গেল!’ কথাটি দিয়েই শুরু হতো জাদুর বাক্সের জাদু। এভাবে একবার বাঁ থেকে ডানে, ডান থেকে বাঁয়ে প্রদর্শনীর পর মুড়ির টিনের মতো ঢাকনা দিয়ে আটকে রাখা হতো জাদুর বাক্সের চোঙ্গাগুলোর মুখ।
একসময় মেলা, হাট কিংবা বিশেষ কোন দিনে গামছা মাথায় আর কাঁধে বায়োস্কোপ নামের বহুল পরিচিতি এই লাল বাক্সটি নিয়ে হাজির হতেন একজন মানুষ। আর সেই মানুষটিই হচ্ছেন জাদুর বাক্স- বায়োস্কোপের কারিগর। ছবির মাধ্যমে একটি কাহিনি বর্ণনা করে গল্প বলাই ছিল বায়োস্কোপ ও তার কারিগরের কাজ। কাহিনিতে আগে থাকত ক্ষুদিরামের ফাঁসি, মালকা বানু, আমিনা সুন্দরী, ভেলুয়া সুন্দরী, বেদের মেয়ে জোছনা, মক্কা-মদিনা, আগ্রার তাজমহল, কারবালা-প্রান্তরের যুদ্ধ, তীরবিদ্ধ রক্তাক্ত দুলদুল ঘোড়া ইত্যাদি। শুরুর দিকে বায়োস্কোপে হাতে আঁকা ছবি ব্যবহার হতো। সাথে চলত জারিগানের সুরে সুরে ধারাবিবরণী, সঙ্গে করতালের তাল। ছবি তোলার জন্য সেলুলয়েড ফিল্ম আবিষ্কারের পর চলমান বস্তু বা ব্যক্তির ছবি হুবহু তোলা সম্ভব হলো। আর তখন থেকে কতগুলো ছবি একটি ড্রামের ভেতর পর পর লাগিয়ে ড্রামটি ঘোরানো হতো আর ড্রামের একদিকে রাখা হতো দেখার ব্যবস্থা। এভাবেই বায়োস্কোপের যাত্রা। তারপর ড্রাম থেকে আসে প্রজেক্টর আর পর্দা। বায়োস্কোপ থেকে তা উন্নীত হয় সিনেমা হলে। তখন ছবিগুলোর স্থান হয় বাক্স থেকে রূপালি পর্দায়। এরপর নির্বাক ছবি একদিন সবাক হয়। সাদাকালোর যুগ পাঠ চুকিয়ে আসে রঙিন চলচ্চিত্র। সেদিক থেকেই সিনেমা মা হলকে বায়োস্কোপের উত্তরসূরি বলা হয়। বাস্তবে বায়োস্কোপ এখন আর নেই বললেই চলে। দিনবদলের এই যুগে বিম্মৃতির অতল গহব্বরে হারিয়ে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে উপনীত এই অতীত ঐতিহ্যকে বায়োস্কোপ নিয়ে তৈরি হয়েছে গান ও সিনেমা। এরই মধ্য দিয়ে বাংলায় বায়োস্কোপ পূর্ণ করছে সোয়া শত বছরের অধিক। বায়োস্কোপের স্থান এখন অনেকটা জাদুঘরে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবন্ধু পাখি
পরবর্তী নিবন্ধওয়ারলেস মোড়ে দুর্ঘটনা, টেক্সিচালক গুরুতর আহত