পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে দুঃসাহসী অভিযান পরিচালনা এবং বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে পরিবেশ সৈনিক হিসেবে গড়ে তুলতে অনন্য অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে জাতীয় পরিবেশ পদক পেয়েছেন চট্টগ্রামের সন্তান মুনীর চৌধুরীসহ তিনজন। এছাড়া ব্যক্তি পর্যায়ে অপর দুইজন এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে চারটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান এই পদক লাভ করে। বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও পরিবেশ মেলা–২০২৫ এবং জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান ও বৃক্ষমেলা–২০২৫ উপলক্ষে বিভিন্ন পর্যায়ে জাতীয় পুরস্কার ও সম্মাননা তুলে দেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
গতকাল বুধবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বাংলাদেশ–চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পুরস্কার তুলে দেন তিনি। প্রশাসন ক্যাডারের আলোচিত কর্মকর্তা চট্টগ্রামের মুনীর চৌধুরী চট্টগ্রাম বন্দরের ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বঙ্গোপসাগর ও কর্ণফুলী নদীতে ২০০১ ইং থেকে দেশি–বিদেশি জাহাজের অবাধ দূষণের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালিয়ে দূষণ হ্রাসে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। এছাড়া কর্ণফুলী তীরবর্তী অর্ধ শতাধিক অবৈধ ডকইয়ার্ড ও স্থাপনা উচ্ছেদ করে নদীর নাব্যতা রক্ষায় দৃঢ় ভূমিকা পালন করেন। ২০০৩ সনে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের মেরিন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, মেঘনা, সুগন্ধা, কর্ণফুলী, কীর্ত্তনখোলাসহ বহু নদ–নদীতে ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করেন। প্রায় ৭ হাজার দেশি–বিদেশি জাহাজ তাঁর অভিযানে আটক ও দণ্ডিত হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক এনফোর্সমেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে এক হাজারেরও বেশি অভিযান চালিয়ে পরিবেশ দূষণের মাত্রা হ্রাসে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন। বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ইতিহাসে মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী সর্বপ্রথম পরিবেশ ক্ষতিপূরণ ও জরিমানা প্রয়োগ করেন। তাঁর দূষণ বিরোধী অভিযানে প্রায় ৭০ শতাংশ শিল্প কারখানায় বর্জ্য পরিশোধনাগার স্থাপিত হয়। এছাড়া তার অভিযানে অর্ধশতাধিক অবৈধ, দূষণকারী শিল্পকারখানা উচ্ছেদ এবং গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। উচ্ছেদ করা হয় ৩ শতাধিক অবৈধ ইটভাটা। জলাশয় ও কৃষিজমি দখল ও ভরাট করে সরকারি কর্মকর্তা ও প্রভাবশালীদের অবৈধ আবাসন উচ্ছেদ করা হয় ১১টি। চট্টগ্রাম ও কঙবাজারসহ দেশজুড়ে উদ্ধার করা হয় ৬১১ একর পাহাড় ও উপকূলীয় বনভূমি এবং প্রায় আড়াই হাজার একর কৃষিজমি। ইটভাটাসহ পরিবেশ দূষণকারি সামগ্রী ও যন্ত্রপাতি জব্দ করা হয় সাড়ে চার হাজার মেট্রিক টন। পরিবেশ রক্ষায় পরিচালিত অভিযানকালে তিনি জরিমানা আদায় করেন ৭৪ কোটি টাকা। পরিবেশ অধিদপ্তরের রাজস্ব আয় ৩০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা থেকে ১০৯ কোটি ১৮ লাখ টাকায় উন্নীত হয়। দেশের বিভিন্ন কর্পোরেট গ্রুপ পরিবেশ দূষণে মুনীর চৌধুরীর অভিযানে দণ্ডিত হয়।
২০১৮–১৯ ইং সনে দুর্নীতি দমন কমিশনে দায়িত্ব পালনকালে মুনীর চৌধুরী দেশব্যাপী দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের সমান্তরালে পরিবেশ অপরাধ বন্ধে পুনরায় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এসময় পরিবেশ রক্ষা অভিযানে উদ্ধার হয় ৬শ একর পাহাড় ও উপকূলীয় বনভূমি, অবৈধ ড্রেজিং থেকে নদী এলাকা উদ্ধার হয় ১০০ নটিক্যাল মাইলেরও বেশি।
বিজ্ঞান জাদুঘরে যোগদানের পর মুনীর চৌধুরী জাদুঘরের ক্যাম্পাসে পরিবেশ রক্ষা উন্নয়নে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। পৌনে ৫ একর এলাকাকে ব্যাপক সবুজায়ন করা হয়। রোপন করা হয় ফলদ, বনজ, ওষুধি গাছ। প্রাকৃতিক আবহে তৈরি করা হয় সৌর বাগান। পুরো জাদুঘর ভবনের অভ্যন্তরে ও বহিরাঙ্গনে সবুজের সমারোহে সজ্জিত করা হয়। তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরিবেশ শিক্ষার প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে সারাদেশে ১ হাজারেরও বেশি পরিবেশ ও জলবায়ু সম্পর্কিত বিজ্ঞান সভা, বিজ্ঞান বক্তৃতা, অলিম্পিয়াড ও উদ্ভাবনী প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। প্লাস্টিক পলিথিনের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্মকে সচেতন করতে প্রায় অর্ধকোটি টাকার পরিবেশ বান্ধব পাটের ব্যাগ, কাচের বোতল ও উপহার সামগ্রী প্রদান করা হয়। প্রাতিষ্ঠানিক অভূতপূর্ব পরিবেশ ও সুশাসনের স্বীকৃতি স্বরূপ বিজ্ঞান জাদুঘর অর্জন করে আন্তর্জাতিক মান সংস্থা কর্তৃক আইএসও সার্টিফিকেট। এছাড়া উন্নত প্রাতিষ্ঠানিক কর্মপরিবেশ এবং কঠোর অনুশাসনের স্বীকৃতি স্বরূপ পরপর ৪বছর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় কর্তৃক জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর অর্জন করে এপিএ সনদ। পরিবেশ রক্ষায় অনন্য সব অবদানের জন্যই এবছর তাকে জাতীয় পরিবেশ পদক প্রদান করা হয়।
মুনীর চৌধুরী ছাড়াও এবছর জাতীয় পরিবেশ পদক লাভ করেন ব্যক্তি পর্যায়ে মোহাম্মদ মাহমুদুল ইসলাম ও অধ্যাপক ড. এম ফিরোজ আহমেদ। প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে এই পুরস্কার পায় স্নোটেঙ আউটারওয়্যার লিমিটেড, ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্ট এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। অপরদিকে ২০১০ সাল থেকে চালু হওয়া বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে জাতীয় পুরস্কার–২০২৫ পেয়েছেন নাটোরের মো. ফজলে রাব্বী (ব্যক্তি), শেরপুর বার্ড কনজারভেশন সোসাইটি (প্রতিষ্ঠান), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনোয়ার হোসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ। প্রত্যেককে ২২ ক্যারেটের স্বর্ণপদক (দুই ভরি), এক লাখ টাকার চেক ও সনদপত্র দেওয়া হয়।
পুরস্কার হিসেবে তারা পান স্বর্ণের সমমূল্যের অর্থ, ৫০ হাজার টাকার চেক, ক্রেস্ট ও সনদপত্র। বৃক্ষরোপণে জাতীয় পুরস্কার–২০২৪ এর সাতটি শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে দলগ্রাম দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় (লালমনিরহাট), মানিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়, দিলরুবা রহমান (টাঙ্গাইল), সোহেল নার্সারি (রংপুর), নাটোরের জেলা প্রশাসক আসমা শাহীন, চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগ এবং বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট। প্রত্যেকে পান সনদ, ক্রেস্ট এবং এক লাখ, ৭৫ হাজার ও ৫০ হাজার টাকার চেক।
সামাজিক বনায়নে সর্বোচ্চ লভ্যাংশপ্রাপ্ত ১০ জন উপকারভোগীর মধ্যে মো. শাহাজ উদ্দিন পান ৬ লাখ ৭ হাজার ৯৫০ টাকা, উকিল মুর্মু পান ৫ লাখ ৫৭ হাজার ৩২৫ টাকা এবং মনোয়ারা বেগম পান ৪ লাখ ১৬ হাজার ৭০০ টাকা। অন্যরাও সম্মাননা হিসেবে যথাযথ চেক পান।
অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, পরিবেশ ও প্রকৃতি সুরক্ষায় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করতেই এ ধরনের পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। এসময় মঞ্চে আরও উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. কামরুজ্জামান এবং বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী।