ছা য়া র গ ল্প

মহি মুহাম্মদ | বুধবার , ২৮ জুন, ২০২৩ at ১০:০৭ পূর্বাহ্ণ

মিথ্যেটা না বলে পারা গেল না। একটা আশংকা সব সময় কিছু কিছু মানুষকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। কি জানি কি হয়! তাই আর জীবনে কোনোদিন সে কথাটা বলা হয়ে ওঠে না। আর এ ধরনের কথাগুলো খুব খারাপ সময়ে প্রকাশ পায়। যখন মানুষের দুর্ভাগ্য শুধু তাড়া করে বেড়ায়। আর এ সময় এমন কথা নিয়ে আফসোস করা ছাড়া আর কিছুই থাকে না। এমনি ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল বছর দুয়েক হবে। ঘটনাটি ঘটেছিল এই শহরে। শহরটির নাম রূপনগর।

ধাক্কাটা কে মেরেছিল আগে, এখন দুজনের কারোরই মনে নেই। মুখোমুখি বসে আছে ওরা, রিওতেই। একে অপরের দোসর হয়ে গেছে ওরা। রাধিকা আর তাশরিফ। রাধিকা সংসারি, তাশরিফ হবো হবো করে টাইম পাস করছে। বয়সটা আরেকটু গড়ালে আর বউ জুটবে না কপালেএসব এখন নিত্যই শুনতে হয়। সে হাসে আর কথার উৎসমুখ থেকে যে বাক্য আসে তাতে তাকে পাগল সাব্যস্ত করে অধিকাংশই।

রাধিকা জানত না তাশরিফ তার সিনিয়র ছিল। অবশ্য চাকরিতে রাধিকা সিনিয়র। বয়সে তাশরিফ। এসব ব্যাপারে কোনো দিন কথা হয়নি। কথা হয়েছে একে অপরের ইচ্ছেগুলো নিয়ে। বিনিময় হয়েছে দুঃখগুলো নিয়ে। একই শহরে দুজন দুদিকে থাকে। কিন্তু গল্পটা তাশরিফের নয় বলে দাবি করে রাধিকা। যার গল্পে রাধিকা মশগুল হতে হতে আনমনা হয়ে যায় সে অচেনা। যোগাযোগের সূত্র একমাত্র তাশরিফ। এটা একটা খেলা মনে হয়েছিল রাধিকার। কিন্তু সত্যি যেদিন তাশরিফ একটা কালো শাড়ি এনে ধরিয়ে দিয়ে গেল, সেদিন মনে মনে সে অদেখা মানুষটির একটা স্কেচ করেছিল রাধিকা। একটা গোঁফ কেমন করে তার উঁচু খাড়া নাকের নিচে তাকে সুপুরষ করে প্রস্ফুটিত করে ছিল রাধিকার চোখে, সে কল্পনার জাল রাধিকা আর কারো কাছেই ব্যক্ত করতে পারে নি। অথচ এক সময় ছিল এসব কথা কাউকে না কাউকে বলতে না পারলে, পেট ফেটে, দম আটকে মরণাপন্ন অবস্থায় উপনীত হতে হতো। সংসার হওয়ার পরে রাধিকার বন্ধুবান্ধব বলে আর কেউ নেই। চাকরিতে যারা আছে তারা কলিগ মাত্র। বন্ধু হওয়ার ভরসা কারো নেই। যদি কেউ বন্ধু হতে চায়, তাহলে সে পুরুষের চোখের কোণে রক্তজবার রঙ আছে কিনা তাই আগে খুঁজেতে হয়। সে রঙ দেখলে মনে ভয় খেলা করে।

আর সে ভয়ে ভীত রাধিকা কখনও বন্ধুত্ব করতে হাত বাড়ায়নি। তবে এটুকু রাধিকা সম্পর্কে সবাই জানে সে প্রাণোচ্ছ্বল, গুণবতী এবং যেকোনো কাজের জন্য উপযুক্ত। কখনও সে না শব্দটি ঠোঁটের কোণে আনেনি। হাসি মুখে নিজের ব্যথার কবর দিয়ে পরের জন্য কুসুমশয্য রচনা করাই যেন তার একমাত্র ব্রত। কিন্তু যেদিন ঘরের স্বামী নির্যাতনে রাধিকা অন্ধকারে মনে হয়েছিল পৃথিবীতে আর তার যাওয়ার জায়গা নেই, তখন সে রূপনগরের একমাত্র নদীর ব্রীজের ওপর গিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিতে চেয়েছিল। ভবযন্ত্রণা শেষ হলেই তো হলো।

ঠিক তখন, মরবি তো মর দুষ্টু ছেলের মতো তাশরিফ এসে হকচকিয়ে দিয়েছিল তাকে। মৃত্যুটাকে ত্বরাণ্বিত করতে তাশরিফ যে ভাষায় তার সঙ্গে কথা বলেছে, সেটা কোনো আর্ট ফিল্মের চরিত্রের সংলাপ হতে পারে। তবে মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য তাশরিফ তাকে বেশ কিছু পদ্ধতির কথা বলেছিল। মৃত্যুর স্বাদ সম্পর্কে তার মনকে আস্তে আস্তে বিতৃষ্ণায় রূপান্তরিত করেছিল। তবে এমন চাছাছোলা কথাবার্তা এর আগে রাধিকা শোনেনি বলে, তাশরিফকে তার অন্যরকম পুরুষ বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু প্রথমে বিরক্ত হলেও পরে এটা তাশরিফের গুণ বলে অবাক হয়েছিল।

কিন্তু রাত জমজমাট হয়ে গেলে রাস্তায় গাড়ি কমে এলে তাশরিফ বলে, ‘এখন তুমি কী করে বাড়ি ফিরবে?’

একটা অদ্ভুত লজ্জা এসে রাধিকাকে ঘিরে ধরেছিল। সেটাই সে ভাবতে থাকে আকুল হয়ে ছেলেমেয়েদের সামনে, স্বামীর সামনে, শ্বশুরশাশুড়ির সামনে কী করে সে বাসায় ফিরবে? আর তার নিজের কাছেও বাসায় ফেরার কথা মনে পড়তেই তার আবার মরে যেতে সাধ হয়। কিন্তু ততক্ষণে ছয় ফিটের কাছাকাছি পুরুষটি তাকে কথার জাদুতে ফেলেছে। শুধু তাই নয়, রূপনগরের রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে তাশরিফ যখন তাকে একটা রেস্টুরেন্টে এনে খাবারের অর্ডার করলো তখন রাধিকা বুঝতে পারল তার খুব ক্ষিদে পেয়েছে।

রাধিকা, কেন তুমি শুধু শুধু মরতে গিয়েছিলে?’

প্রশ্নটি শুনেই রাধিকা প্রচণ্ড বিষম খেল। একগ্লাস পানি তার দিকে এগিয়ে দিয়ে, চোখে কৌতুকের হাসি মিশিয়ে তাশরিফ বলল, ‘কী হলো তোমার?’

রাধিকার মুখবিবরে তখন চিবানো খাদ্যবস্তু জারিত রসে সিক্ত হয়ে গলধকরণের অপেক্ষায়। কিন্তু চোখের বিস্ময় সে কিছুতেই কাটাতে পারে না। কেন তার চোখে এমন বিস্ময়! কারণ জিজ্ঞেস করতেই রাধিকা বলল, সে তাকে চিনে কিনা!

তখন তাশরিফ বলল, ‘আমি তোমাকে এফবিতে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছি কয়েক বছর আগে। এবং তুমি কোথায় চাকরি করো, কোন সাবজেক্টে লেখাপড়া করেছো, আমি সব জানি। শুধু তাই নয়, আমার এক বন্ধু আছে, যে তোমার খুব কাছের। তার সম্পর্কে এখন কিছু বলবো না।’

এমন কথার ভিতর দিয়ে রাধিকা বুঝতে পারে তাশরিফ বেশ নাটকীয়তা পছন্দ করে। নাটক আর রসব্যঞ্জনা ওর অস্থি মজ্জাগত। ওর খেলায় নাটক আছে আর আছে কৌতূহল। সেই কৌতূহলে নাক গলিয়ে রাধিকার হলো বেশ মরণ। অবশ্য সে কথা আরো পরের। আপনাদের সে গল্প বিরক্তির মনে হতে পারে। কিংবা মনে হতে পারে অতি নাটকীয়তা, তবে মূল গল্পের কোনো ক্ষতি হবে না তাতে।

সে রাতে চাঁদ ওঠেনি। তবে এ শহরে চাঁদের দরকার হয়নি। কারণ ধার করা সোডিয়াম বাতিতে যে আলো ছড়িয়েছে সেখানে চাঁদের আলো একেবারে ম্লান। রাধিকার যেন নতুন জীবন হলো সেদিন। আজ তার ঘরে ফেরার তারা নেই। তবে মন জুড়ে রয়েছে এক ধরনের ক্লান্তি। কাল সকালে শাশুড়ির কথার কী জবাব দেবে সেটাই সে ভাবছিল। ঠিক তখনই সে প্রশ্ন করেছিল, ‘তাশরিফ কী ভাবছো তুমি?’

কাল সকালে শাশুড়ির প্রশ্নের জবাব কী দেব, সেটাই ভাবছি।’

সত্যিটাই বলবে। বলবে আমি মরতে এসেছিলাম। যদি তাতেও বিশ্বাস না হয় শাশুড়ির তাহলে পিঠ খুলে দেখাবে। একটা পুরুষের হিংস্র মারের দাগ তোমার কোমল পিঠে নীলকরদের মতো কেমন নিষ্ঠুর হয়ে কেটে ডেবে আছে, সেটা দেখে শাশুড়ি তোমার যা বোঝার বুঝে নিবে। তার সঙ্গে এটাও জানাবে তোমার শ্বাশুড়িকে, এরপর যদি তার ছেলে আর গায়ে হাত তোলে, তাহলে তুমি সংসার ছেড়ে চলে যাবে। হয়তো নতুন সংসারও গড়তে পারো।’

এ কথা বুঝি ওর কানে যাবে না।’

যাওয়াই তো উচিত।’

এই বলে তাশরিফ তার স্বামীর মানসিক অবস্থার কথা বর্ণনা দেয়। কিন্তু সে অবাক না হয়ে পারে না যে, তাশরিফ তার পিঠের দাগ কেমন করে দেখলো? সেটা কি করে সম্ভব? কাপড়ের নিচে ব্লাউজ তার নিচে অন্তর্বাস। দাগ কী করে…? তার দৃষ্টি কী এতই প্রখর? নাকি তৃতীয় নয়ন? হতেই পারে।

ওর অন্তর্দৃষ্টি এত সূক্ষ্ম!

এই আঘাত যে তার আত্মহননের একমাত্র কারণ নয়, তা তো সে জানার কথা নয়। তার স্বামীর যে পরনারীতে আসক্তি সে ভিডিওর কথা তাশরিফ কেমন করে জানলো, সে কথাই সে আকুল হয়ে ভাবে। আর রাধিকাকে যে ভালোবাসে সেই মানুষটি বা কেমন তরো? তার কাছে এসে দাঁড়াতে তার এত সংকোচ! কেন লোকটির চেহারা কী খুব খারাপ? রাধিকা তো এখন কিশোরী মেয়ে নয় যে, এখন কারো শুধু চেহারা দেখেই বিচার করবে? রাধিকা তো এখন মনও বোঝে। নাকি বোঝে না? তাশরিফ এমন হুট করে মরে যাবে ভাবতেই পারেনি রাধিকা। আবারও সে একা হয়ে যায়। রিও কফির সামনে যেতে যেতে থমকে দাঁড়ায়। মৃত্যুর আগে সেই লোকটির কোনো পরিচয় দিল না তাশরিফ। রাধিকা সেই পুরুষটির চেহারা ভাবতে গেলে সেখানে তাশরিফের চেহারাটাই ভেসে ওঠে।

দুই

মেয়েটি প্রতিদিন দেখে ছেলেটিকে। রিও কফির সামনে উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। সামনের খোলায় জায়গায়। বুকে হাতদুটো ভাঁজ করা। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে ওর পথের দিকে তাকিয়ে আছে।

এই কফিশফে ওদের কিছু স্মৃতি রয়েছে। সে আর ওই ছেলেটি কফিশপে যাওয়া আসা করতো। তারপর কোথা থেকে কি যে হয়ে গেল, বোঝা গেল না। আকস্মিক তাদের স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল। সেই থেকে সে প্রতিদিনই ওকে রিওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। কিন্তু কোনো দিন কথা হয় না।

একদিন মেয়েটি এগিয়ে গেল জিজ্ঞেস করলো, তুমি প্রতিদিন এভাবে দাঁড়িয়ে থাক কেন? আমার বুঝি কষ্ট হয় না?

দুফোঁটা চোখের জল টসটসে লিচুর মতো গাল বেয়ে গড়িয়ে নামে। ছেলেটি কথা বলে না। তার ছায়া লম্বা হতে হতে আকাশ ছুঁতে থাকে। তারপর সে হারিয়ে যায়। মেয়েটি আর কোনো দিন ছেলেটিকে খুঁজে পায় না। একদিন তার চোখের জল শুকিয়ে যায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিউইয়র্ক সিটিতে প্রবেশে এবার দিতে হবে টোল
পরবর্তী নিবন্ধনামহীন গোত্রহীন কথারা