চির নতুনের কবি

রেজাউল করিম | বুধবার , ১০ মে, ২০২৩ at ৬:৪০ পূর্বাহ্ণ

বাঙালির মননে মিশে আছে রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ শুধু বিশ্বকবি নন, তিনি চিত্রশিল্পীও বটে।

রবীন্দ্রনাথ সব বয়সের সবার কাছে আজও দেদীপ্যমান। তাঁর প্রায় প্রতিটি রচনা এখনো নতুন। শিশুদের জন্য তিনি প্রচুর লিখেছেন। ‘এক যে ছিল চাঁদের কোণায়/ চরকা কাটা বুড়ি/ পুরাণে তার বয়স লেখে/ সাতশ হাজার কুড়ি।’ এই ছড়াটি শোনেনি এমন মানুষ খুবই কম আছে। কল্পনার ঘুড়িকে যিনি ইচ্ছামতো মনের আকাশে ছেড়ে দিতে পারতেন, রচনা করতে পারতেন অসাধারণ সুন্দর সব ছড়া, গল্প, নাটক, উপন্যাস।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ কলকাতার জোড়াসাঁকোর অভিজাত ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর। এই পরিবারের পূর্বপুরুষ পূর্ববঙ্গ থেকে ব্যবসায়ের সূত্রে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। দ্বারকানাথ ঠাকুরের চেষ্টায় এ বংশের জমিদারি এবং ধনসম্পদ বৃদ্ধি পায়।

ছোটদের প্রতি ছিল রবীন্দ্রনাথের অগাধ ভালোবাসা। তিনি হারানো শৈশবে বারবার ফিরে যেতে চেয়েছেন ছোটদের মাধ্যমে। ফিরে যেতে চেয়েছেন আনন্দের দিনগুলোতে। ছোটদের ভালোবাসতেন বলেই তিনি কল্পনার রাজ্যে ছোটদের মতো করেই বিচরণ করতেন। তাঁর কবিতা, ছড়ায় তা লক্ষণীয়। ‘বীরপুরুষ’ কবিতায় ছোট বালকটির অসাধারণ বীরত্ব ছোটবড় সকলকেই মুগ্ধ করে। আমরা শিহরিত হই যখন পড়ি– ‘কি ভয়ানক লড়াই হল মা যে/ শুনে তোমার গায়ে দেবে কাঁটা/ কত লোক যে পালিয়ে গেল ভয়ে/ কত লোকের মাথা পড়ল কাটা।’ (বীরপুরুষ)

তাঁর ছড়ায় ছড়িয়ে রয়েছে মজা, মিশে রয়েছে অদ্ভুত সব কাহিনি। তিনি কখনো হেঁটেছেন বাস্তব জগতে, আবার কখনো বিচরণ করেছেন কল্পনার জগতে। শিশুদের মনকে বুঝতেন বলেই তাদের উপযোগী রচনায় তিনি ছিলেন দক্ষ। তাঁর ‘শিশু’, ‘শিশু ভোলানাথ’, ‘খাপছাড়া’, ‘ছড়ার ছবি’, ‘ছড়া’ ইত্যাদি বই ছোটদের আনন্দ দেয়। ছোটদের জন্য তিনি কখনো ছোট হয়েছেন, আবার কখনো নিজে ছোটদের উদ্দেশে বড় হয়ে লিখেছেন। যখন আমরা পড়ি ‘তুই কি ভাবিস দিন রাত্রি খেলতে আমার মন/ কক্‌খনো তা সত্যি না মা আমার কথা শোন।’ (খেলাভোলা)। তখন মনে হয় কোনো ছোট শিশুই বুঝি মায়ের কাছে নিজের আকুল আবেদন নিয়ে হাজির হয়েছে। ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে/ সব গাছ ছাড়িয়ে/ উঁকি মারে আকাশে।’ (তালগাছ)। প্রকৃতির প্রতি তাঁর দরদ অন্যরকম। প্রকৃতির নানান বিষয়কে তুলে এনেছেন শিশুদের ছড়া কবিতায়। বৃষ্টি, নদী, চাঁদ, ফুল, পাখি এসব কিছুই শিশুদের দারুণ প্রিয়। আর এগুলো নিয়ে যখন ছড়া ও কবিতা হয় তখন তা আরো উপভোগ্য। ‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর/ নদেয় এল বান/ আকাশ জুড়ে মেঘের খেলা/ কোথায় বা সীমানা/ দেশে দেশে খেলে বেড়ায়/ কেউ করে না মানা/ কত নতুন ফুলের বনে/ বিষ্টি দিয়ে যায়/ পলে পলে নতুন খেলা/ কোথায় ভেবে পায়/ মেঘের খেলা দেখে কত/ খেলা পড়ে মনে/ কত দিনের নুকোচুরি/ কত ঘরের কোণে/ তারি সঙ্গে মনে পড়ে/ ছেলেবেলার গান/ বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর/ নদেয় এল বান।’ (বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর)

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন একজন সচেতন খেয়ালি মনের মানুষ। বিচিত্র রকম সাধ, ইচ্ছে ছিলো তার মনের মধ্যে। ছোটদের মতো তার মনটাও যখন যা দেখেছেন তাই করতে চেয়েছেন, হতে চেয়েছেন। ‘যখন যেমন মনে করি/ তাই হতে পাই যদি/ আমি তবে এক্‌খনি হই/ ইছামতী নদী।’ অথবা ‘মা যদি হও রাজি/ বড়ো হলে আমি হব/ খেয়াঘাটের মাঝি’ (মাঝি, শিশু)

প্রকৃতির কবি, প্রেমের কবি, ভালোবাসতেন বৃষ্টিও। পাখির কিচির মিচির গান গাওয়া, নদীর কলকল ছলছল ছুটে চলার ধ্বনি কবির মনকে আনন্দ দিয়েছে। নদীর কথা, বৃষ্টির কথা, পাখির কথা সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তার ছড়াকবিতায়। আষাঢ় মাসের মেঘ দেখে কবি বলেছেন-‘নীল নব গনে আষাঢ় গগনে/ তিল ঠাঁই আর নাহিরে/ ও গো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।’

তখন মনে হয়, কোনো চিরপরিচিত গ্রামের দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। তালগাছটা একটা মানুষ হয়ে একপায়ে দাঁড়িয়ে আছে। কখনো আবার তিনি হয়ে গেছেন মাঝি। বলেছেন-‘আমার যেতে ইচ্ছে করে/ নদীটির ওই পাড়ে/ যেথায় ধারে ধারে/ বাঁশের খুঁটায় ডিঙি নৌকা/ বাঁধা সারে সারে।’ (মাঝি)

ডাকঘর’ নাটকটি সবার কাছেই অনেক প্রিয়। অমল নামের ছোট্ট ছেলেটির ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার প্রত্যাশা সব শিশুর মনঃবাসনাকেই প্রকাশ করে। যখন দইওয়ালা বলে -‘দই ! দই ! দই নেবে দই।’ মনে হয়, আমাদের ঠিক পাশ দিয়ে যেন দইয়ের ডুগি নিয়ে ছুটে চলেছে কোনো লাল মাটির দেশের দইওয়ালা। ‘ছুটি’ গল্পের ফটিকের কথা যে একবার পড়ে সে আর তাকে ভুলতে পারে না। তার শেষ কথা– ‘মা, আমার ছুটি হয়েছে মা।’ তিনি শিশুদেরও কবি। আমাদের মাঝে চিরজাগরুক থাকবেন চিরকাল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসতত রবীন্দ্রনাথ
পরবর্তী নিবন্ধজিপিএইচ ইস্পাত ও এপিক হেলথ কেয়ারের সেবা চুক্তি