চিরঞ্জীব, চির ভাস্বর

জাহানারা ইমাম

সালমা বিনতে শফিক | শনিবার , ৩ জুলাই, ২০২১ at ৭:৪৮ পূর্বাহ্ণ

শহীদ জননী জাহানারা ইমামের (৩ মে, ১৯২৯ – ২৬জুন, ১৯৯৪) কলমের সঙ্গে পরিচয় তাঁর ‘একাত্তরের দিনগুলি’ দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনে ঘটে যাওয়া টুকরো-টুকরো মর্মন্তুদ ঘটনাবলী থেকে শুরু করে তাঁর ঘর গেরস্থালির তেল-নুনের কথাও প্রাণ দিয়ে লিখেছিলেন তিনি। তবে কৈশোরে পড়া বইটি যে-কারণে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছিল, তা হল লেখকের ব্যক্তিত্বের গভীরতা; কঠোর কর্তব্যপরায়ন, হেঁসেল থেকে রাজ্যপাট সামাল দেন নিজের সিদ্ধান্তে, নিজের বুদ্ধিতে। তাই বলে কাউকে অগ্রাহ্য বা উপেক্ষা করে নয়। পরিবার, সমাজ ও দেশের প্রতি গভীর মমতা ও দায়িত্ববোধ তাঁকে একজন মহান ‘জ্যোতির্ময়ী’র আসনে অধিষ্ঠিত করে। সত্যি বলতে কি, ‘একাত্তরের দিনগুলি’র প্রতিটি বাক্যই পাঠককে অভিভূত করার মতো। একজন মেয়ের আদর্শ, স্বপ্নের চরিত্র হতে পারেন আমৃত্যু হার-না মানা এই মানুষটি।
দুঃসময়ের দিনলিপিতে ঘরকন্যার যেসব খুঁটিনাটি তিনি তুলে ধরেছেন তা দেখে তাঁকে একজন দক্ষ গৃহ ব্যবস্থাপক বলাই চলে। তাছাড়া দিনে-রাতে ঘরে-বাইরে করার পর খাতা-কলমের সঙ্গে খুন্তি-কড়াই’র যে বিরোধ নেই তাও বেশ বোঝা যায় তাঁর দিনলিপি হতে। যত ব্যস্ততাই যাক, দিনশেষে তিনি একজন মমতাময়ী মা, সন্তানদের বন্ধু সমতুল্য এবং একজন আদর্শ বন্ধুপ্রতিম স্ত্রী। চলৎশক্তিহীন বয়োবৃদ্ধ শ্বশুরের শুস্রুসায় অনন্য তিনি। সামাজিক দায়দায়িত্বেও অগ্রণী। অতিথিপরায়ণতায় পারদর্শী। শিল্প, সাহিত্য, ক্রিড়া এমনকি বিশ্বসংগীত, বিশ্বরাজনীতি নিয়েও পুত্রদের সঙ্গে সমকক্ষীয় তর্ক-বিতর্ক চলে পারিবারিক আবহে। পরিবারের সদস্যদের মাঝে ধার্মিকতা অটুট থাকে পুরোমাত্রায়।
এই পরিবারের মানুষগুলোর চারিত্রিক দৃঢ়তা নিঃসন্দেহে অনুসরণীয়। বড় পুত্র রুমির ভেতরটা স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ। দেশ নিয়ে ভাবনায় একালের অনেক ছাত্রনেতার মতো দেশপ্রেমিক সাজার অযথা চেষ্টা নেই, কোন ভান নেই। একুশ শতকের তরুণ-তরুণী, যারা ডিজিটাল দুনিয়ার আধুনিক প্রজন্ম বলে দম্ভে ফেটে পড়ে, মাটিতে পা ফেলে না, আলো-হাওয়া গায়ে মাখে না, চাঁদ সূর্যের পানে চেয়েও দেখে না তাদের কাছে অনুরোধ- ‘একাত্তরের দিনগুলি’ পাঠ করে, এসো রুমির পাশে নিজেকে দাঁড় করিয়ে দেখি- অর্ধশতক পরে বিশ্বজগতকে ‘আপন হাতের মুঠোয় পুরে’ ফেলে ভাবনাচিন্তায়, কর্মোদ্দীপনায় আমরা রুমিকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছি কি না? রুমির চাইতে বেশী আধুনিক আমরা হতে পেরেছি কি?
ইংরেজি কম জানতোনা সে। জার্মান শিখছিল। কিন্তু বুকের ভেতর নিরন্তর রক্তাক্ত বর্ণমালা। ‘একেকটি বাংলা অক্ষর একেকটি বাঙালীর জীবন’ ু উৎকর্ণ পটুয়া কামরুল হাসানের তৈরি ছোট্ট স্টিকারটিকে এমন যুদ্ধদিনে গাড়ির কাঁচে সেঁটে দিয়ে বাংলার প্রতি তার অসীম মমতার প্রকাশ ঘটিয়েছে উনিশ বছরের টগবগে যুবক রুমি। শুধু তাই নয়, বিদেশী বই পড়ত সে। ভিনদেশি সংগীত ও চলচ্চিত্র পছন্দ করত। তাই বলে স্বকীয়তা বিলিয়ে দিয়ে নয়। বিশ্বের অন্যতম সেরা প্রতিষ্ঠানে পড়তে যাবার কথা ছিল কয়েকমাসের মধ্যে। কিন্তু মাতৃভূমিতে যুদ্ধ চলছে, স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছে সাড়ে সাত কোটি জনতা। অনেক নামজাদা বুদ্ধিজীবী সেই সময় নিজেদের ও সন্তানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যুদ্ধ থেকে গা বাঁচিয়ে পশ্চিমের কোন না কোন শহরে পালিয়ে গিয়েছিলেন এবং যুদ্ধ শেষে ফিরে এসে দিব্যি দেশপ্রেমিকের পোশাক পরে জাতীয় পর্যায়ে সমাদৃতও হয়েছিলেন। রুমি তাঁদের দলে ভেড়েনি। হানাদারের থাবায় অরক্ষিত দেশমাতাকে ফেলে নিজের জন্য নিরাপদ ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রচনায় মন সায় দেয়নি তার। তবে অনেক যুবকের মতো বাড়ি থেকে পালিয়ে নয়, মা-বাবা কে জানিয়ে তাঁদের সম্মতি নিয়েই যুদ্ধে যায় রুমি। কেমন মায়ের ছেলে, দেখতে হবে তো! বিত্তবান পরিবারের সন্তান হয়েও সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিশে যায় এক কাতারে। তাদের সঙ্গে ঘুমায়, খাবার ভাগাভাগি করে খায়। অবসরে বাড়ি এলে সব খুলে বলে মাকে।
গর্বে বুক ভরে যায় মায়ের। জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস না থাকা সত্ত্বেও পারিবারিক বন্ধু জ্যোতিষীর মিথ্যে আশ্বাসে ভর করে আশায় বুক বাঁধেন মা। মায়ের বুক খালি হতে সময় লাগে না। ঊনত্রিশ আগস্ট ধরে নিয়ে যাওয়া হয় রুমিকে। বাবা আর ছোট ভাইকে একই সঙ্গে নিয়ে গেলেও ওরা ফিরে আসে দুঃস্বপ্নের ঘোর কাটিয়ে। ফেরে না রুমি। আর তার ফেরা হয় না। কেউ জানেনা রুমি’র শেষ পরিণতির কথা। আজও না। রুমিকে বাঁচানোর তখন একটাই পথ ছিল- ‘মার্সি পিটিশন’- সরকারের কাছে প্রাণভিক্ষা করা। ‘চির উন্নত শির’ পুত্রের আদর্শের অবমাননা করার সাহস ইচ্ছে কোনটাই ছিলনা বাবা-মায়ের। শেষ আশ্রয় হিসেবে গৃহকর্মীর পরামর্শে ছুটে যান মা পাগলা পীরের আস্তানায়। গেল শতকের ষাটের দশকে মার্কিন সরকারের ফুলব্রাইট বৃত্তিপ্রাপ্ত বিদুষী সাহিত্যিক, জনপ্রিয় শিক্ষক, শিল্প-সংস্কৃতির ধারক ও বাহক, সেই একাত্তরে ঢাকার রাস্তায় গাড়ি হাঁকানো, সংসারের যাবতীয় কর্মকাণ্ড একা হাতে সামাল দেওয়া সাহসিকা নারী নিখোঁজ পুত্রের মঙ্গল কামনায় হুজুরের দরবারে গিয়ে দোয়া প্রার্থনা করেন! ঠিক এইখানে এসে দেশের আট-দশটা আটপৌরে নারীর মতো যুক্তি তর্ক সংস্কার ভুলে কেবলই একজন ‘পুত্রশোকে কাতর মা’ হয়ে যান জাহানারা ইমাম। তবে শোক তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সরবরাহ, পারাপার, অস্ত্র লুকিয়ে রাখা, খবর পৌঁছে দেওয়াসহ নানা সাহায্যে এগিয়ে আসেন তিনি ও তাঁর পুরো পরিবার।
তখনও তিনি জানেন না তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে আরও দুঃসময়, আরও কঠিন পরীক্ষা। শেষ আগস্টের পৈশাচিক নির্যাতনের চিহ্ন ও স্মৃতি নিয়ে ডিসেম্বর অবধি পাশে-পাশে ছিলেন জীবনসঙ্গী। বিজয়ের ঠিক আগে- আগে হারিয়ে যান তিনিও। তাঁর চলে যাবার তিনদিনের মাথায় শেষ হয় নয় মাসের জনযুদ্ধ। ভূমিষ্ঠ হয় নতুন বাংলাদেশ। উৎসবের আমেজ নগরে নগরে, গ্রামেগঞ্জে। কিন্তু জাহানারা ইমামের বাড়িতে উৎসব নেই, তাঁর যুদ্ধ শেষ হয় না। কিশোর পুত্রকে নিয়ে একা মায়ের সংগ্রাম, কর্কট রোগের সঙ্গে দশকের অধিককাল বসবাস তাঁকে ঘরের চার দেয়ালে আটকে রাখতে পারে না, দমিয়ে রাখতে পারে না লক্ষ্যে ছুটে যেতে।
একাত্তরে এই মাটিতে যারা নারী নির্যাতনসহ যাবতীয় পৈশাচিকতা প্রদর্শন করে বেঁচে গিয়েছিল তাদেরকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে আমৃত্যু লড়ে যান শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। তিনি বিশ্বাস করতেন তাদের বিচার করতে না পারলে নারী নির্যাতনের ধারা চলতেই থাকবে আর ‘সমাজ মানসিকতায় নারী নির্যাতন ক্রমান্বয়ে সহনীয় হয়ে উঠবে’। তাঁর মৃত্যুর সাতাশ বছর পর বাংলাদেশের আজকের সমাজচিত্র বলে দেয় নারী নির্যাতন কেবল সহনীয় নয়, স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে গণমানুষের মননে। কেবল প্রান্তিক কিংবা আর্থ-সামাজিক মইয়ের নিচের সিঁড়িতে অবস্থানরত নারীই নয়, উঁচুতলার উচ্চশিক্ষিত কর্মজীবী নারীও যখন নির্যাতিত হয়, শারীরিক কিংবা মানসিকভাবে নিগৃহীত হয়, তখন মনে হয় জাহানারা ইমাম, বেগম সুফিয়া কামাল, রিজিয়া রহমানদের পর আমরা একুশ শতকের মেয়েরা একচুলও এগোতে পারিনি, বরং পিছিয়ে পড়ছি দিনে দিনে, যদিও গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত নারীর ক্ষমতায়নের পথে ধাপে-ধাপে এগিয়ে যাওয়ার নানা স্মারক দৃশ্যমান। অস্বীকার করার উপায় নেই, স্বাধীনতা পরবর্তীকালে আমাদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের ঢল নেমেছে। কিন্তু শিক্ষার দর্শন, শক্তি ও সৌন্দর্যকে প্রাণে ধরতে পারছে ক’জন, তা খুঁজতে গেলে সব আয়োজন অন্তঃসারশূন্য বলেই মনে হয়।
জাহানারা ইমামরা বেগম রোকেয়ার পথে অনেকটা হেঁটেছিলেন। পরের প্রজন্মের জন্য ‘পায়ে পায়ে পথ কেটেছিলেন’ তাঁরা। পরাধীন দেশ, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন সমাজ তাঁদের চেতনায় কোন কালোছাপ রাখতে পারেনি। এ-যুগে আধুনিকতা নিয়ে আমাদের গরিমার শেষ নেই। রাশি রাশি অর্জনে ঝুলিভরা। তবে ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে কবর দিয়ে ফেলেছি আমরা অনেক আগেই। সমাজের জন্য, দেশের জন্য, আগামী প্রজন্মের জন্য একযোগে কাজ করার কথা আমরা তেমন করে ভাবি না। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী থেকে জাতীয় ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন, শিক্ষা, চিকিৎসা, আইন, ব্যবসায়, বিনোদন, ক্রীড়াজগত এককথায় শ্রমবাজারে নারীর সগর্ব উপস্থিতি সত্ত্বেও নারী নির্যাতনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ, আফ্রিকার যুদ্ধ কবলিত দু’তিনটি দেশের পর পরই। তাই ‘অনেক পেয়েছি’ বলে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার অবকাশ নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে স্বাধীন, আধুনিক ও ডিজিটাল বাংলাদেশে নারী আজও পণ্য বৈ কিছু নয়। সৌন্দর্য সাবান ও রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের বিজ্ঞাপন আমাদের মতো করে পশ্চিমের কোন দেশে নির্মিত হয় না।
জাহানারা ইমাম বিশ্বাস করতেন- আমাদের মেয়েরা রূপের শক্তিতে নয়, আত্মশক্তিতে বলিয়ান হয়ে আত্মপ্রত্যয়ী ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন হলে সমাজ তাদের মর্যাদা দেবে, সমীহ করবে। তার জন্য মেয়েদেরকেও মেয়েদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে। আগামী দিনের ‘নতুন মানুষদের জন্য নতুন সমাজ’ গড়ে তোলাই হোক আজ আমাদের প্রত্যয়। পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মীতা হোক আমাদের পাথেয়। এই চলার পথে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের জীবনচরিত আমাদের আলো দেখাবে, শক্তি ও সাহস যোগাবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ

পূর্ববর্তী নিবন্ধধরিত্রীর রজঃস্রাব উদযাপন বনাম নারীর মাসিক ট্যাবু
পরবর্তী নিবন্ধ১০ জনের দল নিয়ে চিলিকে হারিয়ে সেমিতে ব্রাজিল