চিচিংফাঁক

মোহছেনা ঝর্ণা | শুক্রবার , ২৩ জুন, ২০২৩ at ৯:২৫ পূর্বাহ্ণ

ভুলটা যে আমি কোন জায়গায় করেছিলাম সেটা খুঁজে বের করতেই অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল। একবার মনে হচ্ছিল পুরানো, রংচটা বিল্ডিংটার কারণেই হয়তো ভুলটা হয়েছিল। কিন্তু তার চালচলন কিংবা পোশাকআশাক দেখে ভুলটা হবার কথা ছিল না। খুবই সাধারণ অথচ কী আভিজাত্য! পূর্ণ স্নিগ্ধ একজন মানুষ। পরে মনে হলো টিউশনির কথা বলাতেই হয়তো ভুলটা করেছি। কি জানি কেন, টিউশনি শুনলে, টিউশনি করা মানুষদের টাকা ছাড়া আরও অনেক প্রয়োজন থাকতে পারে সে কথা মাথায় কাজ করে না। আবার মনে হলো নাকি পাঁচ তলায় থাকে বলাতেই আমার হিসাবে গন্ডগোল করে ফেলেছি। বারবার মনে পড়ছিল স্কুলবেলায় এরকম একটা বোকা বনে যাওয়ার গল্প পড়েছিলাম।

আমার কন্যা তো ঘরে ঢুকে বাকহত হয়ে গেছে। হতবাক যে আমিও কিছুটা হইনি তা নয়। কিন্তু বয়স হয়েছে বলে নিজেকে সামলে নিয়েছি। কন্যা নিজেকে সামলানোর চেষ্টা তো দূরের কথা বরং এমনভাবে তার চক্ষুকোটরগত বিস্ময় দেখিয়েছে যে লজ্জায় আমারই কাঁচুমাচু অবস্থা। তার উপর নিজের হাতের পলিথিনের ব্যাগটার কারণে ইচ্ছে করছিল ধরণী দ্বিধা হও।

ধরণী ধরণীর জায়গায় বহাল তবিয়তেই ছিল। আমি অস্বস্তি নিয়ে ড্রইং রুম বাদ দিয়ে ডাইনিং রুমেই জড়োসড়ো হয়ে বসলাম। কেউ একজন উপরের রুমের দরজা ধাক্কাচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল আমাকেই যেন ধাক্কাচ্ছে। মনে মনে নিজেকেই নিজে ভর্ৎসনা করে যাচ্ছিলাম আমি। আমার এসব অস্বস্তিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আমার কন্যা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল ওদের দেয়ালচিত্রের দিকে। সেখান থেকে চোখ সরিয়ে সিসি ক্যামেরার মনিটরের দিকেও তাকাচ্ছিল কিছুক্ষণ। তবে তার চোখ আটকে গেছে ঘরের ভেতরের চমৎকার কারুকার্যময় সিঁড়িটাতে এবং সিঁড়ির পাশের বাহারি বৃক্ষসমূহের দিকে। বড় একোরিয়ামের গোল্ড ফিশ, এঞ্জেল, গাপ্পি, সাকার ফিশের দিকেও মনোযোগ ছিল কিছুক্ষণ। যাই দেখছে তাই আমাদের বাসায় নেই কেন সেই আফসোস অচেনা এই পরিবেশে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কৌতূহলী মুখগুলোর সামনে প্রকাশ করতে দ্বিধা করছিল না।

ভদ্রমহিলা বৈকালিক ঘুম থেকে উঠে তার ডুপ্লেক্স বাড়ির দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাকে দেখতেই খুব আন্তরিক ভঙ্গিতে নিচে নেমে এসে আতিথিয়েতায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তার আতিথেয়তা দেখে ভেতরে ভেতরে আমি আরও বেশি কুঁকড়ে যাই। আমার মেয়েকে দেখে ওর বান্ধবী উর্বশী লাজুক হাসি দেয়। মেয়েটাকে এই বাড়ির বাচ্চার মতো লাগছে না। টাকাওয়ালা পরিবারের বাচ্চাগুলোকে দেখতে স্বাভাবিক বাচ্চাদের মতো লাগে না আমার কাছে। ফার্মের মুরগীর মতো মনে হয়। সেদিক থেকে এই বাচ্চাটা ব্যতিক্রম। উর্বশী এসে আমার কন্যার সাথে গল্প জুড়ে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের সঙ্গে যোগ দেয় উর্বশীর বড় বোন এবং স্মার্ট দাদি। কারও দাদি যে এত স্মার্ট হতে পারে আমার ধারণাতেই ছিল না।

দাদি মানেই আমার কাছে থুড়থুড়ে এক বুড়ি। যার যাবতীয় চিন্তাভাবনা এবং কথাবার্তা মৃত্যুকেন্দ্রিক। পরকাল কেন্দ্রিক। পুলসিরাত পার হতে পারবেন কিনা, মুনকিরনাকির ঠিকমতো সব লিখছে কিনা, জান্নাতুল বাকী নাকি জান্নাতুল ফেরদৌস নাকি জান্নাতুল মাওয়া কোনটাতে যে তার নসিব হয়, নাকি সব বাদ দিয়ে হাবিয়া দোজখেই পুড়ে মরতে হয় সেইসব পারলৌকিক চিন্তায় ডুবে থাকা মানুষ দেখলেই আমি বুঝে নেই তিনি কারো দাদি।

কিন্তু উর্বশীর দাদি এসে আমার সাথে ফেসবুক একাউন্ট নিয়ে কথা বলছিল। ইন্টারনেটে এমবি কিনে তিনি শান্তি পান না তাঁর নাতনিদ্বয়ের যন্ত্রণায়। তারা সারাক্ষণ ইউটিউব নিয়ে ব্যস্ত রাখে তার মোবাইল ফোনটি। বাপের আছে, মায়ের আছে, সেগুলো বাদ দিয়ে দাদিরটা নিয়ে টানাটানি, কারণ দাদিরটার স্ক্রিন বড় এবং দাদির মোবাইলে সবসময় এমবি থাকে। কিন্তু নাতনিদের প্যারার কারণে তাদের দাদাজান গতকালই মাত্র তাকে ৪৬ ইঞ্চির এলইডি টিভি কিনে তাতে ওয়াইফাই লাইন সেট করে দিয়েছেন।

আমি কোনোভাবেই স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। হাতের পলিথিনের ব্যাগটা তাদের ডাইনিং টেবিলে রাখার পর থেকে ইচ্ছে করছিল দৌড়ে পালিয়ে যাই। আর কেন যে এমন বেয়াক্কেলের মতো কাজ করলাম তা ভেবে নিজে নিজেই মরমে মরে যাচ্ছিলাম। উর্বশীর মা ভদ্রমহিলা আমার মরমে মরে যাওয়া বুঝতে পেরেছিলেন কি না কে জানে, তিনি আমাকে বললেন, ভাবি আপনি আসাতে আমার কি যে ভালো লাগছে! আপনি কিন্তু আমাদের বাসা দেখে অন্য কিছু ভাববেন না। আমরা খুবই সাধারণ! আমার মুখ ফসকে প্রায় বেরিয়ে যাচ্ছিল, আপনারা সাধারণ! তাহলে অসাধারণ কারা? কিন্তু না শেষ মুহূর্তে আমি নিজের মুখের লাগাম টেনে ধরতে পেরেছি।

উর্বশীর সঙ্গে কন্যা আমার কোন ফাঁকে হাওয়া হয়ে গেলো আমি তা টেরই পাইনি। এত বড় বাসা কোথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছে একেকজন! হঠাৎ আমার কন্যাই আমাকে হাত ধরে টানছিল ছাদে যাওয়ার জন্য। ওদের ছাদটাও নাকি বেশ সুন্দর।

ছাদে গিয়ে তো আমার মাথা ঘুরে যাওয়ার অবস্থা! এত সুন্দর! ফুল,ফল, নানা রকম গাছগাছালিতে ঠাসা! মাচা তৈরি করে শাকসবজি করেছে। সেই মাচার নিচে লাউ ঝুলছে। ছাদের একপাশে দেখি বালুর মাঠ। বাচ্চাদের খেলার জন্য, মাটির সান্নিধ্যে থাকার জন্য এই ব্যবস্থা। সবাই বসে আড্ডা দেওয়ার জন্য একটা কর্ণার। সেখানে আবার বইয়ের একটা তাক। তার পাশে মাদুর, গান বাজনার ব্যবস্থা, হারমোনিয়ামও আছে।

এই ঘরে ঢুকে আমার কন্যা যেমন তার বিস্ময় লুকাতে পারেনি, ছাদটা দেখে আমিও বিস্ময় লুকাতে পারিনি। আমি আমার কন্যা, উর্বশী আর উর্বশীর দাদি সঙ্গে ঘুরে ঘুরে ছাদের গাছপালা দেখার সময় শুনি নিচে খুব হৈচৈ হচ্ছে। উর্বশীর দাদি দৌড়ে গেলেন, আমিও পিছু পিছু নামছিলাম, সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই দেখি কেউ একজন চিৎপটাং হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। উর্বশীর মা তাকে হাত ধরে টেনে তুলতে চাচ্ছিলেন কিন্তু ভদ্রলোক ব্যথা পাওয়ার চেয়েও পা পিছলে পড়ে যাওয়ার ক্রোধে নিজের হাত ছাড়াতে গিয়ে এমন হ্যাঁচকা টান দিলেন যে উর্বশীর মা নিজেই হুমড়ি খেয়ে পড়লেন ভদ্রলোকের গায়ের উপর।

উর্বশীর বোন আরশি নাকি পানির ফ্লাস্ক খুলতে গিয়ে পানি ফেলে রেখেছে মেঝেতে। কিন্তু চমৎকার ডিজাইনের টাইলসের কারণে সে পানি চোখে পড়েনি কারো। আর এখন বাসা থেকে বের হওয়ার মুহূর্তে উর্বশীর বাবা সে পানিতেই পিছলে মেঝেতে পড়ে আছেন।

সিঁড়িতে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে নিজের কন্যার উপর রাগে ফুঁসছিলাম আমি। কারণ ওর চাপাচাপির কারণেই এবাসায় এসেছি আমি। আসার পর থেকেই বিড়ম্বনার শেষ নেই আমার। কিন্তু আমার কন্যারত্নকে কে বোঝাবে এ কথা!

পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হতেই আমি চলে আসতে চাইলে আমার কন্যা বলে উঠে সে আসবে না। সে আরও অনেক্ষণ থাকবে উর্বশীর সঙ্গে। উর্বশীও তাকে ছাড়ছে না। আর তখনই ভদ্রমহিলা টেবিলে রাখা পলিথিনটার দিকে হাত দিলেন। মনে মনে জপছিলাম আমি, “শেষ রক্ষাটা করো মাবুদ। শেষ রক্ষাটা করো”। পলিথিন খুললেই চিপসের ক্যাটক্যাটে প্যাকেট এবং ললিপপ চকলেটগুলো কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে।

বাসায় ইলেক্ট্রিসিটির প্রিপেইড মিটারের কার্ড শেষ হয়ে গিয়েছিল হঠাৎ। প্রিপেইড কার্ড কিনতে গিয়ে রাস্তার মাথার দোকানে আসতে গিয়ে বিল্ডিংটার দিকে চোখ পড়ায় কন্যাকে বলেছিলাম সম্ভবত এটা তোমার ফ্রেন্ড উর্বশীদের বাসা। সেই বলাতেই কাল হলো আমার! গলির দোকান থেকে কেনার মতো তেমন কিছু ছিল না। তাই কন্যার জন্য চিপস কেনার কথা ভেবে ওর বন্ধুর জন্যও কয়েকটা নিলাম। সঙ্গে কিছু মামা ওয়েফার আর ললিপপ। কিন্তু ভদ্রমহিলার বাসায় ঢোকার পর থেকেই মনে হচ্ছিল ভুল হয়ে গেছে আমার। বড্ড বড় ভুল হয়ে গেছে।

এত বড় ঘরের মানুষ এরা, অথচ নিরহংকারী! দেখে তো বিভ্রম হবেই। আবার আমাকেই উর্বশীর মা বলেছিল ইংলিশ মিডিয়ামের কোনো বাচ্চাকে পড়াতে হলে যেন তাকে বলি। তিনি বাসায় ব্যাচে স্টুডেন্ট পড়ান। আগে স্কুলে পড়াতেন। কিন্তু এখন ছোট বাচ্চাটা হওয়ার পর থেকে আর সময় করতে পারছেন না। টিউশনির কথা বলাতেই কি আমি বিভ্রান্ত হয়েছিলাম! আবার বলেছেন যে বাসায় থাকেন, সেখানে পাঁচ তলায় থাকেন। এখন পর্যন্ত কোনো বাড়িওয়ালাকে নিজ বিল্ডিং এর পাঁচ তলায় থাকতে দেখিনি আমি। সিঁড়ি বেয়ে কোনো বাড়িওয়ালা পাঁচতলায় উঠবে ভাবাই যায় না। তার উপর বিল্ডিংটা যদি হয় পুরনো, জরাজীর্ণ তাহলে তো আর কথাই নেই। কিন্তু রংচটা বিল্ডিংয়ের ভেতরে পাঁচ তলায় যে এরকম প্রাসাদ করে থাকা যায় তা তো আমার মতো আহম্মকের বোঝার কথা না। মাথামোটা মানুষের চিন্তাও মাটা মোটা হয়। আমার আবার মাথা মোটার পাশাপাশি শরীরও মোটা।

উর্বশীদের ড্রইংরুমে জোর করে নিয়ে বসালেন ওর মা। ড্রইংরুমের সোফাগুলো এত দামি বসতে খুব সংকোচ হচ্ছিল। কী যে হয় ইদানীং প্রয়োজনের তুলনায় উচ্চ মাত্রার বাহুল্য দেখলেই কেমন অস্বস্তি লাগে। কিছুতেই স্বাভাবিক থাকতে পারি না। চেহারায় সেই অস্বস্তির ছাপটা লুকানো যায় না। ড্রইংরুমের ঝাড়বাতির দিকে চোখ পড়ে যায়। আলোর কী বাহার! আমার দিকে তাকিয়ে উর্বশীর মা মিষ্টি করে হেসে বললেন, ভাবি, আপনি আমার বাসায় এসেছেন, আমার খুব খুশি লাগছে!

আমি অবশ্য বুঝতে পারছিলাম না আমাকে দেখে এত খুশি হওয়ার কী আছে! আমার ইচ্ছে করছিল দৌড়ে পালিয়ে যাই। এরকম অস্বস্তিকর পরিবেশের কথা চিন্তা করে আমি আমার গন্ডির বাইরে কোথাও যেতে চাই না সাধারণত, আর বেছে বেছে কিনা আমার মতো নালায়েক বান্দার সাথেই খোদার এই রসিকতা!

উর্বশীর মার সাথে কথা বলতে বলতে বেশ কিছুক্ষণ সময় চলে গেলো। আমার কন্যার তখনো বাসায় ফেরার নাম নেই। সে আমাকে বললো, তাহলে তুমি চলে যাও। আমি উর্বশীদের বাসায় থাকবো। কন্যার কথা শুনে আমার থতমত খাওয়ার অবস্থা। সুন্দর বাসার জন্য কন্যা আমাকে ত্যাগ করতে চাচ্ছে! সর্বনাশ! এই বাসায় আরও কিছুক্ষণ থাকলে কন্যা হয়তো আমি যে তার গর্ভধারিনী মা, তা ই অস্বীকার করে বসবে! আমি আর ঝুঁকি নিতে চাইলাম না।

অনেক জোরাজুরি করে ঘন্টা দুয়েক সময় পরে কন্যাকে নিয়ে উর্বশীদের বাসা থেকে বেরিয়ে দেখি আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছে। আমার স্পষ্ট মনে আছে আমরা সিঁড়ি বেয়েই পাঁচতলায় উঠেছিলাম। দু’ঘন্টার অতি চমকে স্মৃতি বিভ্রাট হলো কী না বুঝতে পারছি না। কারণ নামার সময় ‘খুল যা সিমসিম’ এর মতো দেখি সুড়ঙ্গ বেষ্টিত লিফট! আমার কন্যা তো লিফট দেখে আরেক দফা আহ্লাদিত। কারণ তাকে হেঁটে নামতে হবে না। নিজের পায়ের এমন আরাম চিন্তা করেই কিনা সে লিফটের মধ্যেই ঘ্যানঘ্যান করছিল, ‘মা, আবার কখন আসবো উর্বশীদের বাসায়। বলো না। এ্যাঁ, এ্যাঁ…’

কন্যার দিকে চোখ মুখ কটমট করে তাকাতেই দেখি ‘খুল যা সিমসিম’ মাটি স্পর্শ করলো। আর তাতে করে আমার প্রাণে যেন হালকা বাতাস লাগলো। কন্যার হাত ধরে লিফট থেকে নেমে উর্বশীদের বিল্ডিংয়ের সীমানা পেরিয়ে লম্বা একটা দম নিলাম আমি।

mzharma@yahoo.com

পূর্ববর্তী নিবন্ধডিসিএল ব্লক ফ্যাক্টরি পরিদর্শনে চসিক মেয়র
পরবর্তী নিবন্ধলালনের নদীতে ভাসা মানুষ