চা বাগানের কড়চা

বাবর আলী | সোমবার , ২২ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৯:১৯ পূর্বাহ্ণ

পর্ব

সারবন্দি রবার বাগানের ভেতর দিয়ে হালকা আলোআঁধারিময় পথ। ঈষদুচ্চ একটা উপগিরির পথ ধরে উঠছি। কোনো গন্তব্য অবশ্য নেই। হাঁটতে ভালো লাগছে দেখেই হাঁটা। পায়ের নিচে শক্ত কীসের খোলক যেন ঠাসঠাস শব্দে ক্রমাগত ফাটছে। শারাফাত ভাই জানালেন রবারের ফলের খোসা ওগুলো। বহিরাবরণটা বেশ শক্ত। গোটা টিলাজুড়েই এই ফলের রাজত্ব। এই জায়গার নাম রবার বাগান। যদিও চা শ্রমিকেরা বলেন লিচু টিলা। খানিক বাদেই নামকরণের সার্থকতার ব্যাপারটা দৃষ্টিগোচর হলো। রবার বাগানের ঢালে অতিকায় এক লিচু গাছের মুখোমুখি হলাম। লিচু গাছের আকার বটপাকুড়ের ন্যায় এমন মহিরুহ ধাঁচের হতে পারে, এই গাছ না দেখলে বিশ্বাস করাই দুষ্কর। এর বয়সের কোনো গাছপাথর নেই। এমন অতিকায় বৃক্ষ দেখে প্রথমেই মাথায় প্রশ্ন এলো, এতে ফল ধরে কি না। অবশ্য উত্তর শুনে হতাশ হতে হলো। এই বৃক্ষ ফলদায়ী নয়। আরও বেশ খানিকক্ষণ ইতিউতি হাঁটাহাঁটি করে ফেরার পথ ধরি আমরা। তিনজন চেপে বসি অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের প্রাগৈতিহাসিক মোটরসাইকেলে। অতি প্রাচীন হলেও চা বাগানে চলার দারুণ উপযোগী মোটরবাইকটি। আমাদের গন্তব্য অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের বাংলো।

চা বাগানের মাটির রাস্তার কাদা ঠেলে কয়েকটা বাঁক পেরোতেই টিলার উপর বাংলোর সাদা আবয়ব দেখা গেল। চারপাশে চা বাগানের সবুজাভ সমুদ্রের মাঝে দ্বীপের মতো মাথা উঁচিয়ে আছে ব্রিটিশ আমলের দালানটি। মাঠ থেকে একটা ঢাল বেয়ে উঠতেই বাংলোর লাল ফটক। সামনের সবুজ লনটার শেষ মাথায় গ্যারেজ। ডানেবামে হরেক রকমের ফুল। প্রথম দেখাতেই মুগ্ধ হতে হয়। ছাতিম, টগর, জবা, রঙ্গন, নয়নতারা, কসমস, গাঁদাসহ নানান প্রজাতির পুষ্পশোভিত আঙিনা। চেনা সব ফুল গাছের পাশাপাশি কিছু অচেনা ফুলও আছে। নিয়মিত যত্নআত্তি পায় ফুলগাছগুলো। শারাফাত ভাই জানালেন, মালী খুবই আন্তরিকতার সাথেই কাজ করে। তার সেই হৃদ্যতার ছোঁয়া বাগানজুড়ে। সিঁড়ির কয়েকটা নিচু ধাপ পেরিয়ে উঠে গেলাম বাংলোর বারান্দায়। এই চা বাগানের শুরুর অংশে বাংলোর অবস্থান। যদিও আমরা পেছন থেকে খানিকটা ঘুরে প্রবেশ করেছি। শারাফাত ভাইয়ের পোস্টিং এর স্থল যে সিলেট থেকে এত কাছে সেটা জানা ছিল না। তাহলে বেশ আগেই আসা যেত এখানে। মুন্সি বাজার নামে জমজমাট এক বাজারের কাছেই এই চা বাগানের অবস্থান। বাংলোর চৌদিক খোলা বারান্দাটা দারুণ। চারপাশে চারটে পিলার আর পাশ ঘেঁষে বাহারি সব ফুলগাছ। চারটে বেতের চেয়ার, সামনের বড়ো টেবিলটা ছাড়াও প্রতিটা চেয়ারের সাথে ছোটো একটা করে টি টেবিল। বেয়ারা ওই টেবিলেই সবার জন্য এক গ্লাস ঠান্ডা পানি রেখে গেল। সত্যজিৎ রায়ের গল্পগুলোর মতোই চা বাগানে এখনো ভৃত্যস্থানীয় বেয়ারা, বাবুর্চি, মালীদের দেখা মেলে। ঔপনিবেশিক সময় থেকেই এখানের আবহ এমন। সেটা অবশ্য এই লেখার বিষয়বস্তু নয়। চা শ্রমিকদের দিক থেকে জীবনটাকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। এবার চা বাগানের উপরতলার বাসিন্দাদের দিক থেকে দেখার সুযোগটা ছাড়তে চাইনি।

এই চা বাগানের যখন পত্তন, তখনো ব্রিটিশ সিংহের দাঁত পড়ে যায়নি। দোর্দণ্ডপ্রতাপে ওরা তখন শাসন করছে দুনিয়া। তবে এই বাংলোটা অত পুরনো নয়; সমসাময়িক কালের। বছর দশেকের মতো বয়েস এর। অবশ্য অর্ধ শতাব্দী পুরনো বাংলোও আছে এই বাগানে। ম্যানেজার বাংলোতে ব্রিটিশ আমলে তৈরি ফায়ার প্লেস নাকি এখনো বহাল তবিয়তেই আছে। শারাফাত ভাইয়ের বাংলোর ঠিক পেছনেই জপমালা রানির গির্জা। চা শ্রমিকদের একট অংশ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। অবশ্য আমরা যেদিন চা বাগানের আতিথেয়তা নিয়েছি, ওইদিনই বিশ্বের অন্য প্রান্তে আরেক রানির মহাপ্রয়াণ হয়েছে। রানি এলিজাবেথ সিংহাসন ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন ঊর্ধ্বলোকে।

চা বাগান এক অন্যলোক। বাগানের বাইরের জগত থেকে অনেকাংশেই ভিন্ন। এখানে জনসংখ্যার দিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলো শ্রমিকেরা। তারা পাতা তোলে, কারখানায় কাজ করে, বাগানের নানান উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে গতর খাটায়। শ্রমিকদের কাজ তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ন্যস্ত সর্দারদের উপর। চা শ্রমিকদের মধ্য থেকেই এদের নির্বাচন করা হয়। এর উপরের স্তরে আছে বাবু। চা পাতার ওজন করার গুরুভার এদের কাঁধে। এদের উপরে আছে সাহেব তথা অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার। আয়তনভেদে একেকটা বাগানে কয়েকজন অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার থাকে। অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজারদের আবার ভিন্ন ভিন্ন নাম আছে। কেউ মিস্ত্রি সাহেব আবার কেউবা টিলা সাহেব। ব্যাপারটা একটু খোলাসা করি। বাগানে সাধারণত দুইটা ডিভিশন থাকে। কারখানা তথা ফ্যাক্টরি আর টিলা। ফ্যাক্টরির সাহেবকে চা শ্রমিকেরা বলে ‘মিস্ত্রি সাহেব’। আর ‘টিলা সাহেব’ বলে সম্বোধিত করা হয় বাগানের দায়িত্বরত সাহেবকে। আর সবার মাথার উপরে থাকেন বড়ো সাহেব তথা চা বাগানের ম্যানেজার। একই সাথে কাজ করলেও কিছু ব্যাপারে অলিখিত নিয়ম আছে। সেই আবহমান কাল থেকেই এসব নিয়ম তেমনই আছে। বাবুরা কখনো সাহেবের বাড়ি আসে না। বাবুদের বাড়ির চৌকাঠ মাড়ায় না সাহেবরাও।

চা পাতার ফার্স্ট প্লাক তথা প্রথম উত্তোলন নিয়ে আমার বেশ আগ্রহ ছিল। ফার্স্ট প্লাক হয় মার্চ মাস থেকে মে মাসের মাঝামাঝি অবধি। চা বাগানের অফ সিজন বলা হয়ে থাকে শীত মৌসুমকে। শীতের আপাত বিরতির পরে এই সময়ে উত্তোলন করা চা পাতা খুব উৎকৃষ্ট মানের হয়ে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই এর দামও বেশি। আগে শুনতাম এই ফার্স্ট প্লাকের পুরোটাই নাকি রপ্তানি হয়। শারাফাত ভাই জানালেন ঘটনা পুরোপুরি সত্য নয়। সিলেট অঞ্চলে যত চা উৎপাদিত হয়, তার সবটাই চলে যায় চট্টগ্রামে। সেখানে নিলামে বিক্রি হয় চা পাতা। এই দেশের চা বাগানের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত মূলত কয়েকটি কোম্পানি। জেমস ফিনলে, ইস্পাহানি আর ডানকান ব্রাদার্স এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য। আমরা এসেছি ডানকান ব্রাদার্সের বাগানে। মৌলভীবাজার ছাড়াও হবিগঞ্জে এদের বাগান আছে। এসব চা বাগানে মূলত আসত নিম্নমধ্যবিত্ত ব্রিটিশরা। ঠান্ডার দেশ ছেড়ে এই টিলাময় বাঘসিংহের দেশে জীবিকার তাগিদে আসাটাও কম চ্যালেঞ্জিং ছিল না। এর তখন তো এখনের মতো অবকাঠামোও ছিল না। রাস্তাঘাটের চিন্তা তো দূরঅস্ত। তখনকার যুগের সাহেবরা টিলা থেকে টিলায় যেতেন ঘোড়ায় চড়ে। এখন অবশ্য সাহেবরা মোটরসাইকেলে চড়েন। সে যুগের ইংরেজদের সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ সম্ভবত ছিল এই অঞ্চলের রোগবালাই। কলেরাম্যালেরিয়ার সাথে স্থানীয় অধিবাসীদের মতো যুঝতে না পেরে অশালমৃত্যু হয়েছে অনেকের। তারই স্মারক হিসেবে ইংরেজ টিপ্ল্যান্টারদের কয়েকটা সিমেট্রি তথা কবরখানাও আছে এই অঞ্চলে। যথারীতি দারুণ সুবিন্যস্ত।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ – এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধপানামা ক্যানাল