চলো মন শান্তি নিকেতন

করবী চৌধুরী | বৃহস্পতিবার , ২৯ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৪:২৮ পূর্বাহ্ণ

কবিগুরুর শান্তি নিকেতন, সত্যিকারভাবে শান্তিরই নিকেতন! ছায়ায় ঢাকা, মায়ায় জড়ানো, সকল প্রকার দূষণমুক্ত প্রকৃতির অপরূপ লীলাভূমি বোলপুরের রবীন্দ্রতীর্থ এই শান্তিনিকেতন। এর পথে পথেই সোনা ছড়ানো। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সোনা।

১৮৬৩ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বোলপুর শহরের উত্তর পশ্চিমাংশে নিভৃতে ঈশ্বরচিন্তা ও ধর্মালোচনার জন্য ষোলো আনা দিয়ে কুড়ি বিঘা জমি ভুবনডাঙার জমিদারের কাছ থেকে পাট্টা নিয়ে এক আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। নাম দেন শান্তিনিকেতন। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ এখানে এক ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন যা কালক্রমে বিশ্বভারতী বিদ্যালয়ে রূপ নেয়।

১৯১৮ সালে রবীন্দ্রাথ ঠাকুর বিশ্বভারতীর ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। পরবর্তীতে ১৯২১ সালে কবিগুরুর উপস্থিতিতে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল তার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন।

বহু মনীষীর পদধূলিতে ধন্য সকল বাঙালির তীর্থক্ষেত্র এই বিশ্বভারতী প্রাঙ্গণ। যদিও শান্তিনিকেতন ভ্রমণ এখন অনেকটাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতোই! কারণ এখানকার মূল আকর্ষণ বিশ্বভারতী প্রাঙ্গণে প্রবেশ নিষেধ। পৌষমেলা, বসন্ত উৎসব, সর্বোপরি রবীন্দ্রতীর্থ বিশ্বভারতীর দরজা যদি দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধই হয়ে যায় তাহলে শান্তিনিকেতন তার আভিজাত্য, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে সাথে তার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসও হারাবে।

তবে একথা সত্য যে, কবিগুরুর শান্তিনিকেতন কাউকে খালি হাতে ফেরায় না। অনেককিছু বন্ধ থাকার পরেও দেখার যা কিছু আছে তাতেই মনটা পরিতৃপ্ত হয়। আছে কবির রাঙামাটির পথ মাড়িয়ে দুপাশ জুড়ে গভীর শালবন, আড়াইশো বছরের পুরনো সুরুল রাজবাড়ি, আছে আমার কুটির‘, যেটা ১৯২৩ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামী সুষেন মুখার্জি গ্রামীণ হস্তশিল্প বিকাশের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শোলা, পিতল, রড, আয়রন, বাঁশ, চামড়া, সুতা দিয়ে তৈরি বিভিন্ন জিনিসপাতি এখানে বিক্রির উদ্দেশ্য প্রদর্শিত হয়। আর ‘সৃজনী শিল্প’ এর কথা বলতে গেলে শুধু একটা কথাই বলতে হয়, এটি না দেখলে বোলপুর শান্তি নিকেতন ভ্রমণটাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

পূর্ব ও উত্তর পূর্ব ভারতের নানান রাজ্যের মানুষের শিল্পসংস্কৃতি আর দৈনন্দিন জীবনধারা রূপকের মাধ্যমে কি অপূর্বভাবে চিত্রায়িত হয়েছে! মাটিখড়বাঁশ দিয়ে তৈরি ঘরগুলোতে, সেখানকার দেওয়ালে রংবেরং এর নকশাচিত্র ও আলপনার মধ্য দিয়ে বেশ রঙিন করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

আর শান্তিনিকেতনের মূল আকর্ষণ বিশ্বভারতী দর্শনের কথা বলতে গেলে বলতে হয়, সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য এর দ্বার বন্ধ থাকলেও পাঁচিলের বাইরে থেকে যতটুকু দেখা যায়, অন্তরের অনুভবে তাতেই মন ভরে যায়।

প্রথমেই আপনাদের নিয়ে যাই আশ্রমের সবচেয়ে পুরনো দালানবাড়িটাতে যা শান্তিনিকেতন ভবন নামে পরিচিত।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬৪ সালে এটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। বিশ্বভারতীর পাঁচিলের ওপারে দেখা যায়, বাড়িটির উপরিভাগে লেখা আছে, মহর্ষির প্রিয় উপনিষদের উক্তি – ‘সত্যাত্ম প্রাণারামং মন আনন্দং’।

কৈশোরে পিতার সাথে হিমালয় যাওয়ার পথে রবীন্দ্রনাথ এখানে কিছুদিন বাস করেন। বাড়িটির সামনে এক বিমূর্ত ভাস্কর্য রয়েছে। প্রাচীরের ওপারের আরেক আকর্ষণ হলো, নান্দনিক নকশাঘেরা, রঙিন বেলজিয়ামের কাচের তৈরি এক ঝলমলে গৃহ যা উপাসনা গৃহ বা ব্রাহ্মমন্দির হিসেবে পরিচিত। অবশ্য সাধারণ জনগণ একে ‘কাচঘর’ নামেই ডাকে। এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ভাই দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তখন থেকেই ব্রাহ্ম সমাজের প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে প্রতি বুধবার সকালে এখানে উপাসনা হয়। সাদা পোশাকে যে কেউই এখানে উপাসনা করতে পারে। ‘তালধ্বজ’ একটি তালগাছকে কেন্দ্র করে গোলাকার এক অনন্যসুন্দর মাটির বাড়ি। গাছটার পাতাগুলো ধ্বজার মত করে বাড়িটার উপর শোভিত হচ্ছে বলে এর নামকরণ হয়েছে ‘তালধ্বজ’ নামে। প্রকৃতিকে সংরক্ষণ করে বাড়ি নির্মাণের শিক্ষা দিচ্ছে এটি।

শান্তিনিকেতন আশ্রমের সৌন্দর্যকে এক অনন্যমাত্রা দান করেছে এই ‘তালধ্বজ’।

বিশ্বভারতীর দক্ষিণদিকের গেটে লেখা আছে, ‘তিনি আমার প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি’। দুটো ছাতিম গাছকে নিয়েই বলা এই কথামালা, যা পরিচিত বিখ্যাত ‘ছাতিমতলা’ হিসেবে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন রায়পুরের জমিদার বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে আসছিলেন তখন এই দুটো ছাতিম গাছের নিচে বসে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম করেন এবং এতে আরাম, আনন্দ ও শান্তি পান। অবশ্য সেকালের সেই ছাতিম গাছ দুটো মরে গেছে। তার জায়গায় অন্য দুটি ছাতিম গাছ সেখানে রোপণ করা হয়। পাঁচিলের একটুখানি ভেতরেই চোখে পড়ে, সেই বিখ্যাত ঝুরিওয়ালা বটগাছটা, যেটা কবিগুরু পিতার বিশ্রামের জন্য স্বহস্তে রোপণ করেছিলেন। নিজেও সময়েঅসময়ে এই গাছের তলে বসে রাস্তার মানুষের আসাযাওয়া উপভোগ করতেন। অনেক শিশুতোষ কবিতাও তিনি রচনা করেছিলেন এখানে বসে। শান্তিনিকেতন আশ্রমের উত্তরদিকে অবস্থিত একটি এলাকাকে বলে উত্তরায়ণ । ‘কোনার্ক’ ‘উদয়ন’ ‘শ্যামলী’ ‘পুনশ্চ’ ও ‘উদীচী’, মূলত এই পাঁচটি বাড়ি নিয়ে গড়ে উঠেছে এই উত্তরায়ণ প্রাঙ্গণ। এছাড়াও রয়েছে চিত্রভানু গুহাঘর ও বিচিত্রা বাড়ি। সর্বসাধারণের জন্য বন্ধই আছে সব। জ্ঞানালয় হিসেবে উপভোগ করতেই হবে ‘রবীন্দ্র ভবন’ নামে মিউজিয়ামটা, যা দর্শনার্থীদের জন্য খোলাই রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুবিশাল সংগ্রহশালা এটি। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি, চিঠিপত্র, নোবেল পদক ( প্রতিরূপ রয়েছে। আসলটা চুরি গেছে।) কবিগুরুর নিজের হাতে বিভিন্ন আঁকা ছবি, ঠাকুরবাড়ির বিভিন্ন ব্যবহৃত সামগ্রী, কবির নিজের বিভিন্ন ফটোগ্রাফ সহ বিভিন্ন কিছু। এরপর দেখার আছে কলাভবন আর সঙ্গীতভবনের মাঝখানে অবস্থিত কালো রঙের এক বাড়ি যা সর্বসাধারণের কাছে ‘কালোবাড়ি’ নামেই সমধিক পরিচিত। এখানে একসময় কলাভবনের বিভিন্ন ক্লাস হতো। নন্দলাল বসু আর রামকিঙ্কর বেইজের যৌথ উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল মাটি আর আলকাতরা দিয়ে গড়া এই কালো বাড়িটা, যা তৈরি করতে সময় লেগেছিল সাত বছর। বাড়ির সামনে রামকিঙ্কর বেইজের তৈরি অসামান্য কীর্তি ‘সাঁওতাল সাঁওতালনী’ স্থাপত্য কীর্তিটাকে দেখার পাশাপাশি দারুণভাবে উপভোগ্য।

রামকিঙ্কর বেইজের স্থাপত্যগুলো সব অমসৃণ, এক বিশেষ নিয়মে নির্মিত। তিনি নাকি ছোটবড় বিভিন্ন আকারের পাথরের টুকরো দূর থেকে ছুঁড়ে মেরে মেরে স্থাপত্যগুলো নির্মাণ করতেন। ব্যবহার করতেন না কোনও ক্যামিকেল রঙ। লতাপাতা আর পাথর ঘষে নিয়েই রঙ তৈরি করতেন এই ক্ষ্যাপা ভাস্কর। আলোচনায় সোনাঝুরি হাটের কথা বাদ গেলে এই প্রবন্ধ অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। শান্তিনিকেতনের অদূরে আকাশযনি আর শালের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে কুলুকুলু শব্দে আপনগতিতে বয়ে চলেছে বিখ্যাত কোপাই নদী। এই কোপাইয়ের তীরেই বসে খোয়াই হাট বা সোনাঝুরি হাট। প্রতি শনিবারে বসে বলে এর অপর নাম ‘শনিবারের হাট ’। সোনাঝুরি হাটে কোনও স্থায়ী দোকান নেই। মাটিতে ত্রিপল, চট বা শালপাতা বিছিয়ে বিভিন্ন রকমের পশরা সাজিয়ে বসে আশেপাশের গ্রামের প্রান্তিক উৎপাদকেরা। আর ক্রেতা বলতে প্রায় সবাই পর্যটক।

মূলত হাতের কাজের শাড়ি, চাদর, ছেলেমেয়েদের নৈমিত্তিক পোশাক, বাঁশ, বেতচামড়াসুতোচিনেমাটি দিয়ে তৈরি বিভিন্ন দ্রব্য, চুড়িমালা প্রভৃতি সহ হরেকরকম সামগ্রীর বেচাকেনা চলে এখানে। সাথে চলে একতারা হাতে বাউলের গান, ঢোলকরতাল আর মাদলের সাথে বৈচিত্র্যময় পোশাকে সাঁওতাল নৃত্য। এই প্রবন্ধের শেষটা টেনে দিই স্টেশন সংলগ্ন ‘গীতাঞ্জলি মিউজিয়াম’ টির বিবরণ দিয়ে। সত্যি বলতে কি, দোতলা এই মিউজিয়ামটা দেখার পর অবরূদ্ধ বিশ্বভারতীকে অসম্পূর্ণ ভাবে দেখার যে আক্ষেপ, তার অনেকটা মিটে যাবেই! উত্তরায়ণের ‘উদয়ন’ গৃহটির আদলে এটিকে তৈরি করা হয়েছে। মিউজিয়ামের একতলায় অসুস্থ কবি ১৯৪১ সালের জুলাই মাসে রেলের যে সেলুন কারটি করে চিকিৎসার জন্য শেষবারের মতো শান্তিনিকেতন থেকে কোলকাতা রওনা হয়েছিলেন রেল কতৃপক্ষ সম্মান প্রদর্শনের জন্য সেটিকে অবিকল সেই অবস্থায় সযত্নে রেখে দিয়েছে। কবি ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট মারা যান। সেলুন কারের মধ্যে কবির ব্যবহৃত বিছানাসহ ব্যবহৃত অন্যান্য সামগ্রী দেখলে মনে এক অদ্ভুত শিহরণ ও বিষন্নতার সঞ্চার হয়। ‘সন্ধ্যাসঙ্গীত’ এর সব গানগুলো গীটারের মিহি সুরে বাজতে থাকে এখানে। এছাড়াও একতলায় আছে কবির নানা সময়ের নানা ভঙ্গিমায় ৩৫ টা সাদাকালো ছবি। তাঁর বিভিন্ন লেখার পাণ্ডুলিপির ছবি।

দোতলায় রয়েছে কবি ও তাঁর সঙ্গীদের ১৫৩ টা দুষ্প্রাপ্য ছবি, আশ্রমের প্রথম ব্যাচের শিক্ষকদের সব ছবি। আরো আছে কবির বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের সময় যে সকল বিদগ্ধজনদের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল, তাঁদের সব ছবি। দেখার সময় সবার মনটা অনন্য এক আবেশে আপ্লুত হয়ে যাবেই!

প্রাণের শান্তির, প্রাণের আরামের, প্রাণের আবেগের কবিগুরুর শান্তিনিকেতন…. যতবারই তাঁর স্মৃতির কাছে যাওয়া হোক না কেন, মনের তিয়াস আর মিটবে না কখনোই রবীন্দ্রপ্রেমীদের! এই দুর্নিবার হাতছানি থেকে তাদের কখনোই মুক্তি নেই!

লেখক : প্রাবন্ধিক, গল্পকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমার বাংলাদেশ
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজকাল