কাল আজকাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ২৯ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৪:২৮ পূর্বাহ্ণ

অর্থের কাছে পিতার লাশও অর্থহীন

চল্লিশ ঘণ্টা গাড়িতে পড়ে রইল পিতার লাশ। সন্তানদের কেউ তাঁকে সমাহিত করার উদ্যোগ নিল না। বাবার কামানো অর্থের ভাগাভাগি চূড়ান্ত না হওয়ায় তাদের কেউই পিতার লাশ দাফনে এগিয়ে এলো না। শেষ পর্যন্ত স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপে লাশ দাফনের ব্যবস্থা হয়। তিনি লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া সাড়ে ১৭ হাজার টাকাও পরিশোধ করেন।

ঘটনাটি ঘটেছে চট্ট গ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার বড় উঠান ইউনিয়নের আট নম্বর ওয়ার্ডের কেরানির বাড়িতে।

মনির আহমেদ পদ্মা অয়েল কোম্পানিতে চাকরি করতেন। গত বছর তিনি চাকরি থেকে অবসরে যান। তাঁর দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। মনির আহমেদ পাকস্থলীর ক্যান্সারে ভুগছিলেন। তাঁর দুই ছেলের একজন মধ্যপ্রাচ্যে থাকেন। অসুস্থ পিতার চিকিৎসার দেখভাল ছেলেরা করেননি। তিন মেয়েই তাঁর চিকিৎসার দায়িত্ব পালন করেছেন।

এই বৃদ্ধের জন্য কাল হয়ে উঠেছিল তাঁর পেনশনের ৫০ লাখ টাকা। অর্থই এই হতভাগ্য পিতার লাশকে অর্থহীন করে তুলেছে লোভী, বিবেকহীন অপদার্থ সন্তানদের কাছে। এই টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে সৃষ্ট দ্বন্দ্বে তাঁর লাশ ৪০ ঘণ্টা অ্যাম্বুলেন্সে পড়ে রইল। যে পিতা কষ্টার্জিত অর্থে সন্তানদের মানুষ করেছিলেন। তাদের বিয়ের উপযুক্ত করে বিয়ে দিয়েছিলেন। নিজেদের আত্মপরিচয় দিয়েছিলেন। একজন পিতা পাঁচ সন্তানকে লালনপালন করে বড় করে তুলেছিলেন সে সন্তানরা পিতার লাশ গাড়িতে রেখে খাওয়াদাওয়া করলো কীভাবে, ঘুমালো কীভাবে, নিজ সন্তানদের চোখে চোখ রাখল কীভাবে তা ভেবে বিস্মিত হই।

কয়েক মাস আগে সংবাদে দেখলাম এক মা তার কিডনি দিচ্ছে সন্তানের জন্য।

৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদ, ‘৫৪ বছর বয়সী বুলি বেগম ২৪ বছর বয়সী ছেলে জাহিদ হাসানকে তাঁর একটি কিডনি দিয়েছেন। মায়ের দেওয়া কিডনি ছেলের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এই মা ও ছেলে এরই মধ্যে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন। শরীরে ব্যথা ও দুর্বলতাসহ শারীরিক জটিলতা থাকলেও তাঁরা হাসিমুখে নিশ্চিন্ত মনে দিন কাটাচ্ছেন।

রংপুর ও ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ির পর গত বছরের ৩ নভেম্বর থেকে রাজধানীর শ্যামলীতে সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালে (সিকেডি) ভর্তি হন জাহিদ। কিডনি প্রতিস্থাপনের আইনি বিষয় সুরাহার জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনসহ সব প্রক্রিয়া শেষে গত ২২ জানুয়ারি রাতে মা ও ছেলের অস্ত্রোপচার হয়।

বুলি বেগম হাসপাতাল ছেড়েছেন অস্ত্রোপচারের সাত দিনের মাথায়। আর জাহিদ হাসপাতাল ছেড়েছেন ১০ দিনের মাথায়। রাজধানীর শ্যামলীতে ভাড়া বাসায় অস্ত্রোপচারের পর মা ও ছেলের প্রথম দেখা হয়। সিকেডি হাসপাতালে মা ও ছেলে ছিলেন আলাদা দুই ভবনে, ফলে সেখানে দেখা হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না।কী আশ্চর্য মানবচরিত্র!

চিড়িয়াখানা ঘুরিয়ে দেখানোর এক পর্যায়ে ছেলে বাবার কাছে জানতে চাইলো এখানে কি সব প্রাণিদের রাখা হয়? বাবা বললেন, চেষ্টা করা হয় সব প্রাণির অন্তত এক জোড়া করে রাখার।

মানুষও তো একটি প্রাণি তাহলে এক জোড়া মানুষ রাখা হয় না কেন?

ছেলের প্রশ্নে কোনোরূপ বিব্রত না হয়ে বাবা বললেন, অনেক কারণে রাখা হয় না। তবে গুরুত্বপূর্ণ কারণটি হলো, তুমি একটি বাঘ দেখে পৃথিবীর সব বাঘের ব্যাপারে একটি ধারণা পাবে। তেমন করে একটি হরিণ কিংবা একটি বানর বা একটি তোতা পাখি দেখে এদের সামগ্রিক চরিত্রের পরিচয় পাবে। কিন্তু একটি মানুষ দেখে কখনো সম গ্র মানবজাতিকে তুমি বুঝতে পারবে না। মানুষ বড় বিচিত্র প্রাণি। একটি মানুষের সঙ্গে আরেকটি মানুষের খুব বেশি মিল থাকে না।

সত্যি মানুষ বড় বিচিত্র প্রাণি। এরা অকারণে মানুষ কিংবা যেকোনো প্রাণি হত্যা করতে পারে। এরা বনের প্রাণিগুলোকে ধরে এনে খাঁচায় বন্ধ করে রাখতে পারে। এরা নিজেরা নিজেরা মারামারি করে অকারণে নির্দোষ মানুষ হত্যা করতে পারে। এরা পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে পৃথিবী ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে। এরা দু পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ লাগিয়ে অস্ত্র বিক্রি করে ফায়দা লুটতে পারে। এরা খাদ্যে ও ওষুধে ভেজাল দিয়ে পরোক্ষভাবে মানুষ হত্যা করতে পারে। এরা প্রয়োজন না হলেও খেতে পারে। এরা খাদ্য মজুত করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে অধিক মুনাফা করতে পারে। এরা পরিবেশের ক্ষতি করে যার একটাও অন্য প্রাণিরা করে না। এরাই আবার কোনো মানুষ বা প্রাণিকে বাঁচাতে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করতে পারে। আদর্শ ও বিশ্বাসের জন্য জীবন দিতে পারে। এই যে ডিসেম্বর মাস, আমাদের বিজয়ের মাস। আজ থেকে ৫১ বছর আগে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়লাভের মাধ্যমে আমরা দেশকে শত্রুমুক্ত করেছিলাম। সে যুদ্ধে শহিদ হয়েছিলেন ৩০ লাখ মানুষ। ভারতের শরনার্থী শিবিরে রোগেশোকে মারা গিয়েছিল আরও প্রায় ১০ লাখ, যাদের অধিকাংশ ছিল শিশু ও বয়স্ক। মুক্তিযোদ্ধা শহিদ হয়েছিলেন কয়েকহাজার। একাত্তরের সে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন দেড় থেকে দু লাখের মতো এ দেশের মুক্তিকামী সন্তান। তাঁরা নিজেদের জীবনদান করতে গিয়েছিলেন দেশের স্বাধীনতার জন্য, এ দেশের মানুষের মুক্তির জন্য। কবে যুদ্ধ শেষ হবে, কীভাবে যুদ্ধ করবে, অস্ত্রপ্রশিক্ষণ কে দেবে, যুদ্ধজয়ের পর তাদের ব্যক্তিগত কী লাভ হবে এতসব ভেবে তাঁরা যুদ্ধে যাননি। তাঁরা মুক্তির লক্ষ্য নিয়ে, দেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন নিয়ে সে অনিশ্চিত যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। আবার নিজ গ্রামেবাড়িতে ফিরতে পারবেন, আবার বাবামা, আত্মীয়পরিজনের মুখ দেখবেন, প্রিয়জনের দেখা পাবেন সে নিশ্চয়তা তো ছিল না। তবুও তারা যুদ্ধে গিয়েছিলেন। এমন করে পৃথিবীব্যাপী যুগে যুগে কত শত মানুষ আদর্শের জন্য, অন্যের মুক্তির জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। অন্যদিকে শুধু স্বাধীনতা চেয়েছিল বলে এ দেশে গণহত্যা করছিল আরেকদল মানুষ যারা ছিল পাকিস্তানি আর তাদের এদেশীয় দালাল রাজাকারআলবদর। বিপ্লবী চে গুয়েভারা কিউবা বিপ্লবে বন্ধু ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। তারপর সে মুক্ত ও বিপ্লবসাধিত কিউবায় ক্ষমতা ভোগ না করে বলিভিয়ায় বিপ্লব সংগঠনের জন্য ঝুঁকি নিয়েছিলেন কিন্তু সেখানে কিছু বিশ্বাসঘাতকের জন্য সফল হতে না পারলেও প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন। অথচ এই দুটি দেশের একটিও তাঁর জন্মভূমি ছিল না।

তাঁর স্বদেশ ছিল আর্জেন্টিনা। কিন্তু তিনি বিশ্বমানবের মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন। তাই বিশ্বের সকল শোষিত, বঞ্চিতরা ছিল তাঁর ভাই। পরাধীন আর ঔপনিবেশিক শক্তির দ্বারা নিষ্পেষিত জাতিসত্তার মুক্তির স্বপ্ন দেখতেন তিনি আর সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতে প্রাণ দিয়েছিলেন সে মহান বিপ্লবী। চে নিজের জন্য প্রাণ বিসর্জন দেননি। নিজে ক্ষমতা নেওয়ার জন্য বিপ্লব করেননি, করেছিলেন মানুষের জন্য, যাদের অধিকাংশই তাঁকে চিনতেন না। এই চট্ট গ্রামের সন্তান বিপ্লবী সূর্য সেন, বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার নিজেদের প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন মানুষের মুক্তির জন্য। ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য। এই ত্যাগ, এই বিসর্জন একমাত্র মানুষ ছাড়া আবার অন্যকোনো প্রাণির পক্ষে সম্ভব নয়। এখানেই মানুষের তুলনা কেবলই মানুষ। এখানেই মানুষ সকল প্রাণিকে ছাড়িয়ে মহিয়ান। এই বিচিত্র স্বভাবের মানব কখন যে কী করবে তার কারণ ব্যাখ্যা করা দুষ্কর। যেমন সামপ্রতিক এই ঘটনাটি দেশের মানুষকে শিহরিত করেছে। চরমভাবে মর্মাহত করেছে। এ এক দুঃসময় অতিক্রম করছি আমরা। আমাদের মানবিক মূল্যবোধ যেন দিনদিন লুপ্ত হতে চলেছে। ভালো বা মঙ্গলের ওপর খারাপ ও অমঙ্গলেও প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে। মমতা, ভালোবাসা, সৌহার্দ্য, সমপ্রীতি লোপ পাচ্ছে। পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে পড়ছে। ভেঙে পড়ছে সমাজকাঠামো। সমাজে শুভবোধসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা লোপ পাচ্ছে। সতর্ক হওয়ার সময়ও বুঝি হারাতে বসেছি এখন।

লেখক : কবি, সাংবাদিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচলো মন শান্তি নিকেতন
পরবর্তী নিবন্ধকেলিশহর উচ্চ বিদ্যালয় : হীরকজয়ন্তী উৎসব ও প্রাক্তনদের পুনর্মিলনী