চলুন ঝরে পড়া শিশুদের পাশে দাঁড়াই

রশীদ এনাম | বৃহস্পতিবার , ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৮:১৭ পূর্বাহ্ণ

‘মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও, মানুষ ফাঁদ পাতছে তুমি পাখির মতো পাশে দাঁড়াও। মানুষ বড় একলা তুমি তাহার পাশে এসে দাঁড়াও। তোমাকে সেই সকাল থেকে তোমার মতো মনে পড়ছে। সন্ধ্যা হলে মনে পড়ছে, রাতের বেলা মনে পড়ছে, মানুষ বড় একলা তুমি তাহার পাশে দাঁড়াও। এসে দাঁড়াও, ভেসে দাঁড়াও, ভালোবেসে দাঁড়াও’- শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার চরণগুলি কেন জানি আজ খুব বেশি মনে পড়ছে। শীতে ঝরা পাতার মতো দুটি বছর হারিয়ে গেল শুধু শুকনো পাতার মতো বিষাদের মর্মও ধ্বনিটা শুধু রয়ে গেল। করোনার গ্রাসে কত প্রিয়জন আজ না ফেরার দেশে। ২০২২ সালটাও একই পথে হাঁটছে। জানি না পৃথিবীর এই অসুখ কখন সারবে। মহান সৃষ্টিকর্তা ভালো জানে। পৃথিবীর করুণ আর্তনাদ, কোটি মানুষের প্রার্থনা মনে হয় সৃষ্টিকর্তার কানে পৌঁছাতে আরও বাকী আছে।
শহরের রঙ বদলে গেছে। বদলে গেছে পৃথিবী। ধূসর শহরে মৃত্যুর মিছিল যেন থেমে নেই। বদলে গেছে ঋতুচক্র, প্রকৃতির বিরূপ আচরণ। আহা পৃথিবী। ইশকুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় আবারও ছুটি। প্রাণের মেলা হৃদয়ের মেলা একুশের বই মেলাটাও পিছিয়ে দিয়েছে সরকার। করোনাকালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চাঁদমুখো ফুলের মতো শিশুর কিশোররা। নিষ্পেষিত পরিবারের শিশুরা বেশি ঝরে পড়ছে।
এই তো সেদিন সুবর্ণ এক্সেপ্রেস ধরার জন্য ছুটছিলাম কমলাপুর স্টেশেনের দিকে। গন্তব্য নিজভূমে সৌন্দর্যরাণী চট্টগ্রাম। পুঁ পুঁ পুঁ হুইসেলে বেজে উঠল। একটু পরে ট্রেন ছেড়ে দিবে। সাথে গাঁটরি বোঁচকা দুই তিনটা। ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। হঠাৎ পেছন থেকে স্যার স্যার বলে ডাক দিল, লাগবে? দিন না আমাকে। আমি তুলে দিয়ে আসি ট্রেনে। ফিক করে হাসি দিয়ে বলল, ৩০ টাকা দিলে হবে স্যার। চেহারা দেখে মনে হবে না সে সুবিধা বঞ্চিত শিশু। মায়াভরা চেহারা স্টেশনে কুলির কাজ করে। মাথায় আর্মিকাট চুল। দেখলে মনে হবে যেন কোনো ক্যাডেট ইশকুল এন্ড কলেজের ছাত্র। আমার হাত থেকে তিনটা ব্যাগ নিয়ে নিল। তাঁকে বললাম, তুমি দুটো নাও। আমি একটা নিব। কী নাম তোমার? সে বলল, সায়িদ। চতুর্থ শ্রেণীতে অধ্যায়ন করছে। তার বাবা বেঁচে নেই। স্টেশনে যাত্রীর লাগেজ বহন করে বেড়ায়। প্রতিদিন কুলিগিরি করে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা আয় করে। বাসায় ছোট বোন মা তিনজনের অভাবের সংসার। মা বাসায় বাসায় ঝিয়ের কাজ করে। ইশকুল বন্ধ পড়া লেখার খরচ জোগাতে এই পেশা বেঁচে নিয়েছি। ইশকুল খোলা থাকলে এক বেলা করে। সায়িদের সাথে প্লাটফর্মে গল্প করতে করতে হাঁটছিলাম। সে বলল, তার স্বপ্ন, পড়ালেখা করে সেনাবাহিনীর কমান্ডার হওয়া। সায়িদকে বললাম, কেন কমান্ডার হতে চাও? সে বলল, স্যার টিভিতে দেখেছি, সেনাবাহিনীর সদস্যারা দেশের বড় বড় দুর্যোগের সময় সবার আগে এগিয়ে আসেন মানুষের পাশে দাঁড়ান। দেশের প্রতি তাঁদের অনেক প্রেম, অনেক ভালোবাসা। তাঁকে বললাম ভালোবাসা প্রেম কী? সে বলল, স্যার মায়া, টান। ট্রেনে ব্যাগ তুলে দিল। তাঁকে একশ টাকার নোট দিলাম। সে বলল, স্যার ভাঙতি নেই। তাকে বললাম, পুরোটাই রেখে দেয়। বাকীটা বখশিস। সে ৩০ টাকার বেশি কিছুতে নিবে না। অবাক হলাম! ছোট শিশু সায়িদের সততা দেখে। বুকে জড়িয়ে ধরলাম সায়িদকে। নিজের মুঠোফোনে সেলফি তুললাম। বাবা হারানো সায়িদের মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম, দোয়া করি সায়িদ অনেক বড় হও।
পকেটে জোর করে টাকাটা পুরে দিয়ে বললাম, লেখা-পড়া চালিয়ে যাবি সায়িদ। লক্ষ্য থাকলে অবশ্যই কমান্ডার হতে পারবি। পড়া লেখা কখনও বন্ধ করিও না ভাই। কষ্ট করে হলেও চালিয়ে যাবি। আমার একটা ভিজিটিং কার্ড দিলাম। বললাম, লেখা পড়া যেন কখনও বন্ধ না হয়। কু ঝিক ঝিক কু ঝিক ঝিক করে ট্রেন ছেড়ে দিল। সায়িদ সালাম দিয়ে একটা মায়াভরা হাসি দিল। ট্রেন থেকে টুপ করে লাফ দিয়ে নেমে গেল চোখের পলকেই। নতুন কোনো গাঁটরি বোঁচকার প্রত্যাশায়। ট্রেনের সিটে বসে ভাবলাম আহা জীবন! আহা সায়িদ! আহ স্বপ্ন! ট্রেন ছেড়ে দিল জানালার ফটক দিয়ে দেখছিলাম ছোট সায়িদকে। গুটি গুটি পায়ে হেঁটে প্লাটফর্ম ত্যাগ করছে। অনেকক্ষণ থাকিয়ে রইলাম যতক্ষণ পর্যন্ত সে দৃষ্টির আড়াল না হয়। একটু আগে সায়িদ বলেছিল, প্রেম ভালোবাসা মানে, মায়া আর টান! সায়িদ কি পারবে স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে সেনাবাহিনীর কমান্ডার হতে? করোনাকালীন সায়িদের মতো হাজারও সায়িদ ঝরে পড়েছে শুধু অর্থের অভাবে। সায়িদের মতো হাজারও সুবিধাবঞ্চিত অদম্য মেধাবী স্বপ্নবাজরা চারপাশে আছে। ওরা সুযোগ চাই মানুষ হতে। এসো মায়া ছড়াই নিষ্পেষিত শিশুদের প্রতি ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেই। ওদের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে ওদের পাশে দাঁড়াই। সায়িদরা এগিয়ে গেলে সোনার বাংলাদেশ একদিন এগিয়ে যাবে। জয়তু সায়িদ !
লেখক: প্রাবন্ধিক ও ব্যাংকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধএ দুঃখ কারে বোঝাই?
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজ কাল