কাল আজ কাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৮:১৮ পূর্বাহ্ণ

এ বছরের একুশে পদকপ্রাপ্তদের নামের তালিকায় আজাদী সম্পাদক এম এ মালেকের নাম দেখে আনন্দিত হলেও আমি মোটেও চমকিত হইনি। চমকিত না হওয়ার কারণটি হচ্ছে সংবাদটি অপ্রত্যাশিত ছিল না। বেশ কয়েকবছর ধরে ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমি কিংবা আমার মতো অনেকে ধারণা করতেন আজাদী অথবা এর সম্পাদক একুশে পদক পাবেন। বরং দেরি হওয়াতেই কিছুটা দুঃখ পেয়েছি।
বাংলাদেশের মুদ্রণশিল্প এবং সংবাদপত্রের ইতিহাসে এই পরিবারের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা আছে তা কেউ মুছে ফেলতে পারবে না। কিন্তু ঢাকার বাইরে হওয়ায় মনোযোগ ও মূল্যায়নের আলোটা এখানে পড়েনি। শুধু মুদ্রণশিল্প কিংবা সংবাদপত্রে ভূমিকার জন্য নয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের জাগরণের অবিস্মরণীয় আন্দোলন বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন ও একুশের প্রথম কবিতার সঙ্গে এই পরিবার তথা এই পরিবারের প্রতিষ্ঠান কোহিনূর ইলেক্ট্রিক প্রেসের, যেখান থেকে জন্ম নিয়েছিল দৈনিক আজাদী, ঐতিহাসিক যোগসূত্র কখনো বিচ্ছিন্ন হওয়ার নয়। তাই সে পরিবারের সন্তান এবং দেশের অন্যতম প্রাচীন ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা হিসেবে স্বীকৃত আজাদীর সম্পাদক এম এ মালেকের একুশের পদক প্রাপ্তি ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র।
মালেক সাহেবের পিতা, এ অঞ্চলের প্রথম মুসলিম ইঞ্জিনিয়ার এবং আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা আবদুল খালেক সাহেবের দিকটিও এই অবসরে আলোচনা করা প্রাসঙ্গিক হবে। তিনি যে সময় প্রেস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সে সময় এতদঞ্চলে শিক্ষার হার খুবই কম ছিল। ফলে পাঠকের সংখ্যাও কম হওয়া স্বাভাবিক। সে সময় তিনি প্রেস তো খুললেনই কয়েক বছর পর বের করলেন একটি দৈনিক পত্রিকা এবং চালু করলেন কোহিনূর লাইব্রেরি নামে একটি বইয়ের দোকান। সে সময়ে তিনি এসব না করে চট্টগ্রাম শহরে বিঘায় বিঘায় জমি কিনতে পারতেন। আন্দরকিল্লায় দোকান কিনতে পারতেন, আরও অনেককিছু করতে পারতেন। আজ ভেবে অবাক হই তিনি কতটা অগ্রসর চিন্তার মানুষ হলে এমন সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন।
এ গেল পিতার কথা এবার পুত্রের কথায় আসি। আজাদী বেরিয়েছিল ১৯৬০ সালে। এর দু বছর পর ইঞ্জিনিয়ার খালেক সাহেব মৃত্যুবরণ করেন। সে সময় তিনি যে সম্পত্তি রেখে গিয়েছিলেন তার ওপর ভর করে সে সময়ের টগবগে যুবক, পিতার একমাত্র পুত্র মালেক সাহেব রাজার হালে চলে যেতে পারতেন। সাধারণত বড়লোকের একমাত্র সন্তানরা বেপথু হয়, আয়েশি এবং অকর্মণ্য ধরনের হয়। আর কম বয়সে টাকাপয়সা হাতে পেলে খুব কম সংখ্যক মানুষই সঠিক পথে অগ্রসর হতে পারে। সে সম্ভাবনা মালেক সাহেবের ছিল কিন্তু তিনি সে পথে যাননি। তিনি পিতার স্বপ্নকে ছেড়ে যাননি। পত্রিকা প্রকাশনার মতো একটি কঠিন কাজ তিনি কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন।
তাঁর পিতা যে সময় পত্রিকা বের করেছিলেন সে সময় পত্রিকা বের করা ব্যবসা ছিল না। সেটি ছিল ‘মটো’। ও সময় সমাজহিতৈষীরা নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে পত্রিকা বের করতেন সমাজে শুভবোধের জাগরণের জন্য। আজকাল পত্রিকা বা সংবাদমাধ্যম হয়ে উঠেছে করপোরেট হাউসের মুখপত্র। ফলে এসব গণমাধ্যম না হয়ে শুধুই সংবাদমাধ্যম হয়ে থাকে। আজাদীর শুরুই হয়েছিল গণমাধ্যম হিসেবে, সাধারণ মানুষের মুখপত্র হিসেবে এত দীর্ঘ পথ পেরিয়ে পত্রিকাটি এখনো তার সে চরিত্র ধরে রেখেছে। আজাদী আজ চট্টগ্রামের মুখপত্রের ভূমিকা পালন করেছে। চট্টগ্রামবাসী আজাদীকে তাই নিজেদের কাগজ হিসেবে দেখে। এটা এখন চট্টগ্রামের সংস্কৃতিরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। সকালে বেলা বিস্কুটের সঙ্গে এক কাপ চা আর আজাদী মিলেমিশে একাকার এখন।
অনেকে হয়ত জানেন পত্রিকা বিক্রির টাকা দিয়ে পত্রিকার ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব নয়। তা সামান্য কিছু যোগ করে মাত্র। অনেক পত্রিকা বিক্রির টাকাও তুলে আনতে পারেন না এজেন্টদের কাছ থেকে। এক্ষেত্রে আজাদী শুরু থেকে ছিল ব্যতিক্রম। ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক শুরু থেকেই পত্রিকা বিক্রি করতেন নগদ টাকায়। হকাররা নগদ টাকা দিয়ে পত্রিকা কিনতেই না পারলে প্রয়োজনে তিনি তাদের টাকা ধার দিতেন কিন্তু নগদ ছাড়া পত্রিকা বেচতেন না। এই ধারা এখনো বজায় রেখেছেন তাঁর পুত্র। পূর্বেই বলেছি পত্রিকা বিক্রির টাকায় পত্রিকা চালানো সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন বিজ্ঞাপন। চট্টগ্রামের মতো শহরে বিজ্ঞাপনের সুযোগ ছিল না বললেই চলে। এরমধ্যে নিয়মিত পত্রিকা বের করা ছিল দুঃসাধ্য একটি কাজ। মালেক সাহেব পিতার পত্রিকা চালু রেখেছেন এই দুঃসাধ্য সাধন করে। তিনি প্রায়ই বলেন অন্তত ত্রিশ বছর তিনি লোকসান দিয়ে পত্রিকা চালু রেখেছিলেন। তাঁর দুর্গম এই পথচলায় সম্পাদক হিসেবে ভগ্নিপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের অবদানও অনস্বীকার্য। দেরিতে হলেও মালেক সাহেবকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চট্টগ্রামবাসীকেই সম্মানিত করেছে এ কারণে প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। তবে সে সঙ্গে এটাও বলতে চাই এই অঞ্চলের মুদ্রণশিল্পের গোড়াপত্তন, বিকাশ ও সংবাদপত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ইঞ্জিনিয়ার খালেক সাহেবও রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রাপ্তির দাবি রাখে।
মালেক সাহেবের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনুজ-অগ্রজের মতো। তাঁর কাছে আমার অশেষ ঋণ। একজন কলামলেখক হিসেবে আমার যে সামান্য পরিচয় ঘটেছে সেটির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর অফিসে আলাপের এক ফাঁকে তিনি বলে উঠলেন, আপনি আমাদের কাগজে লেখেন না কেন? আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম মাঝেমধ্যে লিখি তো। তিনি বললেন, মাঝেমধ্যে নয় নিয়মিত লিখবেন। কলামের একটা নাম ঠিক করেন আজই এবং কোনদিন লিখবেন ঠিক করেন। আসুন আমার সঙ্গে বলে নিয়ে গেলেন পাশের রুমে দাদামনি (কবি অরুণ দাশগুপ্ত) ও সিদ্দিক ভাইয়ের সামনে। আমাকে দেখিয়ে বললেন, বাদল সাহেব এখন থেকে নিয়মিত লিখবেন। আমি সংকোচে পড়ে গিয়েছিলাম কারণ আমি লেখা দিলেই দাদামনি বা সিদ্দিক ভাই ছাপিয়ে দিতেন। আমি মালেক সাহেবকে লেখা ছাপানোর বিষয়ে কিছু বলেছি বলে তাঁরা ধরে নেবেন কিনা তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম যদিও তাঁরা বিষয়টিকে সহজভাবে নিয়েছিলেন।
আমি তাঁর কাগজে নিয়মিত কলাম লিখছি এক যুগের বেশি সময় ধরে। আমি নানা বিষয় নিয়ে খুব খোলামেলাভাবে লিখি তা পাঠকমাত্রই জানেন। দীর্ঘদিনে সব লেখা যে তাঁর মতের সঙ্গে মিলেছে তা নয়। আমি নিজেও বুঝি কোন কোন লেখা বা মতামত তাঁর পছন্দ হওয়ার নয় কিন্তু অবাক বিষয় হচ্ছে তিনি কোনোদিন আমার লেখায় হাত দেননি কিংবা ছাপা হতে বিরত থাকেননি। সবচেয়ে ব্যতিক্রমী ঘটনা হচ্ছে অন্য পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করা সত্ত্বেও তিনি তাঁর কাগজে আমার লেখা বন্ধ করেননি। বাংলাদেশে এই উদাহরণ দ্বিতীয়টি আছে কিনা আমার জানা নেই। (অবশ্য আমি যে পত্রিকায় কাজ করতাম সে পত্রিকার সম্পাদকও আজাদীতে লেখা ছাপানোয় বাধা দেননি কখনো)।
আমি যতবারই মালেক সাহেবের কাছে গেছি ততবারই প্রাণিত হয়ে ফিরেছি। এমন ইতিবাচক মনের মানুষ আমি খুবই কম দেখেছি। একবার কথা বলতে বলতে তিনি একটি সাদা কাগজ টেনে নিয়ে তাতে লিখলেন, IMPOSSIBLE তারপর I-এর পর একটি ঊর্ধ্বকমা দিয়ে বললেন, দেখুন এবার কী দাঁড়াল। আমি পড়লাম – I’m possible. উনি বললেন, রাইট। ইম্পসিবল বলে কিছু নেই। আপনি চেষ্টা করলে পসিবল।
তিনি অত্যন্ত হিউমারিস্ট এবং উইটি। তাঁর সঙ্গে না মিশলে বোঝা যায় না। বাইরে থেকে মনে হয় তিনি খুব রাশভারি মানুষ। সমাজকে দেখার আলাদা চোখ আছে তাঁর। তাঁর একটি বই আছে। স্যাটায়ারধর্মী সে বইটির নাম ‘উল্টো থেকে’। ওই যে বললাম সমাজকে দেখা ও বোঝার আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি আছে তাঁর। দেশের খ্যাতনামা একটি পত্রিকার স্লোগান ছিল,’বদলে যাও বদলে দাও’। আমি দেখেছি শিশু-কিশোর বা উঠতি প্রজন্মের কোনো অনুষ্ঠানে গেলে তিনি বলতেন, তোমরা বদলে যাবে না। আজ তোমরা যেমন নিরপরাধ, নিষ্পাপ ও শুদ্ধ আছো বড় হলেও তাই থাকবে, বদলাবে না। আমার কাছে তাঁর এই ভাবনা খুবই ইতিবাচক বলে মনে হতো।
আমরা যখন সিআরবিতে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সে সময় অনেক প্রতিবন্ধকতা ছিল। সে কঠিন সময়ে তিনি আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, সহায়তার হাত বাড়িয়েছিলেন সে হাত এখনো সরিয়ে নেননি। আজাদীর কোনো বিজ্ঞাপনের প্রয়োজন হয় না তবুও এক যুগ ধরে নববর্ষ উদযাপন পরিষদের আয়োজনের সঙ্গে তিনি আছেন। নামকাওয়াস্তে অন্য বিজ্ঞাপনের সামান্য অর্থ ছাড়া পুরো খরচটাই বহন করেন তিনি। তাই বলে আজ পর্যন্ত তাঁর কোনো মতামত কমিটির ওপর চাপিয়ে দেননি এবং কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপও করেননি। এমনকি সবার অনুরোধ অগ্রাহ্য করতে পারছেন না বলে অনিচ্ছাসত্বেও সভাপতি পদে তাঁকে থাকতে হচ্ছে।
তিনি এখন আজাদীর সম্পাদক শুধু নন। তিনি এখন চট্টগ্রামের অভিভাবকে পরিণত হয়েছেন। চট্টগ্রামের যে কোনো সংকট ও সমস্যায় তিনি আছেন। জীবনে অনেক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সফল নেতৃত্ব দিয়ে বর্তমানে চট্টগ্রােেমর অবহেলিত চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে তৎপর হয়েছেন। বিশ্বমানের হাসপাতাল ইম্পেরিয়াল চালুর পর মা ও শিশু হাসপাতালে আলাদা ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছেন।
তাঁর দীর্ঘ ও নিরোগ জীবন কামনা করে শেষে সবিনয়ে বলতে চাই, একটি কাজ তাঁকে করতে হবে, সেটি হলো তাঁর আত্মজীবনীমূলক একটি বই প্রকাশ করা। কারণ তাঁর এই বইটিতে উঠে আসবে এ অঞ্চলের মুদ্রণশিল্প ও সংবাদপত্রের অনেক অজানা তথ্য যা একদিন ইতিহাসের আকর হয়ে উঠবে। এ কাজটি তাঁকে করতে হবে নিজের জন্য দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্বার্থে।
লেখক : কবি-সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধচলুন ঝরে পড়া শিশুদের পাশে দাঁড়াই
পরবর্তী নিবন্ধড. মইনুল ইসলামের কলাম