দেশের দ্বিতীয় বাণিজ্যিক রাজধানী হিসাবে খ্যাত চট্টগ্রাম অঞ্চলটি বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে সম্পৃত্ত থাকলেও জাতীয় অর্থনীতিতে এ অঞ্চলের কৃষির রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এ অঞ্চলের উপর দিয়ে কর্ণফুলী, মুহুরী, ফেনী, হালদা, সাংগু, মাতামহুরী, বাকখালী ও ইছামতি নদী কৃষিকে করেছে সমৃদ্ধ। ভূমির বন্ধুরতা, ফসলের কম উৎপাদনশীলতা, সেচ সমস্যা, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি বা জ্ঞান কৃষকের দোরগোড়ায় না পৌঁছা, ফসলের পোকা ও রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ, ফসল সংগ্রহোত্তর জ্ঞানের স্বল্পতা, বন্যা, খরা, জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নগরায়নের ফলে কৃষি জমি কমে যাওয়া, কৃষি জমির মূল মালিকের অনুপস্থিতি বা এবসেন্টি ফামিং, অপর্যাপ্ত কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, কৃষির চাইতে অন্য পেশার প্রতি মানুষের আগ্রহ, সচ্ছল লোকদের কৃষিতে বিনিয়োগে অনাগ্রহ, কৃষি কাজের জন্য শ্রমিক দুষ্প্রাপ্যতা, ফসলের ন্যায্য মূল্য না পাওয়া, বাজার কাঠামোর দুর্বলতা ও সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনার অভাব এ অঞ্চলের কৃষির অন্যতম সমস্যা হলেও কৃষির অগ্রযাত্রা থেমে নেই।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম অঞ্চল, আগ্রাবাদ এর ওয়েবসাইটের তথ্যমতে চট্টগ্রাম অঞ্চলকে পাঁচটি কৃষি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে যা পাঁচটি জেলা (চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর), ৪২ টি উপজেলা ও ৩টি মেট্রো থানার সমন্বয়ে গঠিত। অঞ্চলের মোট আয়তন ১৪ হাজার ৪ শত ২৩ দশমিক ২২ বর্গকিলোমিটার। এখানে প্রায় ১ কোটি ৮৬ লক্ষ ৮৮ হাজার ২ শত ৪৪ জন মানুষের বসবাস। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বড় চ্যালেন্স। খাদ্য উৎপাদনের দিক দিয়ে চট্টগ্রাম জেলা ব্যতীত অন্য চারটি জেলায় খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকে। চট্টগ্রাম শহরে অতিরিক্ত প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষের অন্নের যোগান দিতে গিয়ে চট্টগ্রাম জেলায় খাদ্য ঘাটতিতে থাকে বলে ওয়েব সাইটটিতে উল্লেখ রয়েছে। এ অঞ্চলের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কৃষি গবেষণা কেন্দ্র সমূহ ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
অতিরিক্ত পরিচালকের কার্যালয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম অঞ্চল, আগ্রাবাদ এর তথ্যানুসারে চট্টগ্রাম অঞ্চলে তথা পাঁচ জেলায় ২০২০-২১ সালের বোরো ধান আবাদ হয় মোট ২ লক্ষ ৬৯ হাজার তিন হেক্টর যার মোট উৎপাদন ছিলো ১ লক্ষ ৮০ হাজার দুইশত পঁচাশি মেট্রিক টন যার হেক্টর প্রতি গড় ফলন ছিলো হাইব্রিড ৪.৭৮ মে. টন, উফশী ৩.৭৪ মে. টন এবং স্থানীয় ২.০০ মে. টন। একই বছর রোপা আউশের আওতাধীন জমির পরিমাণ ছিলো মোট ১ লক্ষ ২৩ হাজার আটশত আটাত্তর যার মোট উৎপাদন ৩ লক্ষ ২৩ হাজার আটশত ছিয়াশি মেট্রিক টন। রোপা আউশের হেক্টর প্রতি গড় ফলন ছিলো হাইব্রিড ৩.৯৯ মে. টন, উফশী ২.৭১ মে.টন এবং স্থানীয় ১.৪৪ মে. টন। অন্যদিকে একই বছর আমন ধান আবাদের মোট জমির পরিমাণ ছিলো ৫ লক্ষ ৭৪ হাজার চারশত তিয়াত্তর হেক্টর যার মোট উৎপাদন (চাউলে) হিসাব করা হয় ১৬ লক্ষ ২৯ হাজার ছয়শত এগার মেট্রিক টন। আমন ধানের হেক্টর প্রতি গড় ফলন ছিলো হাইব্রিড ৪.১০ মে.টন, উফশী ৩.০১ মে.টন এবং স্থানীয় ১. ৬৯ মে.টন। এ অঞ্চলের শস্য নিবীড়তার হার ২০১%।
চট্টগ্রাম অঞ্চলের অতিরিক্ত পরিচালক মনজুরুল হুদা এর মতে, বোরো মৌসুমে সেচ সুবিধা বাড়ানো গেলে ফলন আরো বৃদ্ধি পাবে। তিনি বলেন রবি মৌসুমে শতকরা ২৭ ভাগ জমি পতিত থাকে, যা খরিপ-১ মৌসুমে শতকরা ৬৮ ভাগ এবং খরিপ-২ মৌসুমে শতকরা ১৫ ভাগ। পতিত জমি আবাদের আওতায় আনা গেলে মোট উৎপাদন আরো বাড়বে। কৃষি বিভাগ পতিত জমি চাষের আওতায় আনার ব্যাপারে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। ধান অত্র অঞ্চলের প্রধান ফসল হলেও ধানের উৎপাদন পর্যায়েই ১৮-২০ শতাংশ ধান বিনষ্ট হয় যা ফলন পূর্ববর্তী ও পরবর্র্তী অপচয়ের কারণে ঘটে। এক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জাতের কারণকেই দায়ী করা হয়। ফলশ্রুতিতে ৬৭ লাখ টন চাল নষ্ট হয়। এসব অপচয় প্রতিরোধ করা গেলে চালের মোট উৎপাদন বেড়ে যাবে। ফলে চাল রপ্তানির সুযোগ বাড়বে অথবা আমদানি নির্ভরতা কমবে।
অতিরিক্ত পরিচালক অত্র অঞ্চলে উচ্চ মূল্য সব্জি যেমন ফুলকপি, বাঁধাকপি, শসা, কলা, পেঁপে আবাদ করে চাষীরা অধিক লাভবান হচ্ছে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি উল্লেখ করে বলেন সাতকানিয়ার চাষী আবুল হোসেন ৪০ শতাংশ জায়গায় চিচিঙ্গা, তরমুজ, লাউ, ছোট সাইজের পাহাড়ি মিষ্টি কুমড়া চাষ করে আড়াই লক্ষ টাকা খরচ করে প্রায় ছয় লক্ষ টাকার ফসল বিক্রি করে অনেক লাভবান হয়েছে। তিনি চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্য জুন-জুলাই এর আগে এবং পরে ফল আসে এরকম আমের আরো জাত উদ্ভাবনের উপর জোর দেন। সাইট্রাস জাতীয় ফল যেমন বাতাবী লেবু, বীজ বিহীন লেবু এ অঞ্চলের জন্য বেশ উপযোগী বলে মত দেন। ফল চাষের কথা বলতে গিয়ে এ অঞ্চলের অবসরপ্রাপ্ত বিশিষ্ট্য ফল বিজ্ঞানী ড. মনোরন ধর বলেন ভৌগোলিক কারণে এ অঞ্চল সব রকম ফল ফলাদীর জন্য উপযুক্ত। তবে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি কৃষকের দোরগোড়ায় সেভাবে না পৌঁছার কারণে এখনো অন্যান্য এলাকার তুলনায় ফল আবাদে অঞ্চলটি পিছিয়ে আছে। উহা উত্তরণের জন্য সরকারিভাবে অঞ্চলভিত্তিক কৃষি পরিকল্পনা প্রণয়নের দাবি জানান।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও করণীয়: কৃষিকে বাণিজিকীকরণ ও লাভজনক কৃষিতে রূপান্তরিত করে রপ্তাণী বাড়ানো বর্তমান সরকারের অন্যতম লক্ষ্য।কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ব্যাপক আকারে বাড়লে চাষাবাদে উৎপাদন খরচ অনেক কমে যাবে। এলাকা ভিত্তিক চাহিদানুসারে ফসল নির্বাচন, প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ অতীব জরুরী। এ অঞ্চলের বিশিষ্ট্য কৃষি বিজ্ঞানী ও সাবেক মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সাবজল উদ্দিন জানান এক সময় চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে বরবটিসহ অনেক সব্জি হর্টেক্স ফাউন্ডেশনের সহায়তায় রপ্তাণি হতো। সেখানে কৃষকদের কনট্রাক্ট ফামিং এর জন্য গ্রোথ সেন্টার করার কথা থাকলেও সেটি আর হয়ে উঠেনি। তবে বেসরকারি পর্যায়ে রপ্তাণিকারকেরা অন্য উপায়ে সব্জি সংগ্রহ করে রপ্তাণি করে থাকেন বলে জানান। সব্জি রপ্তাণির জন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় রপ্তাণিকারকদের এগিয়ে আসতে হবে। কৃষকদের রপ্তাণিযোগ্য সব্জি উৎপাদনের উপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দরকার। ফসলে কীটনাশক ব্যবহার কমিয়ে জৈব বালাইনাশক ব্যবহারে গুরুত্ব দিতে হবে।
বারি ফেলন-১ অনেক পুরাতন জাত হওয়ায় নতুন জাত উদ্ভাবন দরকার। নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলায় বারি সয়াবিন-৫, বারি সয়াবিন-৭ এর চাহিদা রয়েছে। বারি সরিষা-১৪, বারি সরিষা-১৭, বারি চীনাবাদাম, বারি টমেটো-১৪, বারি টমেটো-১৫, বারি টমেটো-১৭ ,বারি টমেটো-২০, বারি ড্রাগন ফল-১, বারি আম-৪, বারি মাল্টা-১ চাষের সম্ভাবনা অধিক। লক্ষ্মিপুর ও নোয়াখালী জেলার জন্য লবণাক্ত ও জলাবদ্ধতা সহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবন জরুরি। বারি ভূট্টা-৯, বারি ভূট্টা-১৬ এর চাহিদা বেশী লক্ষ্মীপুরে। সে সাথে ভূট্টা মাড়াই যন্ত্রের চাহিদাতো রয়েছে সবখানেই। মানুষ এখন নগর কৃষির দিকে ঝুঁকছে। অঞ্চলভিত্তিক ছাদ বাগানের আদর্শ ও বিজ্ঞানসম্মত মডেল নেই। এ বিষয়ে চট্টগ্রামের কৃষি গবেষণা কেন্দ্র সমূহ উদ্যোগ নিতে পারে। দোহাজারীর আলু, হাটহাজারীর পুতা বেগুন, হালদা মরিচ, সীতাকুণ্ডের সীম, কাঞ্ছন নগরের পেয়ারা, কালিপুরের লিচু এর উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির উপর গবেষণা করা যেতে পারে। তবে অনেক ফসলের উপর গবেষণা কর্ম চলমান রয়েছে। পরিশেষে, গবেষণা-সম্প্রসারণ-কৃষক লিংকেজ জোরদারকরণের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের ভবিষ্যৎ কৃষি একটি লাভজনক বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হউক সে প্রত্যাশা করছি।
লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সাবেক ন্যাশনাল কনসালটেন্ট; ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা,
আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।