বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মতো গতকাল চট্টগ্রামেও যথাযোগ্য মর্যাদা এবং উৎসবমুখর পরিবেশে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব বড়দিন উদযাপিত হয়েছে। ধর্মীয় আচার, প্রার্থনা ও আনন্দ–উৎসবের মাধ্যমে নগরীর গির্জাগুলোতে আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠানের। গতকাল সন্ধ্যায় বড়দিনের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন আর্চ বিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদার। রানির গির্জার বিশপ হাউসে বসেছিল বিশিষ্টজনদের মিলনমেলা। আর্চ বিশপ অতিথিদের সাথে নিয়ে বড়দিনের কেক কাটেন। এর আগে বিশেষ প্রার্থনায় আকুতি জানানো হয় সম্প্রীতির। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ঘরে ঘরে চলছে উৎসব। নগরের ফিরিঙ্গীবাজার গির্জা, জামালখান এ জি চার্চ, লাভ লেন গির্জাসহ বিভিন্ন উপাসনালয়ে বর্ণিল আলোকসজ্জার পাশাপাশি ক্রিসমাস ট্রি ও প্রতীকী গোশালা তৈরি করা হয়। দিনটি উপলক্ষে অনেক খ্রিস্টান পরিবারে বিশেষ কেক তৈরি করা হয়, ছিল বিচিত্র খাবারের আয়োজন।
পাথরঘাটার পবিত্র জপমালা রানির গির্জায় গতকাল সকাল সাড়ে আটটায় প্রার্থনা পরিচালিত হয়। প্রার্থনা পরিচালনা করেন ফাদার লেনার্ড সি রিবেরন্ড। একই সময়ে জামালখানে নির্মলা মারিয়ার গির্জায় ইংরেজিতে একটি উপাসনা অনুষ্ঠিত হয়। এটি পরিচালনা করেন আর্চবিশপ লরেন্স সুব্রত হাওলাদার। এছাড়া বিকেলে আর্চবিশপ হাউস প্রাঙ্গণে আয়োজন করা হয় সুধী সমাবেশ।
এ সময় বিশপ বলেন, বেথলেহেমের গোশালায় মানবশিশু হয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন যীশু। তাঁর আগমনে বিভিন্ন দেশের রাজা–বাদশা, জ্যোতির্বিদ ও পণ্ডিতেরা বেথলেহেমের গোশালায় সমবেত হয়েছিলেন। সেখানে পান্থশালার ব্যবসায়ী ও অতি দরিদ্র রাখালরাও সমবেত হয়েছিলেন। তিনি সবাইকে জীর্ণ গোশালায় জড়ো করেছেন যেন সবার হৃদয়–মনের রূপান্তর ঘটে এবং সবার পারস্পরিক সহভাগিতার মাধ্যমে সহযাত্রিক মন্ডলী প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশপ বলেন, পৃথিবীর কয়েকটি দেশে যখন যুদ্ধ চলছে, যুদ্ধের কারণে যখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও দরিদ্রদের দুঃখ দুর্দশা অবর্ণনীয় হয়ে উঠেছে, যখন রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে হানাহানি ও অশান্তি বাড়ছে; তখন শিক্ষিত–অশিক্ষিত, ধনী–দরিদ্র, প্রবাসী–অভিবাসী, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ব্যক্তিদের একত্রে মিলিত হয়ে শান্তি–ভালোবাসা, ন্যায্যতা–মুক্তি ও আনন্দের পথ অন্বেষণ করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি বিষয় হয়ে পড়েছে। জগতের এ দুঃখ–দুর্দশার মধ্যে পবিত্রাত্মার অনুপ্রেরণায়, পোপ মহোদয়ের ডাকে সাড়া দিয়ে, ঐশবাণীর আলোকে এবং পুণ্য উপাসনার মাধ্যমে একসঙ্গে পথচলার আহ্বান আমরা পেয়েছি। আমরা নবজাত শিশু যীশুর কাছে আশীর্বাদ যাঞ্চা করছি, তিনি যেন সহযাত্রিক মণ্ডলীর মাধ্যমে স্বর্গীয় পিতার পরিকল্পনা বুঝতে আমাদের সাহায্য করেন এবং সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আগামী
বছরটিতে আমাদের আশীর্বাদ দান করেন।
বড়দিনের উৎসবে যোগ দেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, ভারতীয় সহকারী হাইকমিশনার ডা. রাজিব রঞ্জন, সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ, সদরঘাট শিয়া মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা আমজাদ হোসেন, ড. সেলিম জাহাঙ্গীর, চসিক কাউন্সিলর পুলক খাস্তগীর, হাসান মুরাদ বিপ্লব প্রমুখ। এর আগে গত শনিবার দিবাগত রাত সাড়ে নয়টায়, বারোটায় ও রোববার সকাল সাড়ে আটটায় গির্জায় বড়দিনের প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়।
বড়দিনের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে সিটি মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বড়দিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছেন, সুদীর্ঘকাল থেকে চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক সস্প্রীতি বিরাজমান রয়েছে। এখানে সকল ধর্ম–বর্ণের লোক সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করছে এবং একে অপরের ধর্মীয় উৎসবে আনন্দঘন পরিবেশে যোগদান করে আনন্দকে ভাগাভাগি করে নেয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশে সকল সম্প্রদায়ের লোক স্বাধীনভাবে নিজ–নিজ ধর্মের আচার অনুষ্ঠান পালনের অধিকার ভোগ করছেন। মেয়র খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা নিজেদের সংখ্যালঘু ভাববেন না। আমরা সব সময় আপনাদের পাশে আছি, আপনাদেরকে সাথে নিয়েই আমরা দেশ গঠনে এগিয়ে যেতে চাই।
পাহাড়ের খ্রিস্টান পল্লীতে উৎসবের আমেজ : বড়দিন উদযাপনকে ঘিরে পাহাড়ের খ্রিস্টান পল্লীগুলোতে চলছে উৎসবের আমেজ। রাঙ্গামাটি শহরের ৭টি খ্রিস্টান পল্লীসহ জেলার বিলাইছড়ি উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় উৎসব মুখর পরিবেশে পালিত হচ্ছে বড়দিনের নানান আয়োজন। গির্জাগুলোকে ফুল দিয়ে আকর্ষণীয় নানান রঙে সাজানো হয়েছে, করা হয়েছে বর্ণাঢ্য আলোকসজ্জা।
রাঙ্গামাটির ক্যাথলিক চার্চের পাল পুরোহিত ফাদার মাইকেল রয় বলেন, অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে এবার পাহাড়ের খ্রিস্টান পল্লীগুলোতে পালিত হচ্ছে শুভ বড়দিন। পাহাড়ের শান্ত পরিস্থিতিতে সকল মানুষ যাতে সুস্থ ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে বসবাস করতে পারে প্রভু যীশুর জন্মদিনে এমনটাই প্রার্থনা।
বান্দরবান : বান্দরবান প্রতিনিধি জানান, বান্দরবানে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা নানা আয়োজনে উদযাপন করেছে শুভ বড়দিন। গতকাল রোববার সকাল থেকে জেলা সদরে ব্যাপটিস্ট গির্জা ও ফাতেমা রানী ক্যাথলিক গির্জায় আয়োজন করা হয় সমবেত প্রার্থনা। সমবেত প্রার্থনায় আগামী দিনের অনাগত সুখের জন্য বিশেষ প্রার্থনা করা হয়। প্রার্থনায় নতুন বছরের সুখ শান্তির প্রত্যাশার পাশাপাশি সমবেত সংগীতের মধ্য দিয়ে যীশুর বিভিন্ন দিক নির্দেশনা তুলে ধরেন বান্দরবান ফাতিমা রানী ক্যাথলিক গির্জার পাল পুরোহিত ফাদার বিনয় গমেজ সিএসসি।
রাঙ্গুনিয়া : রাঙ্গুনিয়া প্রতিনিধি জানিয়েছেন, চন্দ্রঘোনায় বড়দিন অনুষ্ঠানে সমপ্রতির উৎসবে মেতেছে সকলে। বড় দিন উপলক্ষে রাঙ্গুনিয়া– কাপ্তাইয়ের সীমান্তবর্তী চন্দ্রঘোনা খ্রিস্টান পল্লীতে নানা আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে পালন করা হয়েছে বড়দিন। চন্দ্রঘোনা ব্যাপ্টিস্ট চার্চ সংঘের আয়োজনে মিশন হাসপাতাল সংলগ্ন চার্চে সমবেত প্রার্থনা, খ্রীষ্ট সংগীত পরিবেশন এবং কেক কাটা হয়। চার্চের পালক রেভারেন্ট সখরিয় বৈরাগী সমবেত প্রার্থনা পরিচালনা করেন। এ সময় কেক কাটা উদ্বোধন করেন হিড বাংলাদেশ অপারেশন ডিরেক্টর ডা. সুবীর খিয়াং।
চার্চের সাধারণ সম্পাদক বিজয় মারমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন চন্দ্রঘোনা খ্রিস্টিয়ান হাসপাতালের পরিচালক ডা. প্রবীর খিয়াং, বি বি সি এস কাউন্সিলর মাসংফ্রু, হাসপাতালের আমেরিকান চিকিৎসক জোনাথন এগল প্রমুখ। এদিকে চন্দ্রঘোনা কুষ্ঠ আশ্রম চার্চে সমবেত প্রার্থনা ও খ্রীষ্ট সংগীত পরিবেশন করা হয়। সমবেত প্রার্থনায় দেশ ও জাতির সমৃদ্ধি কামনা করা হয়।
বোয়ালখালী : বোয়ালখালী প্রতিনিধি জানান, বড়দিন উপলক্ষে বোয়ালখালীতে বসবাসরত খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের গির্জা পরিদর্শন ও তাদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও শুভেচ্ছা বিনিময় করেন লোক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিনয় বাঁশী শিল্পী গোষ্ঠীর একটি প্রতিনিধি দল। এতে নেতৃত্ব দেন বিনয় বাঁশী শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও সাধারণ সম্পাদক ছড়াকার শিল্পী বিপ্লব জলদাস, সহ–সাধারণ সম্পাদক বকুল বড়ুয়া, সাংস্কৃতিক সম্পাদক মো. খোরশেদ আলম চৌধুরী প্রমুখ। এ সময় তাদের স্বাগত জানান গির্জার যাজক ফাদার সজল, সভাপতি জন রড্রিঙ, সাধারণ সম্পাদক কিনেন গোমেজ। উপস্থিত ছিলেন রবিন রড্রিঙ, জেরেট গোমেজ, জেভিয়ার গোমেজ, গিলবার্ট গোমেজ প্রমুখ।