প্রতিবছর বর্ষা মৌসুম এলেই পাহাড় থেকে অবৈধ বসতি সরাতে প্রশাসনের তোড়জোড় শুরু হয়। পাহাড়ের অবৈধ বসতি উচ্ছেদ করার জন্য কোমর বেঁধে মাঠে নামে জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কিন্তু পাহাড় দখল, কর্তন কিংবা বসতি নির্মাণ কোনটিও কমছে না। সময়ের ব্যবধানে পাহাড়ে অবৈধ বসতি দিন দিন বাড়ছে। তাছাড়া প্রতিবছর ঘটে পাহাড় ধসের ঘটনাও। চলতি বছর এখনো উল্লেখযোগ্য পাহাড় ধসের কোন ঘটনা না ঘটলেও বিগত বছরগুলোতে মহানগরীসহ চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় ধসে নিয়মিত প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এখন প্রশ্ন উঠেছে সিলেট, চট্টগ্রামসহ পার্বত্য অঞ্চল পাহাড় বেষ্টিত হলেও চট্টগ্রামে পাহাড় ধস বেশি কেন?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো বয়সে অপেক্ষাকৃত নবীন। আবার চট্টগ্রামের বেশিরভাগ পাহাড়ের মাটি বালিমিশ্রিত। যে কারণে ভারী বৃষ্টিতে পাহাড়ের সম্মুখ দিকে পানি ঢুকে অল্পতেই ধসের ঘটনা ঘটে। তাছাড়া পাহাড়ের বনে গাছ কেটে বন উজাড় করার কারণে এবং পাহাড়ের প্রচলিত কৃষি ব্যবস্থা জুম চাষের পরিবর্তে লাঙ্গল-কোদালের চাষ করার ফলে পাহাড়ে ধস বাড়ছে। আবার চট্টগ্রাম মহানগরী ও আশেপাশের পাহাড়গুলো অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাটার কারণে বর্ষাকালে পাহাড়ধস হচ্ছে। অন্যদিকে প্রকৃতিগতভাবে চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো বালুময় পাহাড়। বয়সেও নবীন এসব পাহাড়ের ভেতরে অনেক ফাটল রয়েছে। তাই অতি বৃষ্টির কারণে প্রাকৃতিকভাবেই ফাটলগুলোতে পানি ঢুকে পাহাড় ধস ঘটছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ছিন্নমূল মানুষদের কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকে না। তাই তারা খরচ বাঁচানোর জন্য এসব ঝুঁকিপূর্ণ জায়গাতেই বসবাস করছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থানীয় এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে এ বসতিগুলো নির্মাণ করে থাকেন। এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক মো. নূরুল্লাহ নূরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘পাহাড়গুলো খাড়াখাড়ি অবস্থায় থাকে। বসতি নির্মাণের সুবিধার জন্য অনেকে পাহাড় কাটে। পাহাড় কাটতে হলে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু চট্টগ্রামে সরকারি বেসরকারি যেসব পাহাড় রয়েছে, তার বেশিরভাগই সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর নিয়ন্ত্রণে নেই। এতে প্রভাবশালীরা সুবিধাজনকভাবে দখল করে বসতি নির্মাণ করেছে। কম খরচে কাঁচাঘর নির্মাণ করার কারণে পাহাড়গুলো যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয় না। ফলে ধসের ঘটনা ঘটে।’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক অলক রায় দৈনিক আজাদীকে বলেন, চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোর বয়স খুব বেশি নয়। ভারতের কাশ্মীর কিংবা নেপালের হিমালয় পর্বতের সমগোত্রীয় হলেও চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোর বয়স কম। এগুলো টার্শিয়ারি সময়যুগের পাহাড়। যে কারণে চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোর গঠন এখনো মজবুত নয়। এজন্য সামান্য বৃষ্টি হলে, ভূমিকম্পজনিত সামান্য ঝাকুঁনিতে পাহাড়গুলো ধসে পড়তে পারে।
মহানগরীর অভ্যন্তরেসহ প্রায় চারিদিকে পাহাড় রয়েছে চট্টগ্রামে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম মহানগরীর জনপ্রিয় প্রায় সবগুলো এলাকাতেই পাহাড় রয়েছে। এরমধ্যে ডিসি হিল, বাটালি হিল, পরীর পাহাড়সহ বেশ কিছু পাহাড় সংরক্ষণ করা হলেও অসংখ্য পাহাড় রয়েছে সংরক্ষনের বাইরে। সরকারি ও বেসরকারি মালিকানাধীন এসব পাহাড় সংরক্ষণের দীর্ঘমেয়াদী কোন পরিকল্পনাও চোখে পড়ে না। এতে সবুজ পাহাড়গুলোতে ভূমিখেকোদের কু নজর এড়াতে পারছে না প্রশাসনও।
সরেজমিনে দেখা যায়, নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী, খুলশী, আকবরশাহ, পাহাড়তলী, কোতোয়ালী ছাড়া নগরীর সংযোগস্থল সীতাকুণ্ড ও হাটহাজারী এলাকায় বিস্তীর্ণ পাহাড়গুলোতে দখল ও বসতি নির্মাণ থেমে নেই। আবার ফিরোজশাহ পাহাড়, মতিঝর্ণা ও বাটালী হিলের পাহাড় নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা থাকলেও মামলাগুলো নিষ্পন্ন করার কার্যকর কোন উদ্যোগও নেই। বছরের বেশিরভাগ সময় কোন মাথাব্যথা না থাকলেও বর্ষাকালে পাহাড়গুলোতে ধস হয় বলে মে থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়ে তৎপর থাকে প্রশাসন। ভারী বৃষ্টির সময়ে নগরীতে অনেকটা ঢাকঢোল পিঠিয়ে বসতিগুলো থেকে লোকজনকে সরানো হলেও পরের দিন পুনরায় আগের বসতিতে ফিরে যান তারা। এতে পাহাড়ের অবৈধ উচ্ছেদের সুফল পাওয়া যায় না।
এদিকে গত ৯ মে চট্টগ্রামে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সর্বশেষ ২১তম সভায় পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে নগরীর ১৮টি পয়েন্টে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার জন্য সুপারিশ করেন। তন্মধ্যে ফিরোজশাহ পাহাড়েই তিন হাজার পরিবার রয়েছে বলে জানান পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। মতিঝর্ণা ও বাটালী হিলের পাহাড়ে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৬২টি পরিবার দেখানো হলেও সভায় পরিবেশ অধিদপ্তর ওই পাহাড়ে দুই হাজারের বেশি পরিবার রয়েছে বলে উল্লেখ করেন।