চট্টগ্রামের নদীসম্পদ

ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী | বৃহস্পতিবার , ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৬:০১ পূর্বাহ্ণ


আনন্দ-বেদনা, বিষাদ- বিলাপ- বিহ্বলতার সামাজিক সংগী নদীমাতৃক বাংলাদেশের বাহারি নামের বৈচিত্র্যময় সুসমায় সুরভিত, সুশোভিত, সুবেশিত, সুকান্ত সুরূপময় নদী সম্ভার। জীবনেরসত্তা, বিত্ত-বৈভব, সুখের প্রবাহ, শোকের আবহ, লাস্যময়ী, হাস্যময়ী, রহস্যময় আমাদের নদী। নামের বৈচিত্র্যময় নান্দনিকতায়, রসময় প্রবাহ মাধুর্যতায়, নদী এদেশের সামাজিকতার, পরিবেশের ভূ-সম্পদের,অর্থ আর বাস্তুতান্ত্রিকতার প্রাণকেন্দ্র।
ধানে, গানে, বানে, বৈভবে ঋতুর বৈচিত্রতায় নদীর বৈচিত্র পরিবর্তিত রূপ মাধুর্য এদেশের মানুষের মন ও মননে, প্রাণে ও স্পন্দনে, গান ও গুঞ্জরণে সারাবছর বিচিত্র ভাব ও আবেশের অবতারণা করে।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশের প্রাচুর্যের মহিমামণ্ডিত সমৃদ্ধ অঞ্চল। হাজার বছর আগের সংস্কৃতি ও সামাজিকতার দৃষ্টিনন্দন বৈশ্বিক, আলোড়ন সৃষ্টিকারী সমুদ্র ঘেঁষা জনপদ। সাগরের উদারতা, নদীর নান্দনিকতা খাল-হ্রদের বৈচিত্রতা চট্টগ্রামকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নান্দনিক বৈভব দিয়েছে। লালন করেছে ঐশ্বরিয় ঐশ্বর্য। পাঁচশত বছর আগে পর্তুগিজরা এর নামকরণ করেছে প্রাচ্যের রানী।
সবুজ সুউচ্চ পাহাড়ের নির্মল উদারতা, সবুজ, সুকান্ত আকাশের সাথে মিতালী, বিস্তৃত নীল সাগরের জলের সাথে অঙ্গ-অবয়বের ভাগাভাগি, উঁচু-নিচু পাহাড়ের শ্যামসুন্দর হৃদ্যতা এই অঞ্চলের মানুষকে করেছে প্রকৃতির অকৃত্রিম বন্ধু, সাগরের সখা। এভাবেই এ অঞ্চলের মানুষ প্রকৃতির বন্ধু হয়েছে, প্রাকৃতিক হয়েছে, নদী-নালা খাল-বিল সাগরের সাথে অকৃত্রিম বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে।
প্রকৃতির সাথে, খাল-নদী হ্রদ, সাগরের সাথে এ অঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন আচার, সামাজিকতা ও সংস্কৃতি প্রভৃতির যে হৃদ্যতা, তা অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে মিলানো ভার।
সবুজ সুউচ্চ পাহাড়ের নান্দনিকতার সাথে নদীর কূল কূল রবে বয়ে যাওয়ার বৈচিত্র এ অঞ্চলের সামাজিকতাকে করেছে পুষ্ট, আঞ্চলিকতাকে করেছে হৃদ্দ, হৃষ্ট।
রাজকন্যার হারিয়ে যাওয়া কানের ফুল থেকে কর্ণফুলী, রহস্যে ঘেরা, রহস্য ভরা। পাহাড় থেকে নৃত্যের তালে নেমে আসা সাঙ্গু, সাগরের কাছে আসতে ক্রমেই বিস্তৃত। নান্দনিক মাতামুহুরী, মায়ের সাথে নামের সংযুক্তি। বিস্তৃত অববাহিকা। বাঁক ও পাক ঘুরে বাঁকখালী, কার্প জাতীয় মাছের নির্ভরতার হালদা নদী।
মাইনি, কাসালং, রাইনখিয়াং, ইছামতীর মতি সাবলীল, লিকলিকে গড়নের চিরসবুজ নদী। তারুণ্যের মায়াময় চঞ্চলতায় ভরা। শীত-গরম, বর্ষা- বাদলে মায়াবতী আবেগধারী। ছন্দময় গতি নিয়ে নান্দনিক পাহাড়ি এসব নদীর নূপুর পায়ে নেচে নেচে চলা দৃষ্টিনন্দন আবেগ ও অনুভূতির অফুরন্ত উৎস।
কর্ণফুলীকে নিয়ে নজরুলের কবিতা বন্দনায়,
‘ওগো কর্ণফুলী
তোমার সলিলে পড়েছিল কবে কার কানফুল খুলি
তোমার স্রোতের উজান ঠেলিয়া কোন্‌ তরুণী,
কে জানে সম্পান নায়ে ফিরেছিল তার দয়িতার সন্ধানে।’
অথবা মিথের কথা,

পাহাড়ি কন সুন্দরী মাইয়া
ঢেউ অর পানিত যাই,
সিয়ান গড়ি উডি দেখের
কানের ফুল তার নাই,
যেইদিন কানের ফুল হাজাইয়ে
হেইদিনত্তুন নাম কর্ণফুলী।
এ হলো কর্ণফুলীর কথা। অনন্ত যৌবনা ছোট-বড় বিভিন্ন দৈর্ঘ্য ও আকারের অন্যান্য নদীগুলো চট্টগ্রামের সম্পদ, সম্ভার, সামাজিকতা, লোকাচার লোকসংস্কৃতি এবং নান্দনিকতার উপকরণ, অলংকার। মিলেমিশে জল ভাগাভাগি করে সাগরে পৌঁছে দেয়া নিরন্তর কর্মে সম্পৃক্ত এই নদীগুলো।
বৃহত্তর চট্টগ্রামের ছোট-বড় নদীগুলো বাহারি নামে, বৈচিত্র্যময় ঢঙে, ছন্দময় তালে, বর্ণময় চলন-চালে, প্রকৃতির সাথে, প্রতিবেশের আবহে প্রায় সারা বছর বঙ্গোপসাগরের দিকে উদাসী পথ চলে। চলার ছন্দে প্রকৃতির আনন্দে, ঋতু বৈচিত্রের পরশ অঙ্গে মেখে বয়ে চলে উদাসী পথিকের মত।
এ সব ছাড়াও ফেনী, মুহুরী, মাইনী, চিংড়ি, নাফ, চাঁনখালী, ধুরং, ডলু, জিলাইছড়া, সুকছড়া, গংগাছড়া, ইছাখালী, রেজু, ঈদগা, মহেশখালী চ্যানেল, কুতুবদিয়া চ্যানেল, কোহেলিয়া, মানিকছড়ি, থেগা, হারবাংছড়ি, ছোট হরিণা, বড় হরিনা, শিজখ, কাপ্তাই লেক, বোয়ালখালী বৃহত্তর চট্টগ্রামের সংবেদনশীল নান্দনিক নদী।
কোনটির নাম অঞ্চলের নামে, কোনটির নাম অজানা বিলাসের অফুরন্ত উচ্ছ্বাস ও ভলোবাসায় স্নাত। প্রকাশই প্রলুব্ধ করে মনন ও চেতনাকে।
আমাদের নদী আমাদের আনন্দ বেদনার প্রাকৃতিক- প্রবাহ। দুঃখ-বেদনা বইয়ে নেয়ার সামাজিক স্রোত। প্রাত্যহিক বেদনা- বিসংবাদের জলাঞ্জলি নদীর প্রবাহ। অপবিত্রকে বুকে নিয়ে পুতপবিত্র করার মহাকালের মহাস্রোত। আমাদের নদী আমাদের দুঃখ-বেদনা ভুলিয়ে জীবনকে নতুন করে স্বপ্নবান করার অনন্ত আধার, সচল সার্বজনীন প্রয়াস। আমাদের নদী আমাদের নিভর্রতা, নিশ্চয়তা, জীবনের সার্বজনীন প্রবাহ।
বাংলাদেশের মানুষের জীবনে এমন সব নদীর নান্দনিক যে প্রভাব, তা কোন কালের পরিসীমায় আবদ্ধ বা পরিমিত নয়।
নান্দনিক হাজার নদীর দেশে, বৈচিত্রময় নামের ব্যঞ্জনা যে ঝংকার তুলে তুলে এদেশের মানুষকে আবেগী, আয়েশি, আবেশী, আত্মপ্রত্যয়ী, আত্মভিমানী করে তুলেছে, তা হাজার বছরের যাপিত জীবনের পথ পরিক্রমায় বিমূর্ত।
মহাকালের ইতিহাসের পথে পথে, বাঁকে বাঁকে আলোকিত মঞ্জরী আমাদের নদী। নদীর সাথে এ ভূখণ্ডের মানুষের সম্পর্ক তাই এতো নিবিড়, অবিচ্ছেদ্য, জীবন্ত, প্রাণবন্ত, অনন্ত।
বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের নদী নাফ। রোহিঙ্গা বিড়ম্বনার নদী। প্রায় ৬৩ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীটি বাংলাদেশ মিয়ানমারের সীমান্ত নদী। চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান নদীগুলোর অন্যতম। আকারের সাকারে নদীটি একেবারে ছোট নয়। নাফনদীর মোহনার দৈর্ঘ্য প্রায় ৫৬ কিলোমিটার। এর প্রস্থ প্রায় ৩ কিলোমিটার। কেওড়া বাগান, চিংড়ি প্রকল্প, লবণ মাঠ, বাইন বাগান, মাছ এবং জলজ সম্ভারে সমৃদ্ধ নদীটি। জল জীববৈচিত্রের বিপুল সম্ভারে পরিপূর্ণ দক্ষিণ বাংলাদেশের এই নদী চট্টগ্রামের নদী সম্পদের অন্যতম প্রধান।
আন্তঃ সীমান্তের অস্থিরতা নদীটির সম্পদ- সম্ভারে চাপ সৃষ্টি করে রেখেছে। বিভিন্ন প্রজাতির মাছ এবং জল সম্পদে পরিপূর্ণ নদীটি। আন্তর্জাতিক নদীটি মিয়ানমারের উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল থেকে উৎপন্ন হয়ে বাংলাদেশের কয়েকটি উপজেলাকে স্পর্শ করে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। এর মুখেই প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিন্স। নদীটির গড় গভীরতা প্রায় ৪০ মিটার। সর্বোচ্চ গভীরতা প্রায় ১২০ মিটার। নদীটির অর্থনৈতিক পরিচর্যা অপরিহার্য। সম্পদ-সম্ভারকে পরিচর্যা এবং তদারকি না করলে, তা থেকে সুফল আশা করা যায় না।
মাতামুহুরী বৃহত্তর চট্টগ্রামের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী। এক সময় ছিল দুই তীরের মানুষের জন্য আশীর্বাদ। বর্ষায় রুদ্র মূর্তি ধারণ করে। উৎপত্তি বৃহত্তর চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার সীমান্তের পাহাড়ি এলাকা লুসাই পাহাড় থেকে। নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১৭০ কিলোমিটার। একসময়ের সম্পদ সম্ভারে ভরপুর হলেও বর্তমানে নদীটি স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। তামাক চাষ, পাহাড় নিধন, বৃক্ষ নিঃশেষ, পাথর উত্তোলন, উজানের পাহাড়ি ঢল তামাক চাষের বিষ ও কীটনাশক নদীটির প্রাকৃতিকতাকে নষ্ট করেছে। পানিকে দূষিত করেছে। জলসম্পদকেও স্বাভাবিক থাকতে দেয়নি। বৃহত্তর চট্টগ্রামের নদী সম্পদের এই সম্ভারকে বিপদাপন্নতা থেকে সুরক্ষা দিয়ে প্রকৃতি ও প্রতিবেশকে জাগিয়ে রাখাটা অত্যন্ত জরুরী। মারমা জাতিগোষ্ঠীর প্রাণের নদী মাতামুহুরীকে তারা নাম দিয়েছে ‘মুড়ি খিয়ঙ’।
অতীতে নদীটির গভীরতা ৩০ থেকে ৪০ ফুট এবং প্রস্থ ৫০০ থেকে ৭০০ ফুট থাকলেও বর্তমানে তা নেই। অর্ধেকে চল এসেছে এর গভীরতা। কোন কোন জায়গায় নদী ভাঙ্গনের কারণে প্রস্থ হাজার বারশত ফুট হয়েছে। নদীর এই উচ্ছৃঙ্খলতা ও অস্বাভাবিকতা এর প্রতি অত্যাচারের, অনাচারের প্রকাশ। বৃহত্তর চট্টগ্রামের এই সম্পদটি সুরক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি।
বৃহত্তর চট্টগ্রামের বান্দরবানের প্রধান নদী সাঙ্গু। একে শঙ্খ নদীও বলা হয়। ১১ নৃগোষ্ঠীর ১৪ সমপ্রদায়ের বসবাস এই নদীর তীর ঘেঁষে। দৈর্ঘ্য প্রায় ২৭০ কিলোমিটার। মিয়ানমার সীমান্তের মদক পাহাড় থেকে এর উৎপত্তি। পাহাড়ি সংস্কৃতির অন্যতম মাধ্যম এ নদী। প্রতিবেশের মানুষের সুখ-দুঃখের দোলাচলের সাংবাৎসরিক সাথী এই নদী। খরস্রোতা নদী হওয়ায় এই নদী বর্ষায় ক্ষয়প্রাপ্ত মাটি বহন করে। একসময়ের বিস্তৃত নদী এখন কিছুটা সংকুচিত। নাব্যতা সংকট দেখা যায় শুকনো মৌসুমে। নদীর অববাহিকা বিস্তৃত জুমচাষের অঞ্চল। বর্তমানে তামাক চাষে বিপন্ন। নদীটি সম্পদ থেকে সংকটে রূপান্তরিত হচ্ছে। খরস্রোতা নান্দনিক নদী এটি। পাহাড়ের সুখ-দুঃখ বয়ে নিয়ে বঙ্গোপসাগরে পৌঁছে দেয় সারাবছর। মাটির ক্ষয়ের কারণে নদীটি দৈহিকভাবে শুকনা মৌসুমে সংকটাপন্ন থাকে।
পরিচর্যার মাধ্যমে দিয়ে এই অঞ্চলের মানুষের জন্য নদীটিকে দূষণমুক্ত রাখা, দখলমুক্ত রাখা, তামাক চাষমুক্ত রাখা, সার কীটনাশকের ছোবল থেকে রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। একসময়ের সম্পদ সম্ভার নদীটি ক্রমেই বিপন্নতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সভ্য সমাজে নান্দনিকতার আবহে এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। নির্বিচারে পাহাড় কাটা, বন উজাড় করা, পাহাড়ের ঝিরি-ঝরনা, ছড়া-খাল থেকে পাথর উত্তোলন নদীটির বিপন্নতার জন্য দায়ী। বৃহত্তর চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক এই সম্পদকে সুরক্ষা দেয়া জরুরি।
বৃহত্তর চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ির প্রধান নদী মাইনী। দৈর্ঘ্য প্রায় একশত দশ কিলোমিটার। রিয়াঙদের নির্ভরতার স্থল। ঐতিহাসিক বিভিন্ন নৃজাতিগোষ্ঠীর আবাসস্থল ছিল এই মাইনী নদী। ছিল নৌপথের যাতায়াত মাধ্যম। ত্রিপুরা রাজ্য থেকে সৃষ্ট নদীটিকে সময়ের ব্যবধানে বিপন্ন নদীতে পরিণত করা হয়েছে অথচ নদীর সম্পদের অনন্য উৎস ও মাধ্যম ছিল নিবিড় পাহাড়ের পাহাড়ি কন্যা মাইনী নদী। মাটির ক্ষয়, বালি উত্তোলন, জুমচাষ, পাথর উত্তোলন, পাহাড়-কাটা, দুইতীরে তামাক চাষ, সার কীটনাশকের ব্যবহার, প্রকৃতি-পরিবেশ বিড়ম্বনা নদীটিকে শুকনো মৌসুমে আর নদী থাকতে দিচ্ছে না। ছন্নছাড়া জীবনের বিপন্নতার প্রতীক খাগড়াছড়ির মাইনী নদী। বৃহত্তর চট্টগ্রামের নদী সম্পদের গুরুত্বপূর্ণ এই নদীকে সুরক্ষিত করে ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনা যায়।
নামেই কমনীয়, রমনীয় কোহেলিয়া নদী চট্টগ্রামের বাঁশখালী অঞ্চলের নান্দনিক নদী। ছোট্ট পরিসরে নাতিদীর্ঘ নদীটি উন্নয়ন বিড়ম্বনার শিকার হয়ে বিপন্নতার বিহ্বলতায় ঐতিহ্য আর ঐশ্বর্যকে হারিয়ে ফেলছে।
বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে বয়ে যাওয়া শান্ত মলয়া নদীটিকে বজের্র দূষণ থেকে, দুর্জনের আগ্রাসন থেকে, উন্নয়নের বিড়ম্বনা থেকে সুরক্ষা দেয়া দরকার।
নামের নান্দনিকতায় ইছামতী অন্য একটি নদী। স্বদেশী নদী। আমাদের ছোট নদীর একটি নদী। দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০ কিলোমিটার। প্রস্থও সীমিত। গড় প্রস্থ ৩০ মিটার। রাঙ্গামাটি জেলার কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়ন থেকে উৎপন্ন। দুই পাড়ের মানুষের বিড়ম্বনায়, বর্জ্যের বেসাতিতে নদীটি বিভ্রান্ত, বিপদগ্রস্ত, মুমূর্ষু। বিড়ম্বনার অন্যতম অনুষঙ্গ রাবার ড্যাম। বালু উত্তোলন। পার্শ্ববর্তী কৃষি জমিতে সার কীটনাশক ব্যবহার এবং দখলদারদের উৎপাত। ছোট নদীর প্রতি বড় অত্যাচার নদীটিকে বিপন্ন করে তুলেছে। উত্তর চট্টগ্রামের এই সম্পদটিকে সুরক্ষিত করা আমাদের দায়িত্ব।
কাচালং। পাহাড়ি নাম। পাহাড়ি নদী। ভারতের মিজোরাম থেকে উৎপত্তি। দৈর্ঘ্য প্রায় দেড়শ কিলোমিটার। প্রস্থ ৮০ মিটার এর অধিক নয়। এই নদীর পানি অববাহিকা অঞ্চলের কৃষি কাজের অন্যতম সহায়ক। নদীমাতৃক বাংলাদেশ তার ভূমিকে যেভাবে উর্বর রাখছে, তাতে এ নদীগুলোর অবদান কোন অংশেই কম নয়। অপরিকল্পিতভাবে ছোট ছোট এই নদীগুলোতেও প্রকল্প নেয়া হয়। নদীর স্বাস্থ্যকে বিবেচনা না করে। সমৃদ্ধি ও ভবিষ্যতের কথা বিবেচনায় নেয়া হয় না। নদীকে শাসন করা হয়। নদীর টুঁটি চেপে ধরা হয়।
সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রার পথে বাংলাদেশের এই নদীগুলোকে সুরক্ষিত না করলে, পরিবেশের বিপর্যয় নিয়ে, বিপন্নতার বেদনা নিয়ে আমাদের প্রকৃতি বিপন্নতার জন্য হা-হুতাশ করা ছাড়া আর কিছুই অবশেষ থাকবে না। নদীর প্রতি সদাচরণ করে ভবিষ্যতের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যথায় আমাদের আজ ও আগামীর প্রজন্ম বিপদে পড়বে।
বাঁকে বাঁকে ছন্দময় গতি ও মতির নদী বৃহত্তর চট্টগ্রামের কঙবাজারের বাঁকখালী। চট্টগ্রাম ও আরাকান অঞ্চলকে বিভক্তকারী পর্বতমালা থেকে এর উৎপত্তি। সর্বসাকুল্যে দৈর্ঘ্য ১০৫ কিলোমিটার। যার ৭০ কিলোমিটার বাংলাদেশ অংশের। জোয়ার ভাটার ছন্দে আলোড়িত নদী। পাহাড়ি ঢলের তোরে আন্দোলিত হয়। ভাটি অঞ্চলে বন্যা সৃষ্টি করে। নদীটিকে বহু আগেই রাবার ড্যামের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। লবণ পানিকে প্রতিহত করতে। জলজ সম্পদ সমৃদ্ধ বাঁকখালী প্রায় ৩০ প্রজাতির মৎস্য সম্পদ ধারণ করে এবং উল্লেখযোগ্য প্রায় ১০ প্রজাতির চিংড়িকে লালন করে।
মনে করা হয়, বঙ্গোপসাগরের চার শতাধিক সামুদ্রিক প্রাণী এ নদীর মোহনায় আনাগোনা করে। ডিম ছাড়ে। প্রকৃতি চর্চা করে। মূলত কক্সবাজারের প্রধান নদী এবং বৃহত্তর চট্টগ্রামের নদী সম্পদের অন্যতম একটি ছোট নদী বাঁকখালী। নান্দনিক, মায়াবী নদী। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের রক্তাক্ত যুদ্ধসাক্ষী নদী।
হালদা কর্ণফুলীর একটি শাখা নদী। রামগড়ের পাতাছরা ইউনিয়ন থেকে শুরু হয়ে প্রায় ১২৫ কিলোমিটার পথ পরিক্রমা করে এটি কর্ণফুলী মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরের সাথে মিলিত হয়েছে। কার্প জাতীয় মাছের অন্যতম প্রজনন কেন্দ্র। নদীর দৈর্ঘ্য বিভিন্ন বাঁক কেটে কমানো হয়েছে গত শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে। ভিন্ন কারণে নদীটি আলোচনার শীর্ষে অবস্থান করে মিঠা পানির উৎস কমে আসায় লবণাক্ততায় সংকটাপন্ন নদীটি। প্রকল্প বিড়ম্বনা অথবা পরিকল্পনার ঘাটতির কারণে ক্রমেই নদীতে মৎস্যরেণু সম্পদের বিপন্নতার সৃষ্টি হচ্ছে। চট্টগ্রামের অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ এই নদীটির প্রতি যথার্থ দৃষ্টিভঙ্গি দেয়া প্রয়োজন।
কর্ণফুলী অর্থকরী নদী। হাজার বছরের চট্টগ্রামের নির্ভরতার নদী। এ নির্ভরতা সামাজিক, সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক, আঞ্চলিক, প্রতিবেশ এবং পরিবেশ কেন্দ্রিক। বহুমাত্রিক সম্পদ-সম্ভারে পরিপূর্ণ নদীটি।
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান সোপান চট্টগ্রাম বন্দর। কর্ণফুলীর বুকে দাঁড়িয়ে দেশের বৃহত্তম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে যাচ্ছে এবং বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে তুলে ধরছে। আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের ৯৮ ভাগ এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৯৩ ভাগ সম্পাদন করে দেশের অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত করে চলেছে লয়েড রেংকিং এ ৬৭ তম অবস্থানে থাকা আমাদের এই নদীকেন্দ্রিক দেশের বৃহত্তম বন্দর। আমাদের সমৃদ্ধির সোপান। এগিয়ে চলার প্রত্যয়।
বাংলাদেশের প্রান্তীয় জনপদ চট্টগ্রাম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য-সম্ভারের অনুপম আধার। সাহিত্যিক, শিক্ষানুরাগী, শিল্পানুরাগী নন্দন চেতনার মানুষেরা যুগে যুগে এর বন্দনা করে গেছে। তাদের ভাষায়, “শৈল-কিরীটিনী, সাগর-সোহাগিনী, নদী-নন্দিনী, বনানী-কুন্তলা এই চট্টগ্রাম। যেন এই চট্টগ্রামকে গড়তে প্রকৃতি ছিল উদার-অকৃপণ। সৌন্দর্যের সবটুকু ঢেলে দিয়ে উন্মক্ত মনে প্রকৃতি তৈরি করেছে এই চট্টগ্রাম। ফিরিঙ্গি বেনিয়াদের কাছেই এর নামকরণ হয়েছে ‘প্রাচ্যের রানী’।
বৈশিষ্ট্যের পরিপূর্ণতা দিয়ে, সৌন্দর্যের আবেশ দিয়ে সমাজ- সংস্কৃতি- রাজনীতি- অর্থনীতি, ধর্ম, গোত্র, ভাষা, সাহিত্য, আন্তরিকতা-আঞ্চলিকতা, নৃতাত্ত্বিকতা, মানব জীবনের বহুমুখী ক্ষেত্র ও পরিসরের উপাদান- উপকরণ দিয়ে তৈরি এখানকার জনগোষ্ঠীর কীর্তি- কর্ম, স্বাতন্ত্র্যবোধ, স্বকীয়তা এবং সংশ্লিষ্টতার সিংহভাগ জলধোয়া নদীকেন্দ্রিক।
আদিকাল থেকে মহাসমুদ্রের উত্তাল আহ্বান শুনে শুনে এদেশের মানুষের হৃদয়কে করেছে নিবিড় নিবেশিত, আবেগ আবেশিত, ধ্যানগম্ভীর। পর্বতের উত্তুঙ্গ শিখর দেখে দেখে মনকে করেছে উদার- উন্মুক্ত- উন্নত।
এ অঞ্চলের মানুষেরা সাগর পাড়ি দিয়ে বাইরের পৃথিবীর সাথে স্থাপন করেছে মিতালী। সকলেরে করেছে আপন। বিশ্বময় বিলিয়েছে আমন্ত্রণ।
প্রকৃতির উন্মত্ততায় বছর বছর ঝড়-ঝঞ্ঝা এখানকার মানুষকে করেছে বিপর্যস্ত- বিভ্রান্ত- বিপদাপন্ন। সাইক্লোন, গোর্কি, জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে তাদের ঘরবাড়ি, অস্থাবর সম্পত্তি, সাজানো সংসার, সুখের বর্তমান। কিন্তু পড়ে থাকেনি তারা। আবার উঠে দাঁড়িয়েছে, স্বপ্ন দেখেছে, ঘর বেঁধেছে, ধান ফসলে মাঠ ভরিয়ে দিয়েছে, নদীর বুকে পাল তুলে গেয়েছে মনের সুখের ছন্দময় গান। সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে প্রাণ জুড়িয়েছে। মনের সুখে গান ধরেছে, ‘দইজ্জার কূলত বসত গরি আয়ারা সিনা দি ঠেগাই ঝড় তুয়ান।’
কোমলে -কঠোরে, শান্তিতে- সংগ্রামে, সৃজনে- মননে চট্টগ্রাম বাংলাদেশের আর সব জনপদ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই চট্টগ্রাম বাংলাদেশসহ এ উপমহাদেশকে দিয়েছে অনেক। বিপ্লবে- সংগ্রামের দুর্জয় চট্টগ্রাম সব সময় এগিয়ে থেকেছে।
কর্ণফুলীর চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী। অর্ধশত নদীর চট্টগ্রাম। এই সব নদী এই অঞ্চলের তথা বাংলাদেশের সম্পদ সম্ভারের, অলংকার অহংকারের বহমান স্রোতধারা। এর কতিপয় শাখা নদী চেঙ্গী, কাচালং, মাইনী, রাইঙখিয়াঙ, হালদা । এবং ছোট নদীর ভিতর কাপ্তাই, ইছামতী, শিলক, বোয়ালখালী, শ্রীমাই প্রভৃতি। বহমান জীবনের আনন্দধারা, সঙ্গীতধারা।
প্রাচ্যের রানী চট্টগ্রাম। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ নগরী। ভৌগোলিকভাবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এবং অনুপম অনুভবে দেশের অনবদ্য স্থানে পরিণত। পাহাড়- সমুদ্র- উপত্যকা- অরণ্য প্রভৃতি নৈসর্গিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক লীলার স্বপ্নময় নিকেতন।
চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি থেকে সাতকানিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকার চাষাবাদে উত্তর দিক থেকে হালদা, পূর্ব দিক থেকে কর্ণফুলী ও শঙ্খ বা সাংগু এবং দক্ষিণ দিক থেকে ডলু নদী পানি যোগায়। জেলার প্রধান নদী কর্ণফুলী। নদীর মোহনায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বন্দর ও পোতাশ্রয়। নাব্যতা, জলবিদ্যুৎ, বাস্তুতান্ত্রিকতা, হালদাকে পানি দেয়া, শিল্পচর্চায় সহযোগিতা, চাষবাসের সহযোগিতা, মাটি উর্বর রাখা, চট্টগ্রাম শহরের পানির চাহিদা মেটানো, এ নদীর দৈনন্দিন কর্ম। এভাবেই এ নদী এ অঞ্চলের সম্পদ-সম্ভার হয়ে আছে।
বাংলাদেশের জাতীয় কোনো নদী নেই। আমাদের দেশের নদীগুলো বিভিন্ন কারণে, সামাজিকতায়, সংস্কৃতিতে, জীবনাচারে, নামের নান্দনিকতায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্ব ও ঐতিহাসিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে বিবেচনা করলে কোনো-না-কোনোটিকে এগিয়ে রাখতে হয়। সেই বিবেচনায় বিভিন্ন কারণে এগিয়ে থাকে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশের পাহাড়ি নদী কর্ণফুলী। বিভিন্ন বিবেচনায় খরস্রোতা এই নদীটিকে জাতীয় নদীর সম্মানে সম্মানিত করা যায়। বিভিন্নভাবে এই বক্তব্যের পক্ষে বিভিন্ন গ্রহণযোগ্য যৌক্তিকতাকে তুলে ধরা যায়।
কর্ণফুলী বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী নদী। এ নদী জাতীয় অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রাখে সারাবছর। কর্ণফুলী নদীর উপরে যে বন্দর প্রতিষ্ঠা তাকে সমুদ্র বন্দর বলা হলেও, আসলে এটি কর্ণফুলী নদী বন্দর। বন্দর এবং কাস্টমস মিলে জাতীয় অর্থনীতিতে ৩৪ ভাগ অবদান রাখে এই নদী। জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে এই নদীর অবদান সবচেয়ে বেশি। এই নদীকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রবেশদ্বার বলা হয়ে থাকে প্রাগৈতিহাসিক সময় থেকে। এই নদী এবং নদীর মোহনা যে ঐতিহ্য বহন করে, তা হাজার বছরের। এই নদীকেন্দ্রিক আয় থেকে বছরে দুই হাজার কোটি টাকা বেশি রাজস্ব অর্জিত হয়। দেশের বহির্বাণিজ্য এবং আন্তঃবাণিজ্যের শতকরা ৯৮ ভাগ এই নদীর মাধ্যমে অর্জিত হয়।
নদীর উপরে প্রতিষ্ঠিত এই বন্দরটি বিশ্ব রেঙ্কিংয়ে ৬৭তম। বাংলাদেশ অংশে দীর্ঘ ১৮৭ কিলোমিটারের পথপরিক্রমায় এই নদীর সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে সতের নৃগোষ্ঠীর চলমান ঐতিহ্য। সংস্কৃতিতে, সামাজিকতায়, অর্থনীতিতে, পরিবেশ প্রতিবেশে এই নদীর হাজার বছরের ঐতিহ্য আছে। কর্ণফুলী নদীর বিস্তৃত মোহনা অত্যন্ত উর্বর। বিভিন্ন প্রজাতির মাছের জীববৈচিত্র্য ফ্লোরা, ফাওনা, প্লাংটন, বেনথোসে সমৃদ্ধ অতি উর্বর একটি অঞ্চল এ নদীর মোহনা। দেশের একমাত্র নদী যার সাথে এই অঞ্চলের ১৭টি শিল্পজোন এবং প্রায় সাড়ে তিনশত ছোট-বড় শিল্পের সংযুক্তি আছে।
উত্তর পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাম্পান সংস্কৃতির নদী কর্ণফুলী। নদীটিকে দেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড এবং প্রাণ প্রবাহ বলা হয়। এদেশের মানুষ বিশ্বাস করে, কর্ণফুলী বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। দেশের একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী, যার তলদেশ দিয়ে হাজার বছরের ঐতিহ্যের টানেল রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে। এই নদীর সাথে সম্পৃক্ত-সংশ্লিষ্ট কয়েকটি নদীকে পানি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে এই কর্ণফুলী। ঐতিহ্যবাহী হালদা নদীকে পানি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে এই কর্ণফুলী। কর্ণফুলী নদীর ভাল-মন্দের উপর হালদা নদীর ভালো-মন্দ নির্ভর করে। হালদার যা ঐতিহ্য তার সর্বাংশ জুড়ে কর্ণফুলী নদী। কর্ণফুলী নদীর উপরে বাঁধ দিয়ে দুইশত ত্রিশ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয় প্রায় শতবর্ষ যাবত।
এই নদীর বাঁধের অপর অংশে কাপ্তাই লেক থেকে বছরে ১৩ হাজার মেট্রিক টন মিঠা পানির মাছ সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়া হয়। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধার রক্তে, এদেশের মুক্তিকামী মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে কর্ণফুলী নদীর পানি। দুনিয়া কাঁপানো অপারেশন জ্যাকপট এই নদীর জলের উপরেই সংঘটিত হয়েছিল। সাম্পান মাঝির জীবন চিত্রিত হয়েছে গানে, সিনেমায় বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় এই নদীকে কেন্দ্র করে।
এভাবে সংস্কৃতিতে, সামাজিকতায়, অর্থনীতিতে, গানে, কবিতায়, আচারিক প্রক্রিয়ায়, ইতিহাস-ঐতিহ্যে কর্ণফুলী এ অঞ্চলের, এদেশের মানুষের জীবনাচারে অতীত ও বর্তমানে নিবিড়ভাবে সংশ্লিষ্ট, সম্পৃক্ত, অবিচ্ছিন্ন। আর তাই বিভিন্নভাবে এ নদীর গুরুত্ব বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যায় না। এসব ঐতিহ্যিক, ঐতিহাসিক উপাদান একটি ভূখণ্ডের, একটি জাতিসত্তার অহংকারকে বহন করে। এই অহংকার আমাদের চেতনার অহংকার, মুক্তিযুদ্ধের অহংকার। এসব কারণে এই নদীটি শুধু আমাদের অর্থকরী নদী নয়, নদীদের নদী। ইতিহাস-ঐতিহ্যের মেরুদণ্ড, সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু, বহুজাতিক সত্তা ও সংস্কৃতির অতুলনীয় আধার।
দেশের আর কোন নদী এত বেশি ইতিহাস মিশ্রিত, ইতিহাস সংশ্লিষ্ট, ঐতিহ্য বহনকারী নয়। তাই স্বাধীনতার অর্ধ শত বর্ষের প্রান্তে এসে এ নদীকে জাতীয় নদীর সম্মানে সম্মানিত করা যায়।
বৃহত্তর চট্টগ্রামের নদী সজ্জায় এক অপূর্ব ছন্দ দেখা যায়। সর্ব দক্ষিণের নদী নাফ থেকে ৮০ কিলোমিটার উত্তরে বাঁকখালী নদী। বাঁকখালী থেকে ৬০ কিলোমিটার উত্তরে মাতামুহুরী। এই মাতামুহুরী থেকে ৬০ কিলোমিটার উত্তরে সাঙ্গু নদী। সাঙ্গু থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে কর্ণফুলী। কর্ণফুলী থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার উত্তরে ফেনী নদী।
বৃহত্তর চট্টগ্রামের নদী এবং উপকূল ঘিরে যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছে, তা এদেশের মানুষকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে। শতবর্ষের পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প, গভীর সমুদ্র বন্দর বাস্তবায়নের পথে। কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে বঙ্গবন্ধু টানেল সমাপ্তির পথে। চট্টগ্রাম থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরী আমাদের সমৃদ্ধিকে দৃশ্যমান করছে। ১৫ লাখ লোকের প্রাথমিক কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা হয়েছে।
বন্দরের সাথে রেল যোগাযোগ, কোস্টাল বেলট যোগাযোগ, বে টার্মিনাল নির্মাণ সমৃদ্ধির স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করছে। মহেশখালী, মাতারবাড়ি, টেকনাফের সাথে সর্বাধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপিত হচ্ছে। কঙবাজার, টেকনাফ পর্যন্ত রেল স্থাপন বাংলাদেশের ২০৩০ এবং ২০৪১ সালের স্বপ্নের বাস্তবায়ন বৃহত্তর চট্টগ্রামের নদীগুলোর গুরুত্বকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমাদের প্রাকৃতিক জলধারাগুলো নদী থেকে নদী সম্পদ হয়ে বাংলাদেশের বিকাশে বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির গর্বিত দেশে পরিণত করছে। এই প্রত্যাশায় অঞ্চলের মানুষেরা আপ্লুত, উচ্ছ্বসিত, আশান্বিত। চট্টগ্রাম ও তার নদীসম্পদ আগামীর বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির শিখরে নিয়ে যাবে, এ প্রত্যাশা এ অঞ্চলের মানুষের, এদেশের মানুষের।
কর্ণফুলী তীরে, সাগরের উপকূলে, পাহাড়ের পাদদেশে চট্টগ্রাম অঞ্চলের নদীসম্পদ ঘিরে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কর্মকাণ্ড বিকশিত হোক, বিস্তৃত হোক। এ প্রত্যাশা নিরন্তর, চিরন্তন।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা , অধ্যাপক, কর্ণফুলী গবেষক। বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ অধ্যয়ন কেন্দ্রের প্রধান সমন্বয়ক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধড. মঈনুল ইসলামের কলাম
পরবর্তী নিবন্ধপরিত্যক্ত পুকুর থেকে কিশোরীর লাশ উদ্ধার