চট্টগ্রামের কবিয়াল ও কবিগান

শামসুল আরেফীন | শুক্রবার , ২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৬:৩৩ পূর্বাহ্ণ

কবিগান একান্তই বাংলার সম্পদ। জর্জ টমসনের Marxism and poetry গ্রন্থসূত্রে জানা যায়, সোভিয়েত কাজাখদের মধ্যে প্রাচীনকাল থেকে এক ধরনের প্রতিযোগিতামূলক গান আছে। একে বলা হয় Minstrels’ Contest। গ্রন্থটিতে এ-গান ও গায়কদের সম্পর্কে বলা হয়: They Sang extempore. Each of them after listening to a song by another competitor would have to answer him in verse immediately.
বাংলার বাইরে অর্থাৎ বহির্বিশ্বে সম্ভবত এই Minstrels’ Contest-এর সাথে কবিগানের কিছুটা সামঞ্জস্য রয়েছে। পণ্ডিত অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ কবিগান সম্পর্কে লিখেছেন: ‘এই গানে সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য আছে। অন্য কোনও জাতির মধ্যে এরূপ গান দেখা যায় না’।
চট্টগ্রামে কবিগানের প্রচলন কখন থেকে জানা যায় নি। কবিগানের উৎপত্তি বা উদ্ভব নিয়ে নানা মত বিদ্যমান। ব্রজসুন্দর সান্যাল ‘দমন যাত্রা’, ড. দীনেশচন্দ্র সেন ‘যাত্রা’, হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় ‘ঝুমুর’-এর মধ্যে কবিগানের উৎস খুঁজেছেন। কবিগানের অনেক আগে থেকে প্রচলিত পাঁচালি-র মধ্যেও কবিগানের উৎস অনুসন্ধান করা হয়। এমন অভিমতও রয়েছে যে, সতেরো শতকের শেষে বা আঠারো শতকের প্রারম্ভে কলকাতা শহরে এক নব্য ধনীক গোষ্ঠীর মনোরঞ্জনের জন্য কবিগানের উৎপত্তি ঘটে। রবীন্দ্রনাথ কেদারনাথ বন্দোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত কবিগানের সংকলন ‘গুপ্তরত্নোদ্ধার’ গ্রন্থের সমালোচনায় লিখেন: ‘বাংলার প্রাচীন কাব্যসাহিত্য এবং আধুনিক কাব্যসাহিত্যের মাঝখানে কবিওয়ালাদের গান’ [সাধনা, ১৩০২ বাংলা]। শ্রী প্রফুল্লচন্দ্র পাল তাঁর ‘প্রাচীন কবিওয়ালার গান’ গ্রন্থে মন্তব্য করেন, পশ্চিমবঙ্গই কবিগানের উৎপত্তি ও বিকাশস্থল। তবে পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহ অঞ্চলের কবিয়াল ও কবিগান গবেষক বিজয় নারায়ণ আচার্য আষাঢ় ১৩২৩ বাংলার ‘সৌরভ’ পত্রিকায় ‘অনেকের অনুমান’ ব্যক্ত করেন, কবি নারায়ণ দেবের পদ্মপুরাণ বা মনসার ভাসান রচনার কিছুকাল আগে ময়মনসিংহ অঞ্চলে কবিগানের প্রচলন হয়। বিভিন্ন সূত্রে জ্ঞাত হওয়া যায়, নারায়ণ দেব ষোলো শতকে জীবিত ছিলেন। এ-থেকে বলা যায়, সম্ভবত পূর্ববঙ্গেই সর্বপ্রথম কবিগানের উৎপত্তি হয়। ধারণাযোগ্য, পূর্ববঙ্গে কবিগানের উৎপত্তিকাল থেকে চট্টগ্রামে কবিগানের প্রচলন।
দুই.
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, কেদারনাথ বন্দোপাধ্যায়, ড. সুশীল কুমার দে, ড. দীনেশচন্দ্র সেন, শ্রী প্রফুল্লচন্দ্র পাল, পণ্ডিত অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ ও আরও অনেকের কল্যাণে পশ্চিমবঙ্গের কবিগানের ইতিহাস মোটামুটি পাওয়া গেলেও, উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের কবিগানের ইতিবৃত্ত ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। ফলে এ-সময়কাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের কবিগান সম্পর্কেও জানার সুযোগ অল্প।
ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ও বিশ শতকে চট্টগ্রামে কবিগানের জোয়ার ছিল। উক্ত দ্বিতীয়ার্ধে এখানে প্রতিষ্ঠিত কবিয়ালদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- অপর্ণাচরণ জলদাস, দুর্গাচরণ জলদাস, প্রাণকৃষ্ণ জলদাস, আজগর আলী, নবীন ঠাকুর, মোহনবাঁশী, চিন্তাহরণ, গঙ্গাচরণ জলদাস, হরকুমার শীল, অন্নদা ভট্ট ও সুবল ভট্ট প্রমুখ। আজগর আলীকে চট্টগ্রামের সবচে’ প্রাচীন কবিয়াল বলা হয়। তিনি সন্দ্বীপের লোক ছিলেন, থাকতেন সাতকানিয়ার খাগরিয়ায়। এই কবিয়ালরা কবিগান পরিবেশন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কবিগান পরিবেশিত হতো নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে। আসরে দু’টি দল আসতো। দু’দলের নেতৃত্বে থাকতেন দু’জন কবিয়াল বা সরকার। আসরে উপস্থিত হওয়ার পূর্বে একদল সম্পর্কে অন্য দলের কোনোকিছু জানার সুযোগ থাকতো না। আসরে কবিয়াল ছাড়া আসা উভয় দলের আদ্যাশক্তির বন্দনামূলক ডাকসুর ও মালসী গাওয়া সমাপ্ত হলে, একদল এসে সখী-সংবাদের ‘দূতী সংবাদ’, ‘মাথুর’ অথবা ‘মান’-এ ধরনের কোন চাপান দিত। তখন অপর দলের কবিয়াল তাঁর দলকে জবাব (উতোর) হিসেবে একটি গান বেঁধে দিলে সেই দল গানটি পরিবেশন করে অন্য দলের উদ্দেশ্যে দিত আরেকটি গানের চাপান। মূল কবিয়াল বা সরকার আসরে উঠতেন প্রথম চাপানের পর। চাপান ও উতোর এগিয়ে চলত। অবশেষে ‘যোটক’ গানের মাধ্যমে কবিগানের সমাপ্তি ঘটতো। কবিয়ালদ্বয়ের কেউ কারও কাছে হার মানতে না চাইলে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপে উভয়কে বিজয়ী ঘোষণা করে কবিগানের সমাপ্তি টানা হতো।
ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ও বিশ শতকের প্রথমে কবিগান হতো পৌরাণিক বিষয়-আশয়ে। সাথে থাকতো খিস্তি, খেউড়, বিকৃত রুচি ও অশ্লীলতা। বস্তুত উভয় বঙ্গে উদ্ভবকাল থেকে এভাবেই কবিগানের যাত্রা। ঢাকা-নরসিংদির হরিচরণ আচার্য (১৮৬১-১৯৪১), যিনি ঊনিশ শতকের শেষে কবিয়াল হিসেবে খ্যাতনামা হয়ে বিশ শতকের প্রথমার্ধেও কবিগান করেন, কবিগানকে মার্জিত ও সুন্দরকরণে, তাতে শালীনতা আনয়ন ও উপস্থাপনা রীতি পরির্বতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। চট্টগ্রামের কবিগানে এই ভূমিকা রাখেন কবিয়াল করিম বখশ (১৮৭৯-১৯৩৮)। তিনি কবিয়াল আজগর আলীর শিষ্য ও চট্টগ্রামের কবিগানের দ্বার উন্মোচক চিহ্নিত। জানা যায়, তিনি নিরক্ষর হলেও পৌরাণিক বিষয়-আশয়ে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। তাঁকে অপরাজেয় কবিয়ালও বলা হয়। যেহেতু তাঁর সাথে কবির লড়াই করে কেউ কোনদিন জিততে পারেন নি। তিনি হরিচরণ আচার্যের উত্তরসূরি হয়ে চট্টগ্রামের কবিগানে অঞ্চলপ্রীতির স্থলে স্বদেশপ্রীতি আনতেও ভূমিকা রাখেন। উল্লেখ বাহুল্য, হরিচরণ আচার্যের কালেই কবিগানে প্রথম অঞ্চলপ্রীতির স্থান দখল করে স্বদেশপ্রীতি। চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার বৈলতলী গ্রামে জন্মগ্রহণকারী করিম বখশের পরে কবিগানের জগতে আবির্ভুত হন রমেশ শীল (১৮৭৭-১৯৬৭)। তিনি কবিয়াল নবীন ঠাকুরের শিষ্য। ১৮৯৮ সালে ২১ বছর বয়সে তিনি কবিয়াল মোহনবাঁশীর সাথে প্রথম কবিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে অনেককাল কবিগানের জগতে থেকে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন।
বলেছি, উভয়বঙ্গে উদ্ভবকাল থেকে পৌরাণিক বিষয়-আশয় নিয়ে কবিগানের যাত্রা।
বিশ শতকের তিরিশ দশক পর্যন্ত চট্টগ্রামে এই বিষয়-আশয়েই কবিগান চলেছে। করিম বখশ চট্টগ্রামের কবিগানে শালীনতা আনয়নে ভূমিকা রাখলেও তিরিশ দশক পর্যন্ত তাতে কিছু না কিছু খিস্তি, খেউড় ছিল। রমেশ শীল নিজেও এসময়ের মধ্যে রেলওয়ে ধর্মঘট, খেলাফৎ আন্দোলন ও সূর্য সেনের নেতৃত্বে অস্ত্রাগার অপারেশন দ্বারা প্রভাবিত হওয়া সত্ত্বেও করিম বখশের সাথে কবিগান করতে গিয়ে তাঁকে গালি দিয়েছেন। চট্টগ্রাম শহরে আবদুল হক দোভাষীর বাড়িতে কবিগানের আসর বসলে এক পক্ষে ছিলেন চট্টগ্রাম অঞ্চলের রমেশ শীল-হরকুমার শীল ও নোয়াখালী-ফরিদপুর অঞ্চলের চারজন নামকরা কবিয়াল, অন্যপক্ষে ছিলেন করিম বখশ। লড়াইয়ের এক পর্যায়ে রমেশ শীল ও হরকুমার শীল ‘গোয়ালটুরী গাই’ (গাভী) সম্বোধন করে করিম বখশকে বিশ্রী গালি দিলে, কৃষক পরিবারের সন্তান করিম বখশ ধৈর্য ধরে পরবর্তীতে সিংহের মতো বীরত্ব প্রদর্শনের মাধ্যমে ওই গালির মার্জিত জবাব দেন। তবে এই রমেশ শীলই চল্লিশ দশকে কবিগানকে একেবারে বিকৃত রুচি, অশ্লীলতা ও গালিমুক্ত করে পৌরাণিক ও কাল্পনিক বিশ্ব থেকে মাটিতে নামিয়ে আনেন।
চল্লিশ দশকের শুরুতে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তখন ‘দেশের মানুষের মধ্যে স্পষ্ট ও প্রবল হয়ে উঠেছে প্রতিরোধ-চেতনা, সাম্রাজ্যবাদ-ফ্যাসীবাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা, শ্রমিক-কৃষকের শ্রেণি-সচেতনতা, শ্রমিক ধর্মঘট, জঙ্গী কৃষক সংগ্রাম, তেভাগা আন্দোলন ইত্যাদি।
মধ্যবিত্তের একটি অংশ যেমন চূড়ান্ত প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থান থেকে জঘন্য গণবিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করেছে, র‌্যাডিকাল অংশটি তেমনি আরো র‌্যাডিকাল হয়ে শ্রেণিচ্যুত বিপ্লবীর মন্ত্র নিয়েছে, প্রগতিশীল নাগরিক মধ্যবিত্তের সাংস্কৃতিক আন্দোলন কৃষক-শ্রমিক-সর্বহারাকে সমাজ-বিপ্লবের ডাক দিয়েছে। এই জটিল সময়ের সঠিক প্রতিফলনের জন্য কবিগানে নতুন মাত্রা যোগ করা জরুরি হয়ে উঠেছিল। হরিচরণ যুগে কবিগানের ভাষায় ও উপস্থাপনায় শালীনতা ও সমুন্নতি এসেছিল, অঞ্চল-প্রীতির স্থলে স্বদেশপ্রীতি ও জাত-পাতের ক্ষুদ্র সাম্প্রদায়িকতার স্থলে উদার মানবিকতার হাওয়া লেগেছিল। কিন্তু এ-যুগের দাবি আরো অগ্রসরমানতার। স্বদেশ-প্রীতির সঙ্গে চাই আন্তর্জাতিক চেতনা, উদারতার স্থলে চাই সংগ্রামী বাস্তবতা, নিষ্ক্রিয় মানবিকতার বদলে চাই সক্রিয় শ্রেণিচেতনা। যুদ্ধকে প্রতিহত করার জন্য চাই শান্তি-আন্দোলনের বিস্তৃতি, ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে চাই সমাজতন্ত্রের সংগ্রাম, নিপীড়িত জাতিসমূহের আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য চাই সাম্রাজ্যবাদের উৎসাদন। যুগের এই সব দাবি মেনে নিয়েই বাংলাদেশের কবিগানে যুগান্তরের নকীব হয়ে এলেন চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালি থানার গোমদণ্ডী গ্রামের কবিয়াল রমেশ শীল’ [বাংলাদেশের কবিগান/যতীন সরকার]।
(চলবে)

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘আমরা বিলুপ্তির স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছি’
পরবর্তী নিবন্ধতিন শতাধিক নারী-পুরুষের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা