ঘাসফুল-প্রতিষ্ঠাতা পরাণ রহমান স্মরণে শেষ ছন্দ

প্রফেসর ড. জয়নাব বেগম | শুক্রবার , ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৫:৫৮ পূর্বাহ্ণ

‘শামসুন্নাহার পরাণ’ – একটি নাম/সবার পরাণে যার স্মৃতি রবে অম্লান’
অপর্ণা চরণ গার্লস হাই স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় পেলাম অপূর্ব সুন্দরী, লম্বা সদা হাস্যমুখর দারুন মিশুক একটা মেয়ে। নাম শামসুন্নাহার, যার সঙ্গে একই উচ্চতার বিলকিস, আভা মজুমদার, তাহমিনা। লম্বা বলে তাদের বসতে হতো পেছনের বেঞ্চে। টিফিন এর ছুটিতে সকলের সঙ্গে হৈ হুল্লোড়ে মাতিয়ে রাখত। অদ্ভুত একটা ব্যক্তিত্বও নিয়ে থাকত শামসুন্নাহার সেই ছোট বয়সে। চারুদির (চারুলতা বড়ুয়া) সেলাই ক্লাসে ঝটপট সেলাই জমা দিত ওরা ক’জন। আর যারা জমা দিতে পারতো না তাদের ভাগ্যে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা। অনেকে আবার ইচ্ছে করে সেলাই না এনে চারুদির বকা খাওয়া পছন্দ করতো। কত নিবেদিত প্রাণ শিক্ষক এঁরা ছিলেন। বাসন্তী দিদিমনি, কল্যাণী দিদিমণি, বড় দিদিমণি প্রণতি সেন সহ অনেক শিক্ষিকার কথা মনে পড়ে যায়। লাইনে দাঁড়ালে একটু যদি কোমর বাঁকা হতো বা কারো হাতে গয়না দেখলে বাসন্তী দির কঠিন শাস্তি পেতে হবে নির্ঘাত। পরাণ সবার সাথে স্কুলের নিয়ম বিধি মেনে ক্লাস এর মনিটর এর দায়িত্বও পালন করত। সপ্তম শ্রেণিতে নতুন ক্লাস, নতুন আনন্দ আর উত্তেজনা নিয়ে শুরু। ক্লাসের সেই সুন্দরী মেয়েটিকে আর দেখিনা। পরে জানলাম এই ছোট বয়সে মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে। অবাক হয়েছি বৈকি?
কালের পথচলায় অনেকদূর এগিয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিদ্যা বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী নিয়ে চট্টগ্রাম কলেজ, আমার প্রিয় ‘আলমা- মেটার’ এ ১৯৬৬ তে পাবলিক সার্ভিস কমিশন হয়ে অধ্যাপনায় যোগদান করি প্রাণিবিদ্যা বিভাগে। ১৯৬৯-১৯৭০ এর দিকের কথা। চট্টগ্রাম কলেজ গার্লস কমনরুমের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে আমি ছিলাম, সর্বজন শ্রদ্ধেয়া হাসনা আপার পরে। একদিন কমনরুমের সামনে দেখি সেই মেয়েটি, আজও অনিন্দ্য সুন্দরী সেই মহিলাকে দেখেই চিনে ফেললাম, বললাম “তুমি শামসুন্নাহার না!” হ্যাঁ, পরিচয় দিলাম, চিনতে পারল। নতুন করে আবার ফিরে পেলাম হাস্যোজ্জ্বল, দারুন মিশুক সেই মেয়েটিকে। একদিন আমার দেবর এনামুল হক ১ম বর্ষ ইংরেজী সম্মানের ছাত্র, বর্তমানে ঢাকায় বসবাসরত প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, আমাকে খুব উৎসাহ আর আনন্দ নিয়ে বলল- ‘জানেন আমাদের সাথে সাবসিডিয়ারী ক্লাসে এক ভাবীকে পেলাম-অপূর্ব সুন্দরী, চার সন্তানের জননী। আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দেব,’ বাসায় আসতে বলেছি। আমিও তাকে বললাম আমার এক স্কুলের বান্ধবী-বিয়ের পরে কয়েক সন্তানের মা হয়েছে, তবুও লেখা পড়ার উৎসাহ কমেনি। এই কলেজেই ভর্তি হয়েছে, কমনরুমে রাউন্ড এ গিয়ে দেখা পেয়ে গেলাম হঠাৎ। আমি দারুন আনন্দিত, হারিয়ে যাওয়া সুন্দরী বান্ধবীকে পেয়ে।
বাসায় যখন বেড়াতে এল দেখা গেল দেবর এনামুল হক এর ভাবীটি আর আমারই বান্ধবী শামসুন্নাহার একইজন। জড়িয়ে ধরলাম খুশিতে। তুমিই সেই বিখ্যাত ‘ঐবষবহ ড়ভ ঞৎড়ু্থ আমার এককালের সহপাঠী আজকে আমাদেরই ছাত্রী যদিও সে বিজ্ঞানের ছাত্রী নয়। তাঁর অদম্য উৎসাহ আর উদ্দীপনা- পড়াশুনার জন্য, দেখে অভিভূত হলাম। একটি অদ্ভূত দৃঢ়তা আর আত্নপ্রত্যয় চোখে মুখে। মা ও স্ত্রী হিসেবে সংসারের সব দায়িত্ব, সামাজিক দায়িত্ব তাতেও পড়াশুনার আগ্রহ এতটুকু কমাতে পারেনি। কেবল মা নয়, গৃহিণী নয়, তার সুন্দর শৈল্পিক একটি মনও ছিল। তার বসন ভূষণ তখনই ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। একদিন গলায় দেখি সুন্দর একটি পেনডেন্ট, সম্পূর্ণ ঁহপড়সসড়হ একটি গয়না, ওকে আরও সুন্দরী করেছে। ডিজাইনটি কোথায় পেলে বলাতে, বলল পুরোনো ফিল্মের কোন এক সিনেমার নায়িকার গলায় ছিল। তা স্যাঁকরাকে সিনেমায় নিয়ে ছবি দেখিয়ে এই গয়না গড়িয়েছে। লুৎফুর রহমান ভাই সত্যিই পরম সেই ভাগ্যবান ব্যক্তি। সুন্দরী শিক্ষিতা, অমায়িক সদা হাস্যোজ্জ্বল, যরমযষু ধপপড়সঢ়ষরংযবফ এক মহিলা-তাঁর জীবন সাথী।এরপর অনেক পথ চলা।
শামসুন্নাহার হয়ে গেল সবার পরাণ আপা। সবার পরাণে ঠাঁই করে নেয়ার মত বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়লেন ধীরে ধীরে। জন্ম হলো ‘ঘাসফুল’। সমাজের ভাগ্যহত অবহেলিত, নির্যাতিত, দলিতদের কল্যাণে এগিয়ে আসলেন সেবার ব্রত নিয়ে। নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে থাকল। সমাজ উন্নয়নের বৃহৎ কর্মকান্ডে যাত্রা শুরু করলেন দৃপ্ত পদক্ষেপে ‘ঘাসফুল’ পরিবারকে নিয়ে। আজ ‘ঘাসফুল’ অনেক ডালপালা ছড়িয়ে বড় মহীরুহে পরিণত হতে চলেছে। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে সমাজের যে কোন সমস্যা, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, শিশু শ্রম, এইডস সচেতনতা,মাদক মুক্ত জীবন সচেতনতা, শিশু শিক্ষা, কৃষি পরিবেশ সচেতনতা মূলক ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম এর মাধ্যমে বিভিন্নমুখী প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। সমাজের সুবিধাবঞ্চিতদের বিশেষত মহিলাদের আত্ননির্ভরশীল করে গড়ে তোলার জন্য নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন। সমাজের উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রতিটি সমস্যাকে গুরুত্ব দিয়ে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়েছেন, এটি অবশ্যই প্রসংশার দাবীদার। ‘ঘাসফুল’- প্রশিক্ষণ এর মাধ্যমে দক্ষ কর্মী বাহিনী গড়ে তুলেছে যারা আজ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারবে, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। ভবিষ্যতের মানুষ গড়ার লক্ষ্যে শিশু শিক্ষার জন্য তার প্রয়াস ছোট্ট বিদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠা করে কোমলমতি শিশুদের ময়ের বুকভরা ভালবাসা দিয়ে তাদের পরাণে ঠাঁই করে নিয়েছে মায়ের রূপে। পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার জন্য তাঁর মূল্যবান পরামর্শ মন দিয়ে শুনেছে, এ সব শিশুরা। তাদের পরীক্ষা কার্যক্রম ও খেলাধূলা কোনটিতে পিছিয়ে নেই। পরাণের মাতৃস্নেহে ও মূল্যবান পরামর্শে ভবিষ্যতের সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তোলার স্বপ্ন ছোটদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত থেকে আমি দেখতে পেয়েছি, কতটা সার্থক তাঁর এ সকল মহৎ উদ্যোগ যা বলে শেষ করা যাবেনা। দেশ বিদেশ ঘুরে পরাণ তার লব্ধ অভিজ্ঞতাগুলো ছড়িয়ে দিয়েছে তার কর্মকাণ্ডে। তাঁর সুযোগ্য পুত্র কন্যা যাদের তিনি উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। তিনি তাই তো সার্থক মাতা। পারভীন মাহামুদ এফ.সি.এ বাংলাদেশের প্রথম মহিলা এফ.সি.এ। কারণ তিনিও চট্টগ্রাম কলেজে আমাদেরই ছাত্রী ছিলেন যার জন্য আমিও গৌরাবান্বিত দেশবাসীর সাথে। তাঁর অন্য সন্তানগণ স্ব স্ব ক্ষেত্রে যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছে। সুযোগ্য পুত্র জাফরী মায়ের গড়া এ প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে। যোগ্য পরামর্শকমণ্ডলীদের মূল্যবান দিক নির্দেশনা নিয়ে এগুচ্ছে প্রথম কাতারের সমাজ সেবা সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে। আমার বিশ্বাস আমার বান্ধবী শামসুন্নাহার পরাণ এর গড়ে তোলা ‘ঘাসফুল’ প্রতিষ্ঠান কেবল বাংলাদেশে নয় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও একদিন তার কর্মকান্ডের স্বাক্ষর রাখতে পারবে। সকলের নিরলস প্রচেষ্টা ও কর্মকাণ্ড এগিয়ে নেবে একটি সন্ত্রাসমুক্ত, সংঘাতবিহীন, শান্তিপূর্ণ, সুশৃংখল সমাজ বিনির্মাণে। দেশের যুবশক্তিকে একটি আলোকিত দক্ষ শক্তিতে পরিণত করতে ঘাসফুল, যেন অনবদ্য ভূমিকা রাখতে পারে ,যা হল উন্নয়নের সবচেয়ে বড় চাবিকাঠি। শামসুন্নাহার পরাণ দেখতে যেমন সুন্দরী তেমনি সুন্দর তার স্বপ্নগুলো। পরাণ এর স্বপ্ন সার্থক হোক। তিনি সার্থক জায়া, সার্থক জননী, সার্থক সমাজকর্মী। মহান আল্লাহ্‌ তায়ালা তাঁর স্বপ্নপূরণে সাহায্য করেন। তাঁর আত্নার চির শান্তি বর্ষণ করুন। তাঁর সকল মহৎ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তিনি চির জাগরুক থাকুন সবার পরাণে। এই হোল তাঁর জন্যে সবচেয়ে বড় দোয়া ও শুভকামনা।
লেখক: প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, প্রানিবিদ্যা,চট্টগ্রাম কলেজ,চট্টগ্রাম, প্রাক্তন যুগ্ম সচিব (পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ), স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়,
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাইকেল এঞ্জেলো: রেনেসাঁস যুগের অন্যতম ভাস্কর
পরবর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা