এক.
প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে ইব্রাহিম। যে করে হউক বাঁচতে হবে তাকে, এটাই এ মুহুর্তের একমাত্র ভাবনা তার। হাঁটু থেকে পায়ের গোড়ালী পর্যন্ত অবশ অবশ লাগছিল কিন্তু জীবনের মায়া নিয়ে যখন দৌড়ানো শুরু করেছিল ইব্রাহিম সেই মুহুর্তে ঐসব বেদনার কথা বেমালুম ভুলে গেছিল সে। কিছুক্ষণ খুড়িয়েছিল সে দৌড়ানো শুরু করার মুহুর্তে, কিন্তু কিছুক্ষণ দৌড়ানোর পর যেন পায়ে শক্তি ফিরে পেয়েছে, দৌড়ের গতিও বেড়েছে তার। পিছনের দিকে তাকানোর আর কোনো জো নেই। যে করে হউক নিজের এলাকার সীমানায় পৌঁছাতে হবে, যাতে জীবন গেলেও এলাকার কেউ হয়তো তাকে চিনে নিয়ে সাহায্যে এগিয়ে আসবে, এই চিন্তাও ক্ষণে ক্ষণে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে তার। সারা শরীর আঘাতে আঘাতে জর্জরিত, পিঠ এবং বাহুর ছিড়ে যাওয়া অংশে মনে হচ্ছিল আবারো রক্ত ঝরা শুরু করেছে। লুঙ্গি পড়ে থাকায় একবার হোঁচট খেয়ে পড়েও গিয়েছিল সে, এর পরপরই উঠে গিয়ে লুঙ্গির কোঁচাটা শক্ত করে হাতের মুঠোয় মুষ্টিবদ্ধ করে নিয়ে দৌড়ানো শুরু করেছিল আবার। ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে প্রথমে পার হয়ে এসেছে প্রধান সড়কটা, তার পরেই শফি কন্ট্রাকটারের খামারের রাস্তা ধরে সোজা পশ্চিম দিকে দৌড়। রাস্তার দুপাশ জুড়েই সব ফসলী ক্ষেত। পাকা ধান কেটে নেওয়ার পর অনেক জমি ধান গাছের নাড়া সহ চৌচির হয়ে আছে। কিছু জমিতে সবুজ লতানো ফসল দেখা যাচ্ছে আর কিছু কিছু জমিতে নতুন ফসল বোনার জন্য জমি তৈরী কাজে ব্যস্ত গ্রামের কৃষকরা। সূর্যটা পশ্চিমে ঢলে গিয়ে চোখের আড়ালে চলে গেছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে গেছে এরইমধ্যে, অন্ধকার হয়ে আসার আগেই লোকালয়ে পৌঁছাতে হবে ইব্রাহিমের। ক্ষেতে ক্ষেতে কর্মরত কৃষকেরা এই সময়েই ঘরে ফিরতে শুরু করে। একটু পরেই যেন নেমে আসবে রাজ্যের আঁধার। জনশূন্য কোনো স্থানে যদি পড়ে যায় সে তাহলে কতদিন পড়ে থাকতে হবে কে জানে। এসব ভেবে ভেসে যখন শরীরের সব শক্তি দিয়ে দৌড়ের গতি বাড়াচ্ছিল সে তখই পিছন দিক থেকে কিসের যেন একটা বিকট শব্দ হলো, এর পরই মুহুর্মুহু গুলির শব্দে যেন তার কান বিদীর্ণ হতে লাগল। সামনে কী ছিল তা দেখার বা বুঝার হুশ ছিলনা তার, শুধু ঐ শব্দের সাথে সাথেই ধপাস করে তার দেহটা পতিত হল রাস্তার খাঁজ বরাবর, তারপর গড়িয়ে পড়ে গেল রাস্তার পাশে নীচু একটা জমির খেসারী ক্ষেতে। সদ্য মাটির ঢেলা পেঁচিয়ে বেড়ে উঠা খেসারী ক্ষেতটার খটখটে শুকনো বড় বড় মাটির ঢেলাতে পড়ে গিয়ে শরীরের হাঁড় গোড় ভাঙ্গার শব্দের মতো শব্দ শুনতে পেল সে, তারপর আর কিছু মনে নেই তার।
আর কিছু দূর গেলেই বটতলার ব্রীজ, মাটিয়াল খালের উপর দিয়ে খামারের দিকে যেতে একটা জংশন। ওখানে বসা লোকজনই প্রথম দেখতে পেল দৌড়াতে দৌড়াতে একটা লোক রাস্তায় পড়ে গিয়ে গড়িয়ে পাশের ক্ষেতে পড়ে গেল যেন। ব্রীজের রেলিং এ বসে থাকা লোকগুলো নৌঘাটির ক্যাম্পের দিক থেকে হঠাৎ গুলির শব্দ শুনে লাফ দিয়ে যখন রেলিং থেকে নেমে পড়েছিল, তখনই তাদের চোখে পড়েছিলে রাস্তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়া লোকটার দিকে। কতক্ষণ থমকে থেকে দু’জন লোক পড়ে যাওয়া লোকটার দিকে দৌড়ে এগিয়ে গেল। তাদের দেখে দু’পাশ থেকে বেশ ক’জন লোক জড়ো হয়ে গেল ইব্রাহীমকে ঘিরে। ইব্রাহীমের কোনো চেতনা নেই তখন, শুধু নিঃশ্বাসে বুকটা উঠানামা করছে বলে বুঝা যাচ্ছে জীবিত আছে সে। পিঠের দিকটার ফাটা কাপড়ে ভেজা রক্তের ছোপ ছোপ দাগ লেগে থাকায় প্রথমে মনে হলো গুলি খেয়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। কিন্তু দু’জন লোক যখন তাকে উল্টিয়ে সোজা করতে গেল তখন বুঝা গেল গুলি নয়, ওগুলো আঘাতেরর চিহ্ন। লোকগুলো ভাল করে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখলো কোনো রকম গুলির দাগ নেই তবে পিঠে ক্ষত সহ, বাহুতে আর হাঁটু থেকে নীচের দিকে থেতলে যাওয়ার মত অনেক গুলো যখম আছে, যা দেখে বুঝা যায় শক্ত কিছু দিয়ে পেটানো হয়েছে তাকে। কিন্তু কেউ তাকে চিনতে পারছিল না কোন এলাকার লোক, সবাই একে অন্যকে জিজ্ঞেস করছিল কেউ চিনে কিনা এবং একে অন্যের দিকে মুখ চাওয়া চাওয়ি করছিল তার পরিচয় বের করার আশায়। ইব্রাহীমের চেতনাহীন অবস্থা বুঝতে পেরে কেউ কেউ বলছিলো মুখে একটু পানির ছিটা দিতে, এটা শুনেই কেউ একজন খালের দিকে দৌড়ে গেল পানি আনার জন্য। এরই মধ্যে ভীড় ঠেলে ঢোকা কেউ একজন চিৎকার করে উঠলো ‘ইব্রাহী…ম’ ! এটা শুনে বাকিরা সবাই তার দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ল লোকটা কোথাকার জানার জন্যে-
-ভাই তুমি চেন লোকটাকে ?
-হ ভাই, পুরান সাইট পাড়ার। ঐ মধ্যের গল্লীর ভিতরে, আমাদের বাড়ির দুই বাড়ির পরের বাড়ির। ওর নাম ইব্রাহীম। আমি ওর ভাইদের ডেকে নিয়ে আসি, আপনারা ততক্ষণ একটু থাকুন-বলেই লোকটা জটলা থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেল।
দুই.
ইব্রাহীম খুবই সাধারণ একটা কৃষক পরিবারের সন্তান, রাজনীতি, নেতৃত্ব এসব কঠিন শব্দের প্রতি তার পরিচয় বা বোধগম্যতা কিছু নেই বললেই চলে। স্থানীয় ইস্পাত কারখনার একজন সাধারণ মজুরে শ্রমিক সে। শ্রমিক নেতাদের সাথে মাঝে মাঝে সংশ্রব হত, তাদের মুখেই শুনতেন দেশের পরিস্থিতির কথা। এছাড়াও রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে বসলেও নানান রকম খবরাখবর শুনতে পেত সে। রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণও শুনেছে সে। নিজের বুদ্ধিতে যতটুকু বুঝেছে সে, সেখান থেকে এতটুকু বলতে পারে ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’ ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ । এই কথাগুলো সে ভাল করেই বুজেছে। দেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হতে যাচ্ছে, এরই মধ্যে ঘটে গেছে ২৫ মার্চের কাল রাতের ঘটনা। সে শুনেছে ঢাকাতে নাকি অনেক লোক মারা গেছে সেই রাতে। তারপরেই সারাদেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। দক্ষিণ হালিশহর গ্রামেই নৌবাহিনীর ঘাঁটি, যার কারণে গ্রামের মানুষ সহজেই গোলাগুলি শব্দটার সাথে পরিচিত হয়ে গেল। গ্রামে চোরা গোপ্তা হামলাও হতে শুরু করল। শুরু হল লুটপাট। চট্টগ্রাম ইস্পাত কারখানার সুবাদে আনেক পাঞ্জাবী শ্রমিক বসবাস করতো এই এলাকায়, সেই সাথে বিহারীরাও। দুএকটা ঘটনায় দেখা গেছে বিহারী শ্রমিকদের সহায়তায় হানাদার সৈন্যরা গ্রামের বাড়ি ঘরে ঢুকতে শুরু করেছে। বিহারী ছেলেরা হানাদার সৈন্যদের সহায়তায় বিছিন্নভাবে রাতের আঁধারে গ্রামে নেমে এসে লুটপাট চালাচ্ছে। নির্যাতিত হচ্ছে গ্রামের মা-বোন, আর সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে আক্রান্ত পরিবার সমূহ। এর বিরুদ্ধে কিভাবে রুখে দাঁড়ানো যায় তার জন্য গ্রামের উঠতি বয়সের যুবকেরা বিছিন্নভাবে নানান রকম সলা-পরামর্শ করেও কোনোরূপ সমাধানের পথ খুঁজে পাচ্ছিলনা, এই রকম একটি সময়ে একদিন ইব্রাহীম শুনতে পেল ইস্পাত কারখানার এক শ্রমিক নেতার বাসায় গ্রামের যুবসমাজ একত্রিত হচ্ছে একটা সিদ্ধান্তের আশায়। যেহেতু গ্রামটা ইস্পাত কারখানার শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকা, সেজন্য শ্রমিক নেতার ্আহ্বানে শ্রমিকরাতো গেলই, সেই খবর পেয়ে যুবকেরাও যারা বিচ্ছিন্নভাবে দলবদ্ধ হচ্ছিল তারাও সকলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার একটা সুযোগ পেয়ে গেল যেন। সেই পথ ধরেই ইব্রাহীম সেদিন রাতে বসা আলোচনা সভায় একজন শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত হয়েছিল। সারা গ্রাম থেকে পঞ্চাশ ষাট জন যুবক উপস্থিত হয়েছিল সেদিন আর শ্রমিক নেতা মালেক সাহেব তাদেরকে কর্মসূচি দিয়েছিলেন।
প্রথমে দশ জন করে দল গঠনের জন্য নাম তালিকাবদ্ধ করল তারা। পুরো গ্রামকে দশটি অংশে ভাগ করে দশ জন করে দশটি দল গঠনের পরিকল্পনা করা হল। দশজন দলনেতার নামও চুড়ান্ত করল তারা। তারপর দলনেতাদের তাদের দল পূর্ণাঙ্গ করার জন্য কাজ করতে বলা হল। এবং তিন দিনের পর পরবর্তী সভায় সেগুলো জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো। সেদিনের উপস্থিত যুবকদের মধ্য থেকে ইতোমধ্যে চার দল পূর্ণাঙ্গভাবে গঠন হয়ে গেল সেদিন রাতেই যার একটাতে কর্মী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ইব্রাহীম। সেই রাতেই যুবকেরা সিদ্ধান্ত নিলো রাত্রীকালিন পাহারা বসানোর জন্য গ্রামের পিছনের দিককার প্রবেশ পথগুলোর কাছাকাছি করে গর্ত খুঁড়ে পাহারা বসানো হবে। সাধারণত গ্রামের মাঝ বরাবর যেখান দিয়ে উচু মাটির ডেঙ্গার উপর দিয়ে চলাচলের পথ চলে গেছে সেদিক দিয়েই হানাদার বাহিনীর বিহারী ছেলেরা গ্রামে প্রবেশ করে থাকে। রাতের বেলায় গ্রামের রাস্তায় পর্যাপ্ত আলো না থাকায় ঘটনা বুঝে উঠার আগেই দুবৃত্তরা গ্রামে ঢুকে পড়ে।
সিদ্ধান্ত মোতাবেক গ্রামের উত্তর সীমান্তে গর্ত খোড়ার কাজ শুরু হল। দশ সদস্যের দলের মধ্যে ইব্রাহীম খুবই একজন উৎসাহী শ্রমিক। তার দলনেতা যেভাবে সে রাতে বক্তব্য রেখেছে সেগুলো তাকে বেশ উজ্জীবিত করেছে। বঙ্গবন্ধু মুজিবকে পাকিস্তানি হানাদারেরা গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। গ্রামের মুরব্বীরা প্রত্যেক নামাজে মুজিবের জন্য দোয়া করছে যেন আল্লাহ তাকে বাঁচিয়ে রাখে। সে আরো শুনেছে কালুরঘাট থেকে কোনো এক মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছে। সারাদেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধুর কথামত যার যা কিছু আছে, সেটা নিয়েই শত্রুর মোকাবেলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে সবাই। ধনি-গরীব, ছাত্র-যুবক, কৃষক-শ্রমিক সবাই মিলে দেশটাকে স্বাধীন করতে হবে, এটাই তার ধারনা। তার নেতাকে, তাদের নির্দেশনা কোথা থেকে আসে, এসব কোনো প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারে না সে। সে শুধু বুঝে দশজন নিয়ে গঠিত দলনেতা তাকে গর্ত খুঁড়তে বলেছে, সেটাই এখন তার কাজ। এই গর্তটাকেই সে ধরে নিয়েছে দুর্গ, এখানে দুর্গ বানিয়ে তারা রাতে পাহারা বসাবে এটাই তার সরল বুদ্ধির বোঝাপড়া। পাক হানাদার বাহিনী গ্রামে ঢুকলে এখান থেকেই প্রতিরোধ শুরু হবে। এসব কথা ভেবে ভেবেই সে অনেক উত্তেজিত, উজ্জিবীত। সে এক মনে মাটি কেটে যাচ্ছে আর অন্যরা কাটা মাটি তুলে পাড় দু’টোকে উঁচু করে তুলছে। তারপর ওখানে গাছের ডালপালা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হবে। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে গড়িয়ে গেল, গর্ত এখন কাঁধ সমান খাড়া হয়ে গেছে। এখন চলছে গর্তটার চার পাশটা মসৃণ করার কাজ। যাতে দুজন লোক তার ভিতরে দাঁড়িয়ে ঐদিকটার প্রবেশ পথে নজর রাখতে পারে, অপরিচিত কেউ গ্রামে ঢুকছে কিনা। ইব্রাহীমের কানে শুধু বঙ্গবন্ধুর জ্বালময়ী ভাষণের সেই লাইনটাই বারবার অনুরণিত হতে থাকে ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো’। নিবিষ্ট মনে সে কোদাল চালাতে থাকে শুধু গর্তের ভিতরটাতে আর কোনো কিছুর প্রতিই তার খেয়াল থাকে না। কিন্তু হঠাৎ করে ইব্রাহীম গর্জনের মতো কিছু একটা শুনতে পেয়ে তার সম্বিত ফিরে পেল। কেউ একজন কাউকে উর্দুতে চিৎকার করে তাকে জিজ্ঞেস করছে-
– এই শালে, কেয়া করতাহে এহি পে
গর্তের তলাটাকে মসৃণ করছিল সে, সোজা হয়ে দাঁড়াতেই দেখে অন্ধকারে তার গর্তটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচ পাক হানাদার সেনা। তার মানে গ্রামে ইতোমধ্যেই হানাদার বাহিনী ঢুকে পড়েছে। ইব্রাহীম কাজে এতটাই মত্ত ছিল যে তার সহকর্মীদের ডাক কিছুই তার কানে যায়নি, একজন তাকে উপর থেকে টেনেও তুলতে চেয়েছিল পালাবার আগে, কিন্তু সে উপুড় হয়ে গর্তের তলা মসৃণের কাজ করছিল বলে সহকর্মীটা তাকে ধরতে নাগাল পায়নি। সৈন্যরা অস্ত্র তাক করে এগিয়ে আসাতে থাকলে সবাই আত্মরক্ষার্থে গা ঢাকা দিয়েছে। এখন এই পরিস্থিতিতে সে একেবারেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে, এমনিতে সে কথা বলে কম কিন্তু তার অনুভুতি খুব প্রখর। সে দেখলো আশে পাশে সহকর্মীরা কেউ নেই। আসলে অনেক আগেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে গিয়েছিল, কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। ইব্রাহীম এদিক ওদিক খুব ভাল করে নজর করে যথাসাধ্য দেখল কাউকে দেখা যায় কিনা, তার মনে হলো পুরো আধা মাইল এলাকা জুড়ে কেউ নেই, এবং বুঝতে পারলো সবাই গা ঢাকা দিয়েছে। ইব্রাহীমের মুখ দিয়ে কোনো কথাই বেরুচ্ছে না, বলবেই বা কী? সে তো উর্দু মোটেই বলতে পারে না। সৈন্যটা আবার গর্জে উঠল-
– শালে, বলতে কিঁউ নিহি ?
এবার সৈন্যটি রাইফেলের বাট দিয়ে উপর থেকে ইবাহীমের মাথার উপর আঘাত করতে উদ্যত হলে সে শুধু প্রতিহত করার ভঙ্গিতে হাত দুটোকে মাথার উপরে তুলে আনল ঠিকই তবে শুধুই যেন বোবা মানুষ হয়ে উপরের দিকেই তাকিয়ে রইল। ঐ সৈন্যটাকে থামিয়ে দিয়ে অপর দু’জন, একজন উপরে তোলা একটা হাত ধরে ফেলতেই অন্যজন শার্টের কলার ধরে ফেলে দুজন মিলে টেনে তাকে গর্ত থেকে উপরে তুলে ফেলল। তারপর শুরু হর বেধড়ক পেটানো, রাইফেলের বাট, লাথি, কিল, ঘুষি চলতে লাগলো একাধারে। ইব্রাহীমের সে কি চিৎকার ‘ও মা রে – ও বাবা রে’ বলে, তার চিৎকারে পুরো গ্রামের আকাশ বাতাস ভারি হয়ে উঠলো। পঁচিশ মার্চের রাতটা বাংলাদেশের জন্য যেমন কালো রাত হয়ে আছে ঠিক যেন আজকের রাতটাও এই গ্রামের জন্য একটা কালো রাত হয়ে থাকবে। ইব্রাহীমের দলের অন্য সদস্যরাও আশে পাশের ঝোপ ঝাড়ে লুকিয়ে আছে, কেউ কিন্তু সেইরকম অর্থে পালিয়ে যায়নি, কিন্তু হঠাৎ স্বসস্ত্র সৈন্য দেখে সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলো। এদিকে নৌবাহিনীর ঘাটিও বেশি দূরে না, মাত্র আধা মাইল দূরে গ্রামের উত্তর প্রান্তেই। তাই পুরো গ্রামের নিরাপত্তার কথাও সবাইকে চিন্তা করতে হবে। কিন্তু এই মুহুর্তে কী করতে হবে সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়েছে সবাই। ওদিকে ইব্রাহীমের উপর নির্যাতন বেড়েই চলছে, কান্না করা ছাড়া সে উত্তরই দিচ্ছেনা কোনো প্রশ্নের। ইতোমধ্যে ঘটনাস্থল থেকে একটু দুরত্ব রেখে বিভিন্ন গলির মুখে মুখে অনেক যুবকেরা জড়ো হয়ে গেছে রাতের আবছা আধারে সৈন্যরাও সেটা বুঝতে পেরেছে।
এই অবস্থায় হঠাৎ দলের একজন সদস্যের কণ্ঠ শুনতে পেল ইব্রাহীম, বুঝা যাচ্ছে অনেকটা দূর থেকে এই চিৎকার আসছে গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে। অনেকটা রাতের পাহারাদারেরা গ্রামবাসিকে হুশিয়ার করে সেই সুরে-
-‘তোঁয়ারা যার যার ঘরত ঢুিক জ গ..ই, আঁরা এখন চারৈ মিক্কেত্তোন পাত্থর মাইয্যু..ম। পাক বাহিনী গুলি চালাইত পারে, হিতারাত্তুন বন্দুক আছে…। পোয়াইন অক্কলেরে কইদ্দি, তোরা ইটে পাত্থর তোয়াই ল…’।
হঠাৎ চারিদিক থেকে বিভিন্ন রকম চিৎকার শুনে সৈন্যরাও একটু হতচকিত হয়ে গেল, অতঃপর ইব্রাহীমকে নিয়ে গ্রাম থেকে বেরিয়ে যেতে শুরু করল। রাতের বেলায় কাউকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু আবছা আলোয় মোটামুটি বোঝা যাচ্ছিল ঘটনা পরম্পরা। সৈন্যরা পিছু হটছে ঠিকই কিছু অস্ত্র তাক করে আছে হৈ চৈ এর শব্দ আসা যুবকদের দিকে। হঠাৎ ঘটে যাওয়া এ ঘটনায় যুবকদেরও তেমন প্রস্তুতি ছিলনা মোকাবেলা করার, কিন্তু হঠাৎ করে চারিদিকে চিৎকার চেঁচামেচি ও হানাদারদের প্রতি ইট পাটকেল ছোড়া শুরু হয়ে গেলে খুব অল্প সময়েই সৈন্যরা অন্ধকারের দিকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে ইব্রাহীমকে নিয়ে গ্রাম থেকে বেরিয়ে নৌ ঘাঁটিতে ঢুকে গেল। গ্রামের অংশটাতে যুবকেরা নিরাপদ দূরত্বে সৈন্যদের অনুসরণ করে কিছু দূর আগাতে পারলেও প্রধান সড়কে আলো থাকার কারণে যুবকরা আর আগাতে পারলনা, গুলির শব্দে সব চিৎকার চেঁচামেচি থেমে গিয়ে পুরো গ্রাম যেন আবার নিস্তব্দতায় নিমজ্জিত হলো সৈন্যরা বের হয়ে যাওয়া পর্যন্ত। অতপর ঘর ছেড়ে বেরিয়া আসা যুবকরা যার যার গলির মুখের পাহারা বসানো আর বেরিকেড ফেলার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো যাতে রাতের বেলা পাক হানাদার সৈন্যরা গ্রামে ঢুকতে না পারে, এভাবে পুরোটা রাত যুবকেরা তাদের বুদ্ধি পরিকল্পনা নিয়ে আলাপচারিতায় নির্ঘুম রাত যাপন করে যেতে লাগলো।
তিন.
ইব্রাহীমের সারা শরীর থেতলে গেছে, কয়েক জায়গায় ছিড়ে গিয়ে রক্ত ঝরতে ঝরতে শুকিয়ে গিয়ে কাপড়ের উপর চ্যাটচ্যাটে হয়ে গেছে। সারা রাত একটা বন্ধ ঘরে রেখেছিল সৈন্যরা। হানাদার সৈন্যদের বলাবলিতে শুনেছে সে-
-রাখ দে শালে কো ইহা পার, কাল কমান্ডার কা সাথ বাত হোগা…
সারারাত যন্ত্রণায় কাতরেছে ইব্রাহীম। কোনো খাবারও দেয়া হয়নি তাকে, ঘরের মেঝেতে পড়ে থেকে ঘোঙানো কান্নার সাথে আল্লাহকে স্মরণ করেছে শুধু। মনে মনে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে সে। সন্ধ্যার আঁধারে ধরা পড়ার পর পুরো রাতটা কী একটা দুঃসহনীয় অন্ধকার কালো রাত ছিল ইব্রাহীমের জীবনে সেটা মনে করেও সে জ্ঞান হারিয়েছে কয়েকবার, আবার চেতনা ফিরে এসেছে। তবুও মনে একটা সান্তনা পায় সে এই বলে যে, পঁচিশে মার্চের সেই কালো রাতে অনেক নিরীহ বাঙালি নিহত হয়েছে পাক হানাদারদের হাতে যাদের অনেকেরই নাম ঠিকানা পাওয়া যায়নি, কিন্তু তার দলের সদস্যরাতো জানে সে হানাদার সৈন্যদের হাতে ধরা পড়েছে। গ্রামের মানুষতো জানবে দেশের জন্য সে কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। হয়তো তার মৃত্যু হবে, হয়তো মা-বাবা তার লাশটা খুজে পাবে না, কিন্তু সবাই জানবে সে কিভাবে জীবন দিয়েছে। এটা ভেবে সে কিছুটা সান্তনা পেলেও ভিতরে ভিতরে মনটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে তার। এই কালো রাত বুঝি আর শেষ হবে না তার জীবন থেকে। এসব নানান রকম ভাবনায় সারারাত কাতরাতে কাতরাতে ইব্রাহীম কখন ঘুমিয়ে পড়েছে বলতে পারে না। যখন তার ঘুম ভাঙে তখন ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকা দেহটাতে একটা তীব্র আঘাত অনুভব করলো সে, চোখ খুলেই বুঝতে পারলো সৈন্যটার লাথিতেই তার ঘুম ভেঙেছে কিন্তু শরীরটাকে সে কিছুতেই দাঁড় করাতে পারছে না, তবুও সৈন্যটা পর পর লাথি দিয়েই চলছে। ছেড়া শার্টটা রক্তমাখা অবস্থায় শরীরের সাথে লেপ্টে আছে, কানটা বোধ ফিরে পাবার পর সে শুনতে পেল-
– ওঠ শালে, শুয়ার কা বাচ্চে, উঠ…
অতঃপর সৈন্যটা তার একটা হাত ধরে হেচকা টানে প্রথমে উঠিয়ে বসিয়ে দিল, তারপর সেই জামা ধরে টেনে হিচড়ে ঘরের বাইরে মাঠের দিকে নিয়ে যেতে লাগল তাকে। ঘর থেকে বেরিয়ে সে বুঝতে পারলো পরদিনের বিকেল হয়ে গেছে। সম্ভবত আছরের আজান হচ্ছে, চারিদিকে আজানের শব্দ। ক্যাম্পের ভিতরের মসজিদেও আজান হচ্ছে। প্রথমদিকে হাঁটতে কষ্ট হলেও নিজেকে ঠিক করে নিয়ে মনে মনে কালেমা পড়ে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল সে। নিজের অজান্তেই কয়েক বার উচ্চৈঃস্বরে কালেমা পড়ল সে, যা সেনাদের দৃষ্টিগোচর হল। তবুও তারা তাকে টেনে হিচড়ে কমান্ডােেরর সামনে আর চারজনের সাথে সারিতে দাঁড় করাল। ইব্রাহীম দিন মজুর হিসাবে ইস্পাত কারখানায় কাজ করতো, কারখানায় কর্মরত অনেক পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের কথাবার্তা শুনেছে সে। তাই নিজে বলতে না পারলেও সে বুঝতে পারে তারা কী বলছে, কিন্তু সে কোনো কথারই উত্তর দিতে পারে না আর তাই নির্বিবাধে সব মারধরই তাকে হজম করে যেতে হয়। এমন কি কমান্ডার যখন জিজ্ঞাসা করে তোমার নাম কী, তখনও সে হা করে তাকিয়ে থাকে। কমান্ডার আবার চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করে-
-নাম কেয়া হে তোমারা, না…ম ? তখন সে একবারই শুধু মুখ খুলে বলে
-ইব্রাহীম। ..ব্যস এটুকুই।
তার সাথে দাঁড় করিয়েছিল আরো চার জন সহ মোট পাঁচ জনকে। সবার বয়সই উনিশ থেকে পঁচিশ এর মধ্যে হবে। তার মতে কারো শরীরই তেমন তাগড়া বা বলিষ্ঠ না দেখালেও বুঝা যায় সবাই তার মতোই খেটে খাওয়া শ্রমিক বা কৃষক। মনে মনে প্রস্তুত সে এবার, কেননা সে দেখতে পেল সারিবদ্ধভাবে এক লাইন ধরে পাঁচজন সৈন্য কাঁধে বন্দুক নিয়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। আর তার সামনে দুজন, একজন কমান্ডার আরেকজন- যে কিনা কাল রাতে তাকে ধরে নিয়ে এসেছে সেই দলনেতা। বাকি চার জনের সাথে কমান্ডার কী বলেছে সেদিকে ইব্রাহীমের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, সে শুধু তাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকা সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কালেমা পড়ছে আর বারবার দেখে নিচ্ছে মাঠের দক্ষিণ দিকটার ফটকটার দিকে, যে দিক দিয়ে তাকে নিয়ে সৈন্যরা ক্যাম্পে প্রবেশ করেছে কালরাতে সেই পথটার দিকে। হঠাৎ করে কমান্ডারের উচ্চকিত চিৎকারে ইব্রাহীম ধাতস্থ হল, কমান্ডার অসম্ভব উত্তেজিত ভাবে ২য় জনকে বলতে লাগল-
-ইয়ে সব কেয়া পাকাড়কে লে আয়া তুম লোগ ? ইয়েতো সব গাঁও কা কিষানো কা বাচ্চা লাগতে হে। ইয়ে না কুছ বল সাকতে হে, অওর না কুছ কর সাকে গা।
এবং সাথে সাথে এগিয়ে আসতে থাকা বন্দুধারীদেরকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল
– ঠ্যাহরো ওধার, কিসি কো মার না নেহি হে।
এগিয়ে আসতে থাকা সৈন্য গুলা বন্দুকসহ ওখানেই দাঁড়িয়ে গেল। গ্রেফতারকারী দলনেতাও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। এবার কমান্ডার ইব্রাহীমসহ দাঁড় করিয়ে রাখা পাঁচজনকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল-
-তুম লোগ ভাগো ইয়াহা ছে,
পাঁচ জনের কেউই যেন বুঝতে পারলো না প্রথমটাতে, পরে কমান্ডার বিরক্ত হওয়ার ভঙ্গিতে চিৎকার করে আবারো বলে উঠলো
-ভা…গো ইয়াহা ছে…
ইব্রাহীম ঠিকই বুঝতে পারলো তাদেরকে পালাতে বলছে। প্রথমে একবার অস্ত্রধারীদের দিকে তাকিয়ে পরখ করলো সে, না তারা সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। তারপর আগে থেকেই দেখে রাখা ক্যাম্পের ফটকটার দিকে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়েই দৌড় দিলো ইব্রাহীম। তার মাথায় এবার শুধু একটাই চিন্তা, এটাই বোধহয় বাঁচার শেষ সুযোগ। খুড়িয়ে গড়িয়ে যেভাবে পারে দৌড়ে ক্যাম্প থেকে বেরোতেই হবে তাকে। প্রথম দিকে কতদূর খুড়িয়েছিল তার পর শরীরের সমস্ত শক্তি যেন এক হয়ে গেছে তার। ঘাঁটির ফটক পেরিয়ে, সামানের প্রধান সড়ক পেরিয়ে গ্রামের উত্তর দিককার সফি কন্ট্রাকটারের খামারের মাটির রাস্তাটায় ঢুকে পড়েছে সে- যেটার মধ্যভাগ দিয়ে সরাসরি তার বাড়ির দিকের রাস্তায় ঢুকে যাওয়া যাবে, পেছনের দিকে তাকানোর কোনো সুযোগ নেয়নি সে। বাকি চারজন বেরুতে পেরেছে কিনা তা জানারও কোনো ইচ্ছা নেই তার। তার মাথায় শুধু কাজ করছে গ্রামের উত্তর প্রান্তে তার দল নিশ্চয় সেই দুর্গটার কাজ শেষ করেছে ইতোমধ্যে, যেভাবেই হোক সেদিকটাতেই তাকে পৌঁছাতে হবে। তাই নিজের জীবন নিয়েই সে দৌড়াচ্ছে তো দৌড়াচ্ছে শুধু, জানে না কোথায় গিয়ে এই রাস্তার শেষ হবে তার…।