গল্পে শেখো বাংলা ভাষা: ভাষা আবিষ্কারের অনন্য সোপান

বিচিত্রা সেন | বুধবার , ২৯ মার্চ, ২০২৩ at ৬:০৯ পূর্বাহ্ণ

শিশু কিশোরদের জন্য একটি চমৎকার বই লিখেছেন কবিগল্পকারসাংবাদিক ওমর কায়সার। ছোটদের জন্য লেখা বইটি বড়দের জন্যেও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কারণ হরহামেশা ফেইসবুকে যে রকম ভুল বানানের ছড়াছড়ি দেখি, তা থেকে উত্তরণে এই বইটির পাঠ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমার বিশ্বাস। চমৎকার ঐ সুখপাঠ্য বইটির নাম গল্পে শেখো বাংলা ভাষা। প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন। প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি, ২০২৩।

বইটিতে গল্প আছে একুশটি। প্রতিটি গল্প এক নিমেষেই পড়া যায়। পাঠশেষে আসে তৃপ্তি। এ তৃপ্তি জানার। প্রতিটি গল্পেই অনন্যা এবং তার মা বাংলা ভাষার একেকটি রহস্য উন্মোচন করেছেন। প্রথম গল্প অনন্যা কোথায়শুরু হয়েছে বেশ মজার একটি বিষয় নিয়ে। ছোট্ট একটি কমা (,) কীভাবে বাক্যের অর্থ পাল্টে দেয় তা বেশ মজা করে লেখক আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। শপিং করতে গিয়ে এক পর্যায়ে ক্লাস ওয়ানে পড়া অনন্যাকে হারিয়ে ফেলেন তার মা। যখন তিনি মেয়েকে মার্কেটের বাইরে আবিষ্কার করেন, তখন থুতু ফেলতে ফেলতে মেয়ের নাকাল অবস্থা। অনন্যার কাছ থেকেই মা জানতে পারেন, পাশের সাইনবোর্ডটি দেখেই মেয়ে অনবরত এখানে থুতু ফেলে চলেছে। মা তো সাইনবোর্ড দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়েন। তিনি দেখেন, সাইনবোর্ডে লেখা আছে এখানে থুতু, কফ, পানের পিক ফেলবেন, না ফেললে শাস্তি হবে। একটা কমার বিপর্যয়ে পুরো বাক্যটির অর্থই পাল্টে গেছে। আর তাতে নাকাল হয়েছে ছোট্ট অনন্যা। সেই বিপর্যয়ের সূত্র ধরে এই গল্পে মা অনন্যাকে বুঝিয়ে দেন বাংলা ভাষায় বিভিন্ন যতিচিহ্নের ভূমিকা।

দ্বিতীয় গল্প অনন্যাকে নিয়ে মাথাব্যথায় ওমর কায়সার নিপুণ দক্ষতায় প্রকাশ করেছেন বাংলা ভাষায় এক শব্দে বহু অর্থ প্রকাশ করার ক্ষমতা। একই শব্দ যে বাক্যে ব্যবহারের কারণে কত রকমের ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করতে পারে তা এ গল্পটি পাঠে চমৎকারভাবে জানা যায়। যেমন মাথাব্যথা, গাছের মাথা, গাঁয়ের মাথা, মাথার ঘিলু ইত্যাদি। বিকেলবেলা বেলাভূমিতেগল্পেও লেখক একই বিষয়টি তুলে ধরেছেন। পাতার গল্পঅনেকটা একই ধারার গল্প।

ছড়ার রহস্যগল্পে অনন্যা এবং মায়ের আলাপচারিতায় উঠে আসে বাংলা ভাষায় যুক্তবর্ণ চেনার সহজ উপায়। ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি, অনেকে যুক্তবর্ণগুলো শুদ্ধভাবে লিখতে পারলেও, মুখে উচ্চারণ করতে পারে না। বিশেষ করে জ্ঞ‘, ‘ঞ্জ‘ ‘ক্ত‘, ‘ত্রু‘, ‘ষ্ণএই যুক্ত ব্যঞ্জনগুলো উচ্চারণে অনেক উচ্চশিক্ষিতকেও আমি সংকটে পড়তে দেখেছি। ওমর কায়সার এ গল্পে মজার ছলে মায়ের মুখ দিয়ে যুক্ত ব্যঞ্জনগুলোকে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছেন। এক সাহসী ব্রাহ্মণও একই ধারার গল্প।

বৃষ্টিতে নতুন খেলাগল্পে লেখক চমৎকার দক্ষতায় গল্পচ্ছলে প্রকাশ করেছেন চন্দ্রবিন্দু ব্যবহারের নিয়ম। তাঁর এবং তার, রাঁধা এবং রাধা, কাঁদা এবং কাদা, গাঁদা এবং গাদা শুধু চন্দ্রবিন্দুর কারণে যে আলাদা অর্থবহ শব্দে পরিণত হয়েছে, তার গুরুত্ব বুঝিয়েছেন গল্পকার এ গল্পে। আবার উল্টাসোজা একইরকমগল্পে অনন্যা আর মা খেলেছে শব্দের খেলা। বাংলা ভাষার এমনকিছু শব্দ এ গল্পে তুলে ধরা হয়েছে যা উল্টাসোজা একইরকম। যেমন নয়ন, নতুন, চামচা, নবীন,লালা,কথক ইত্যাদি।

অনেক কাল আগের কথাগল্পে লেখক তুলে এনেছেন বর্ণমালা উদ্ভবের কথা। কেমন করে শব্দকে মানুষ নিজের প্রয়োজনে চিত্রে রূপ দিলো সে গল্প জানতে গিয়ে আমরা জেনে যাই বর্ণমালা আবিষ্কারের কাহিনি। হাতির গল্পপড়ে আমরা জানতে পারি বাংলা ভাষায় কীভাবে বিভিন্ন ভাষার শব্দের আগমন হলো তার ইতিহাস।

এভাবে একে একে মোটর কারটি কার‘, ‘গভীর রাতের গল্প‘, ‘হরবোলা নিরু‘, ‘ফুলের বাগানে পরিএবং আরও আরও গল্প দিয়ে ওমর কায়সার কখনো শেখান ণত্ব বিধান, কখনো ইকারউকার, কখনো বা রফলা,ঋ কারের নিখুঁত নিয়ম,কখনো সমাপিকাঅসমাপিকা ক্রিয়ার বানান। যে ব্যাকরণ বই পাঠ করতে গিয়ে ছাত্রছাত্রীরা গলদঘর্ম হয়, সেই একই নিয়মগুলো তারা হয়তো মজার ছলে শিখতে পারবে গল্পে শেখো বাংলা ভাষাপাঠে। ছোট ছোট গল্প হওয়াতে পাঠক এতে ধৈর্যহারা হবে না। বিশেষ করে যারা লেখালেখিতে আসতে চান, তাঁদের জন্য ভাষার নিয়ম জানাটা অত্যন্ত জরুরি। এই বইটি সেক্ষেত্রে সহায়ক হিসেবে ভূমিকা রাখবে। এমন সহজ করে বাংলা ভাষার অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য তুলে ধরার জন্য কবি গল্পকার ওমর কায়সারকে অশেষ ধন্যবাদ। আমি গল্পে শেখো বাংলা ভাষার বহুল প্রচার কামনা করি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইমরানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পার্লামেন্টে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর আবেদন
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর সাথে একদিন