কয়েকদিন চট্টগ্রামে ছিলেন রহিমা বেগম

যেভাবে উদ্ধার হলেন

আজাদী ডেস্ক | সোমবার , ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ১০:১৭ পূর্বাহ্ণ

রহিমা বেগম বেশ কয়েকদিন চট্টগ্রাম ও গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে ছিলেন। এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর বোয়ালমারীতে কুদ্দুসের বাড়িতে যান বলে জানিয়েছে পুলিশ। শনিবার তাকে ফরিদপুর থেকে উদ্ধার করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে খুলনা নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) মোল্লা জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, রহিমাকে উদ্ধারের পর শনিবার রাত ২টার দিয়ে দৌলতপুর থানায় নিয়ে আসা হয়। তাকে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখা হয়েছে। রহিমা বেগম কীভাবে উদ্ধার হলেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তারা তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। রহিমা কোনো মোবাইল ফোন ব্যবহার করেননি। সে কারণে তাকে ট্র্যাকিং করা সম্ভব হচ্ছিল না। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তারা জানতে পারেন, রহিমা ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামের কুদ্দুস মোল্লার বাড়িতে রয়েছেন। খবর বিডিনিউজের।
এরপর পুলিশের একটি দল রাত পৌনে ১১টার দিকে ওই বাড়িতে পৌঁছায়। পুলিশ সেখানে গিয়ে দেখতে পায়, রহিমা বেগম ওই বাড়িতে বসে দুজন নারীর সঙ্গে গল্প করছেন। তবে বাড়ির মালিক কুদ্দুস এ সময় ছিলেন না। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কুদ্দুসের ছেলে আলামিন, কুদ্দুসের স্ত্রী ও ভাইয়ের স্ত্রীকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে।
খুলনার মহেশ্বরপাশার বণিকপাড়া থেকে গত ২৭ আগস্ট নিখোঁজ হন ৫৫ বছর বয়সী রহিমা বেগম। এরপর থেকে তার সন্ধান করছিলেন তার মেয়ে মরিয়ম মান্নানসহ চার বোন। এ নিয়ে পরিবারের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনও করা হয়। গত বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহের ফুলপুরে তার মায়ের লাশ পাওয়া গেছে বলে মরিয়ম মান্নান ফেইসবুক পোস্ট দেন। এরপর এ নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশ হলে তা আলোচনায় আসে।
রহিমা অপহরণ মামলাটির তদন্ত দৌলতপুর থানা পুলিশের কাছ থেকে পিবিআইতে গেছে। তারপরও খুলনা মহানগর পুলিশ মামলাটির ছায়া তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছিল বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান উপ-পুলিশ কমিশনার জাহাঙ্গীর। তিনি বলেন, রহিমা বেগমের আশ্রয় নেওয়া বাড়ির মালিক কুদ্দুস বেশ কয়েক বছর আগে খুলনার সোনালী জুট মিলে চাকরি করতেন। তখন তিনি রহিমার বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। এরপর তিনি বোয়ালমারীতে চলে যান।
মুখ খুলেছেন রহিমা, দাবি অপহরণ : উদ্ধার হওয়ার প্রায় ১৬ ঘণ্টা পর গতকাল দুপুরে চার মেয়ের মুখোমুখি করার পর মুখ খুলেছেন খুলনার দৌলতপুর থেকে নিখোঁজ হওয়া রহিমা বেগম। তিনি দাবি করেছেন, নিজ বাসার আঙিনা থেকে ৪-৫ জন লোক মুখে কাপড় বেঁধে তাকে অপহরণ করেছিল।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) খুলনার পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বেলা আড়াইটার দিকে এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, শনিবার ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার সৈয়দপুর গ্রাম থেকে উদ্ধারের পর কোনো কথাই বলছিলেন না রহিমা বেগম। বেলা ১টার দিকে তাকে মেয়ে মরিয়ম মান্নানসহ চার মেয়ের মুখোমুখি নেওয়া হয়। এ সময় মেয়েরা মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কান্নারত অবস্থায় মেয়েরা মাকে বলতে থাকেন, আমাদের ছেড়ে আর কোনোদিন কোথাও যাবে না। আমাদের জমি দরকার নেই। তোমাকে দরকার। পরে অপহৃত হয়েছিলেন বলে দাবি করেন রহিমা বেগম।
জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে পুলিশ সুপার বলেন, রহিমা বেগমকে অপহরণের পর অজ্ঞাত স্থানে ছেড়ে দেওয়া হয় বলে দাবি করেছেন তিনি। জমি-জমার বিরোধ থাকা কিবরিয়া, মহিউদ্দিনসহ কয়েক ব্যক্তি তার কাছ থেকে সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর এবং বাড়াবাড়ি না করার হুমকি দেন। এক পর্যায়ে তাকে একহাজার টাকা দিয়ে ছেড়ে দেন।
তিনি জানান, রহিমা বেগমের দাবি, তিনি কিছুই চিনতে পারছিলেন না। এক পর্যায়ে গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর হয়ে পূর্ব পরিচিত ভাড়াটিয়া ফরিদপুরের বোয়ালখালীর সৈয়দপুর গ্রামে যান। কিন্তু তার কাছে কোনো মোবাইল নম্বর না থাকায় কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারেননি। আমরা রহিমা বেগমের বক্তব্য খতিয়ে দেখছি। তাকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। আইন অনুযায়ী সবকিছু করা হবে।
এর আগে দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার বলেন, রহিমা বেগমের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাটি অপহরণ না-ও হতে পারে। রহিমার কাছে সাদা রঙের একটি শপিং ব্যাগ উদ্ধার করা হয়েছে। যার মধ্যে ওড়না, হিজাব, আয়না, শাড়ি, আই ড্রপ, ওষুধ, সালোয়ার-কামিজ এবং ছোট একটি হাত ব্যাগ ছিল। সাধারণত একজনকে অপহরণ করে নিয়ে গেলে এই জিনিসগুলো থাকার কথা না। তিনি বলেন, আমরা এখনও মামলা তদন্ত করছি। যেহেতু আমরা তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে আছি, তদন্ত শেষে আমরা বিস্তারিত জানাব। আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, অপহরণ না-ও হতে পারে।
এই মামলায় দৌলতপুর থানা পুলিশ ও র‌্যাববের হাতে আটক ছয়জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে জানিয়ে পিবিআই পুলিশ সুপার বলেন, ইতোমধ্যে রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বলা যাবে তারা অপরাধী কিনা। যেহেতু আদালতে মামলা চলমান তাই জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আজই (গতকাল) রহিমা বেগমকে আদালতে তোলা হবে। পরের সিদ্ধান্ত আদালত দেবেন।
রহিমাকে উদ্ধারের খবর পেয়ে রাতে দৌলতপুর থানায় আসেন রহিমা অপহরণ মামলায় গ্রেপ্তার রফিকুল আলম ও নুরুল আলমের বাবা আনসার উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, তাদের সঙ্গে জমির সীমানা নিয়ে মতবিরোধ থাকায় তার দুই ছেলের নামে মামলা দিয়ে হয়রানি ও সম্মানহানি করা হয়েছে। রহিমা ও তার সন্তানরা অপহরণের নাটক সাজিয়েছে দাবি করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। একই দাবি করে একই মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া মহিউদ্দিন ও গোলাম কিবরিয়ার বড় ভাই নজরুল ইসলাম বলেন, রহিমা বেগমের সন্তানরা পুলিশ ও সাংবাদিকদের প্রায় এক মাস বিভ্রান্ত করেছে।
রহিমা বোয়ালমারী এসে আশ্রয় চান : নিখোঁজের ২৯ দিন পর আলোচিত রহিমা বেগমকে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার সদর ইউনিয়নের সৈয়দপুর গ্রামের কুদ্দুস মোল্লার বাড়ি থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। রহিমা ওই বাড়িতে এসে অপহরণের কথা বলেছিলেন। খুলনায় ফিরলে তাকে মেরে ফেলবে এমন কথাও বলেছিলেন বলে ওই বাড়ির সদস্যরা জানিয়েছেন।
গতকাল কুদ্দুস মোল্লার ভাগ্নে জয়নাল খান বলেন, ১৭ সেপ্টেম্বর দুপুরে রহিমা খাতুন আমার মামার বাড়িতে এসে আশ্রয় চান। উনি তাদের বলেন, উনাকে ছয় মাস আগে অপহরণ করা হয়েছিল। কিন্তু কোথায় ছিলেন তা আমাদের বলেননি, ঠিকানাও দেননি। উনি এটাও বলেন যে, আমি ওখানে (খুলনায়) গেলে আমাকে মেরে ফেলে দিবে। কিবরিয়ার সঙ্গে নাকি জমি নিয়ে ঝামেলা হয়েছে।
কুদ্দুস মোল্লার ছোট ছেলে আল আমিন রহিমার পরিবারকে বিষয়টি জানানোর চেষ্টা করে। আল আমিন কোথাও থেকে রহিমার ছেলে মিরাজের মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করেন। পরে সেই নম্বরে ফোন দিলে তা রিসিভ করেন মিরাজের স্ত্রী। তিনি রহিমা বেগমের কথা শুনে বিরক্তি প্রকাশ করেন এবং আবার ফোন করতে নিষেধ করেন।
পরে কুদ্দুস মোল্লার পরিবার শনিবার সকালে বিষয়টি বোয়ালমারী সদর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোশাররফ হোসেনকে জানান। মোশাররফ হোসেন একসময় কর্মসূত্রে খুলনায় ছিলেন। তিনি সকালেই খুলনা সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর সাইফুল ইসলামকে বিষয়টি জানান। ওই কাউন্সিলর খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশকে খবর দেন। বিকালে কাউন্সিলর কুদ্দুস মোল্লার পরিবারের সঙ্গেও কথা বলেন। পরে শনিবার রাতে খুলনা থেকে পুলিশ এসে রহিমা বেগমকে নিয়ে যায়। এ সময় খুলনার সেই কাউন্সিলরও পুলিশের সঙ্গে ছিলেন।
আমার কলিজা শান্ত হয়েছে : মরিয়ম
রহিমা বেগমকে খুলনায় পুলিশের ভিকটিম সেন্টারে দেখে এসে ফেইসবুকে এক পোস্টে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন তার মেয়ে মরিয়ম মান্নান। তিনি লিখেছেন, এই মাত্র দূর থেকে আমি আমার মাকে খুলনা ভিকটিম সেন্টারে দেখলাম। আমি আমার মাকে খুঁজেছি, পেয়েছি। আমার কলিজা শান্ত হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপিকআপ চাপায় কলেজ ছাত্র নিহত
পরবর্তী নিবন্ধসড়ক ও ফুটপাত থেকে ৫০ দোকানের বর্ধিত অংশ উচ্ছেদ