ক্রমেই বাড়ছে যানজট

নষ্ট হচ্ছে শ্রমঘণ্টা, দুর্বিষহ জনজীবন অবৈধ পার্কিং ও অসচেতনতাই মূল কারণ

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:২৯ পূর্বাহ্ণ

গতকাল সকাল ১১টা বিশ মিনিট। চেরাগীর মোড় হয়ে গন্তব্য চট্টগ্রাম কলেজ। সিএনজি টেক্সি এগুচ্ছে মন্থর গতিতে। কারণ দ্রুত চালানোর উপায় নেই। রাস্তার দুপাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে প্রাইভেটকার, জিপ, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল, রিকশা, সিএনজি টেক্সি। অপেক্ষায়, স্কুল ছুটি হবে; শিক্ষার্থী বাড়ি ফিরবে। কিন্তু রাস্তায় দাঁড়ানো ছাড়া উপায় নেই। তাদের স্থায়ী কোনো পার্কিং নেই। জনৈক পুলিশ কনস্টেবল ছুটছেন এ মাথা থেকে ওমাথা। চালক কর্ণপাত করছে না কনস্টেবলের নির্দেশ। ঘর্মক্লান্ত কনস্টেবল এক পর্যায়ে সেন্ট মেরীস স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে জিরোচ্ছেন, আর দেখছিলেন, জট লাগছে কীভাবে।বেলা সোয়া বারোটার দিকে দেখা গেল অন্য এক দৃশ্য। উদয় হলেন এক ট্রাফিক সার্জেন্ট। সাথে এক কনস্টেবল। শুরু হলো তোরজোড়। কিছুটা শৃঙ্খলা এলো। রাস্তা থেকে সরিয়ে দিচ্ছিলেন অবৈধভাবে অবস্থান করা গাড়িগুলো। তবে কাজটা যে শুধু মাত্র নিয়ম রক্ষার তা বুঝা গেল কয়েক মিনিট পরে। দেখা গেল খাস্তগীর স্কুল, আইইউবি, সেন্টমেরীসসহ আশেপাশের অন্যান্য স্কুলে পড়ুয়া কিছু শিক্ষার্থীদের গাড়িতে টোকা দিচ্ছেন না, চালকের সাথে বাকবিতণ্ডা অনেক পরের বিষয়। কারণ গাড়িগুলো সরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের গাড়ি।

এ বিষয়ে পুলিশের ভাষ্য, আইন অনুযায়ী তারা জরিমানা করতে পারেন না। শুধু রেকার দিয়ে থানায় নিয়ে যেতে পারেন। এছাড়া তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। ফলে অবৈধভাবে পার্কিং করা গাড়ি সরানো তাদের জন্য কঠিন।

সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-এর ৪৭ ধারায় বলা আছে, সরকার বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ, ট্রাফিক পুলিশের পরামর্শে মোটরযান পার্কিং এলাকা নির্ধারণ করতে পারবে। নির্ধারিত এলাকা ছাড়া পার্কিং করা যাবে না, যদি কেউ করে তা হবে অপরাধ। এই ধারার বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদন্ডে দণ্ডিত করা যাবে। একই সঙ্গে চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসেবে দোষসূচক ১ পয়েন্ট কর্তন করা হবে। যদিও এখন পয়েন্ট কাটার নিয়ম কার্যকর নেই।

বর্তমানে নগরীর অন্যতম সমস্যা যানজট। দিন যত যাচ্ছে সমস্যা তত প্রকট হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও মোড়গুলোর এক-তৃতীয়াংশই বর্তমানে প্রাইভেটকার, অটোরিকশা, রিকশা, ভ্যান ও ভ্রাম্যমাণ হকারের দখলে থাকে। এতে সাধারণ যানবাহন ও পথচারীদের চলাচলে চরমভাবে বিঘ্ন ঘটছে। স্কুল ছুটির সময় অবৈধভাবে পার্কিং করে রাখা ব্যক্তিগত গাড়ির কারণে যানজট অসহনীয় হয়ে ওঠে।

স্থানীয়রা বলেন, প্রচন্ড যানজট বেড়ে গেছে। বাচ্চাদের স্কুলের সময় পেরিয়ে যায়। প্রাইভেট গাড়ি যেখানে সেখানে দাঁড়ানোর কারণে যানজট বেড়েছে। যানজট ক্রমশ দুর্বিষহ করে তুলছে জনজীবন। নষ্ট হচ্ছে মানুষের শ্রমঘণ্টা। পুড়ছে জ্বালানি। নষ্ট জ্বালানিতে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ।

রাস্তায় পার্কিং প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ট্রাফিক পুলিশ ইন্সপেক্টর (টিআই প্রসিকিউশন-দক্ষিণ) অনিল চাকমা আজাদীকে বলেন, অবৈধ পার্কিং আমরা তখনই বলতে পারবো, যখন বৈধ পার্কিং প্লেস থাকবে। সেটাতো আমরা দিতে পারছি না নগরবাসীকে। এখন অবৈধভাবে পাকিং করা হলে বড়জোর মামলা দেই, জরিমানা করি। এর বেশি কিছু করার সামর্থতো আমাদের নেই। ভবনের অনুমোদন দিয়ে থাকে সিডিএ এবং তা মনিটরিংও তাদেরই করার কথা। একইভাবে রাস্তার উপরে কিংবা ফুটপাতে যদি কেউ গাড়ি পার্ক করে রাখে তাহলে সিটি কর্পোরেশন বা সিডিএ থেকে মোবাইল কোর্ট করা হয়ে থাকে। অবৈধ পার্কিং বন্ধে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে চিঠি পাঠিয়েছিলাম। উনারা মনে হয় নিজেদের মতো করেই কোনো পরিকল্পনা করতে চাইছেন। এছাড়া অসংখ্যবার নগরীর স্বনামধন্য স্কুলগুলোকে বাসের ব্যবস্থা করার অনুরোধ করে এখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।

ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মহানগরীর এম এ আজিজ স্টেডিয়াম এলাকা, আলমাস সিনেমা থেকে ওয়াসা মোড় সড়কসহ বিভিন্ন স্থানে মোট ৪২টি পার্কিং স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছে মহানগর ট্রাফিক পুলিশ। সেখানে গড়ে ১৫-২০টি করে গাড়ি পার্কিংয়ের সুযোগ হয়েছিল। পার্কিং স্থান নির্ধারণ করে দেওয়ার সময় ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এর মাধ্যমে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা আরো উন্নত হবে। যানজট নিয়ন্ত্রণে এসব পার্কিং স্থান উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। বাস্তবে দেখা গেছে, এসব পার্কিং স্থানের অধিকাংশই খালি থাকে।

চট্টগ্রাম শহরে ৫ লাখের বেশি যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক গাড়ি চলাচল করে। নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রাস্তা কিংবা ফুটপাতের উপর রাখা হচ্ছে গাড়ি। কিছু বিপণিকেন্দ্রে পার্কিং ব্যবস্থা থাকলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। নগরীর অধিকাংশ রেস্টুরেন্টে নেই গাড়ি পার্কিং সুবিধা। হাতেগোনা কয়েকটি রেস্টুরেন্টে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। বারিকবিল্ডিং মোড় থেকে বহাদ্দারহাট মোড় প্রধান সড়কের দুই পাশে, কদমতলী থেকে কোতোয়ালী মোড়, লালখানবাজার থেকে স্টেডিয়াম হয়ে জামালখান, চকবাজার, কাপাসগোলা, ষোলশহর, মুরাদপুর, নিমতলা থেকে হালিশহর হয়ে নয়াবাজার, সাগরিকা, অলংকার মোড় এলাকায় নামি-দামি যেসব রেস্টুরেন্ট রয়েছে সেগুলোর বেশিরভাগ গড়ে ওঠেছে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা ছাড়াই। চমেক হাসপাতালের পূর্ব গেট থেকে অলি খাঁ মসজিদের পশ্চিম পর্যন্ত সড়কের এক পাশ থাকে প্রাইভেটকারের দখলে। তাছাড়া আন্দরকিল্লা থেকে লালদীঘি মোড় পর্যন্ত সড়কের উভয় পাশের অভিন্ন চিত্র। একই চিত্র চেরাগি পাহাড় মোড় থেকে জামাল খান মোড়, নিউমার্কেট মোড় থেকে কোতোয়ালি মোড়সহ নগরের অধিকাংশ সড়কের। রাস্তার একাংশই যেন এখানে গাড়ির নির্ধারিত পার্কিং! মার্কেটে পার্কিং ব্যবস্থা না থাকায় গাড়িগুলো রাস্তার উপর থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এই এলাকার যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশকে নিতে হয় বিশেষ ব্যবস্থা।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আশপাশে গড়ে ওঠা বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা থাকলেও রোগী নিয়ে আসা গাড়ি কিংবা রোগীর আত্মীয়-স্বজনদের গাড়ি সেখানে পার্ক করতে দেওয়া হয় না। এতে করে নগরীর মেহেদীবাগ, গোলপাহাড় মোড় থেকে পাঁচলাইশ, নাসিরাবাদ হাউজিং থেকে প্রবর্তক মোড় হয়ে চকবাজার এলাকায় বিকাল থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ভয়াবহ যানজট লেগে থাকে। চমেক হাসপাতালের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা একাধিক গাড়ির চালকের সাথে কথা বলে এর সত্যতা পাওয়া যায়। মাহবুব নামের এক চালক গতকাল দুপুরে আজাদীকে বলেন, স্যার রক্ত পরীক্ষার জন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গেছেন। ওই প্রতিষ্ঠানে গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা থাকার পরও সেখানে তারা আমাকে গাড়ি রাখতে দেয়নি। তাই রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে আছি।

জুবিলী রোডে হার্ডওয়ার, মেশিনারিজ পার্টস, টাইলসের দোকান, পাইপের দোকান, পর্দা ও ফোমের দোকান রয়েছে। রাস্তার একটি লেন দখল করে এসব দোকানের পণ্য লোডিং ও আন-লোডিংয়ের কাজ চলে।

স্টেশন রোডের পুরাতন রেল স্টেশন থেকে শুরু করে আমতলা মোড় পর্যন্ত পুরো বেস্টনির ফুটপাত দখল করে রেখেছে হকাররা। যেখানে হকার নেই সেখানকার ফুটপাত দখল করে আছে গাড়ি। বাধ্য হয়ে রাস্তা দিয়েই হাঁটতে হয় পথচারীকে। জিপিওর সামনের ফুটপাত দোকান ও ভাসমান হকারদের দখলে থাকে।

নগরীর কাপাসগোলা থেকে বহদ্দারহাট মোড় পর্যন্ত রাস্তার একপাশ সিএনজি ট্যাঙির স্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। রাস্তার উভয়পাশে সিএনজি ট্যাঙির গ্যারেজ থাকায় অনেকেই রাস্তার ওপরে সিএনজি রেখে তা মেরামতের কাজ করছে। দুই লেনের রাস্তাটির দুই দিক দিয়ে চেপে ধরেছে ট্যাঙি পার্কিং স্ট্যান্ড।

কেবি ফজলুল কাদের চৌধুরী রোডের আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ মোড় থেকে প্রবর্তক মোড় পর্যন্ত রাস্তার একপাশ জুড়ে থাকে ক্লিনিক কেন্দ্রিক পার্কিং। ওষুধের দোকান, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও হাসপাতালগুলোর নিজস্ব পার্কিং স্পেস না থাকায় রাস্তার ওপরেই গাড়ি পার্ক করা থাকে। একইভাবে অনেক হাসপাতালের পার্কিং স্থান থাকলেও তা শুধুমাত্র ওই হাসপাতালের চিকিৎসক কিংবা কর্মকর্তাদের পার্কিং স্পেস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। রোগীদের গাড়ি এসব স্থানে পার্ক করা যায় না।

চট্টগ্রাম এম এ আজিজ স্টেডিয়ামকে কেন্দ্র করে চারপাশে গড়ে উঠেছে অনেকগুলো রেস্টুরেন্ট। রেস্টুরেন্টের পাশাপাশি এই এলাকায় রয়েছে চট্টগ্রামের প্রথম পাঁচ তারকা হোটেল র‌্যাডিসন ব্লু বে ভিউ, রয়েছে হল ২৪, চট্টগ্রাম ক্লাব, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন ও লেডিস ক্লাব। স্টেডিয়াম পাড়ার রেস্টুরেন্টের সামনে এক লেন দখল করে সন্ধ্যার পর সারিবদ্ধভাবে পার্কিং থাকে। আর যদি চট্টগ্রাম ক্লাব, হল ২৪, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বা লেডিসক্লাবে কোনো অনুষ্ঠান থাকে তাহলে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে থেকে স্টেডিয়াম মোড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন পর্যন্ত দীর্ঘ জটলা লেগে থাকে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআন্দোলনে নামছে রেলওয়ে শ্রমিক লীগ
পরবর্তী নিবন্ধপিঠে ডিভাইস, পাখিটি ‘ছাড়িল কে’