কোরবানীগঞ্জের লেখকত্রয়ী

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী | রবিবার , ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৬:২০ পূর্বাহ্ণ


কোরবানীগঞ্জ আমার কাছে চট্টগ্রাম শহরের একটি অবাক করা স্থান। কোরবানীগঞ্জ নিয়ে যতই ভাবি, আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটতে চায় না। কর্ণফুলীর নদীর পানি যখন নামতে নামতে ক্রমশ দক্ষিণ-পূর্বদিকে সরতে থাকে, তখন বহদ্দারহাট থেকে চাক্তাই, পাথরঘাটা, ফিরিঙ্গীবাজার প্রভৃতি ভূখণ্ড জেগে উঠতে থাকে। চাক্তাই খালের স্রোতধারা তখনো পূর্ণ যৌবন বেগে বহতা এবং লঞ্চ-সাম্পানে করে নিয়ে আসা পণ্য সওদা করার জন্য অনেকগুলো স্থানকে সংযুক্ত করে। কালক্রমে সেগুলি গঞ্জ নামে অভিহিত হতে থাকে। যেমন খাতুনগঞ্জ, কোরবানীগঞ্জ, বিটলীগঞ্জ, আছদগঞ্জ ইত্যাদি। কোরবানীগঞ্জ আমাদের মেয়র রেজাউল ভাইয়ের মতে তাঁদের বহরদার বংশের বিখ্যাত পুরুষ কোরবান আলী চৌধুরীর নামে নামকরণ হয়েছে। যেহেতু ভিন্ন কোন মত আমার সামনে নেই, তাই রেজাউল ভাইয়ের মতকেই সত্য বলে সাব্যস্ত করে নিচ্ছি।
রেজাউল ভাইয়ের অনেক গুণের মধ্যে একটি গুণের কথা প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে চাই। তিনি বেশি কথা বলেন না, ফাউল কথা বলেন না। পুঁথি সাহিত্যের সেই কথাটায় আমার অচলা ভক্তি-যে কহে বিস্তর মিছা সে কহে বিস্তর।’ রেজাউল ভাইও বোধ করি পুঁথি সাহিত্যকে মেনে কম কথাই বলেন।
যাই হোক, কোরবানীগঞ্জ বাণিজ্যের পসরা বিকিকিনির জন্যই খ্যাত হয়। কোরবানীগঞ্জ, আছদগঞ্জ, বিটলীগঞ্জ এসব গঞ্জ এমন গা জড়াজড়ি করে সংস্থাপিত হয়েছে যে, কোনটার সীমানা কোথায় তা নির্ণয় করা মুস্কিল। বিটলীগঞ্জ, কোরবানীগঞ্জ, বক্সিরহাটের মাঝখানেই আছে একটি পট্টি-সোনাপট্টি। সোনার ব্যবসার কেন্দ্র, কলকাতার পতিতাপল্লী সোনাগাছি নয়। কলকাতার যেমন জানবাজার, চট্টগ্রামের তেমনি খাতুনগঞ্জ, কোরবানীগঞ্জ, আছদগঞ্জ ইত্যাদি। সোনাপট্টিতে আমাদের নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের পিতামহ নজু মিয়া ও পিতা দুলা মিয়া সওদাগরের সোনার দোকানের অবস্থিতি।
কোরবানীগঞ্জে ছিলো বিখ্যাত ইমাম শরীফ ব্রাদার্সের কাপড়ের দোকান, যেখানে শহর তো বটেই, গ্রাম থেকেও মানুষ বিয়েশাদির বাজার করার জন্য আসতো। তো এই কোরবানীগঞ্জ, যার বাণিজ্য উৎপত্তি এবং খ্যাতির কথা আমরা আলোচনা করলাম, তার মধ্যে ফল্গুর মতো লেখকবৃত্তির একটা অন্তঃসলিলা আমরা লক্ষ্য করি।এম এ গফুর, সাঈদুল আরেফীন, রমজান আলী মামুন-তিনটি নাম, তিনজন লেখককে আমরা কোরবানীগঞ্জ থেকে উদয় হতে দেখি।
কোরবানীগঞ্জের লেখকদের মধ্যে গফুরই আদি। তারও অনেক আগের মানুষ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি ওই কোরবানীগঞ্জ বা খাতুনগঞ্জেই বড় হয়েছেন, পড়েছেন লামাবাজার প্রাইমারি স্কুলে। খাতুনগঞ্জের সৃষ্টির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব-ফসল ড. ইউনূস। তিনি একাধারে লেখক, সংগঠক, স্রষ্টা, শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ।
ড. ইউনূস বড় মানুষ। আমরা ছোট মানুষদের কথা বলতে চাই, যাদের কথা কেউ বলে না। গফুর পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি করে লেখক। সে পত্রিকায় পত্র লিখে থাকে। দৈনিক পত্রিকায় একটা সম্পাদকীয় পাতা থাকে, তাতে ‘চিঠিপত্র কলাম’ নামে চিঠিপত্রের জন্য বেশ কিছু স্থান বরাদ্দ থাকে। তার নিচে ছোট করে লেখা থাকে ‘মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নহেন’-অর্থহীন কথা। পত্রিকায় ছাপার অক্ষরে যা-ই প্রকাশিত হোক, তার জন্য সম্পাদকই দায়ী।
কিন্তু পত্রলেখকদের গুণে সম্পাদকীয় পাতাই সংবাদপত্রে প্রাণ সঞ্চার করে। তর্কযুদ্ধে চিঠিপত্র কলাম সদাই সরগরম থাকে। লন্ডন টাইমসের চিঠিপত্র কলামই সর্বশ্রেষ্ঠ সংবাদ।
তো আমাদের এম এ গফুররা ঘুরে ঘুরে চট্টগ্রামের বিভিন্ন সমস্যা খুঁজে বের করতো এবং তা পত্রিকায় সুন্দর করে লিখে প্রকাশের জন্য প্রেরণ করতো। প্রকাশও হতো। এই পত্রলেখকরাই হচ্ছেন দৈনিক পত্রিকার আদি রিপোর্টার।
বলা হয় ‘গাইতে গাইতে গায়েন, বাইতে বাইতে বায়েন’; পত্রিকায় পত্র লিখে লিখে পত্রলেখকরাও লেখক হয়ে যান। একটা উদাহরণ দিই। আমার মামা মুক্তিযোদ্ধা সিরু বাঙালি পত্র লিখে লিখেই এখন বিখ্যাত লেখক। তিনি যখন মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত ছিলেন তখন দৈনিক আজাদীতে ‘দুবাইর চিঠি’ লিখতেন। সেই চিঠি লেখা থেকেই তিনি লেখালেখির হাত মকশো করেন এবং লেখকের জাতে উঠে যান।
গফুর সম্ভবত ‘চট্টগ্রাম পত্র লেখক সংঘ’ নামে পত্র লেখকদের নিয়ে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলো। সেটি সংক্ষেপে ‘চপলেস’ নামে বিখ্যাত হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে গঠন করেন ‘জাতীয় পত্র লেখক সংঘ’, যেটি জাপলেস নামে পরিচিত। গফুরকে অনুসরণ করে পত্রলেখক হয় সাঈদুল। রমজান আলী মামুনও পত্রলেখক ছিলো একসময়। তবে আমি তাকে যতদিন থেকে দেখছি, লেখক হিসেবেই দেখছি।
চপলেস ভেঙ্গে কিংবা লেখালেখির জন্য আনিসুল ইসলাম রিয়াদ, নিজামুল ইসলাম সরফী, শাকিলরা ‘পত্রলেখক গোষ্ঠী’ বা ‘পলগ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলে।
যা-ই হোক, গফুর এখনো আজাদীতে পত্র লিখে নিজের অস্তিত্ব ও সুনাম অক্ষুণ্ন রাখছে। রমজান লেখালেখিতে প্রতিষ্ঠা লাভের পর চট্টগ্রামের শিশু সাহিত্যিকদের বুকে ‘ছেল’ মেরে অকালে জীবন থেকে ছুটি নিয়ে চলে গেল। সাঈদুল লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, শাকিল ‘প্রাবন্ধিক’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সরফি কর্মব্যস্ততার দরুণ লেখার জন্য সময় করে উঠতে পারে না। কিন্তু অবসর পেলে যখন লিখতে বসে, তখন তার হাত দিয়ে ভালো লেখাই বের হয়ে আসে। রিয়াদও প্রায় নিরুদ্দেশ। কোরবানীগঞ্জ থেকে যুগে যুগে আরো লেখকের জন্ম চট্টগ্রাম প্রত্যক্ষ করবে। কারণ কোরবানীগঞ্জ লেখক সৃষ্টির কারখানা, প্রতিভার উর্বর শস্যক্ষেত্র। কোরবানীগঞ্জেরই অদূরে বলু পোদ্দারের দিঘি পেরিয়ে মাস্টারপুলের পরে যেখানে মুনশি কাছিম আলী চাকমা রাজার কাছ থেকে তাঁর ‘টং’ ঘরটিকে কিনে ফরিদের পাড়া থেকে তাঁর পৈতৃক আবাস উঠিয়ে ভদ্রাসন বাটী নির্মাণ করেন, সেখান থেকে আমরা তিনজন মহিলা কবির উদ্ভব হতে দেখি। তাঁরা শেখ-এ-চাটগাম কাজেম আলী মাস্টার সাহেবের নাতনি, শের-এ-চাটগাম কংগ্রেস নেতা একরামুল হকের কন্যা শামসুন্নাহার, আইনুন্নাহার ও নুরুন্নাহার। অতএব, কোরবানীগঞ্জ এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চল সৃষ্টিশীল লেখকদের সূতিকাগার বললেও অত্যুক্তি হয় না।
লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতি সংগঠক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধনারী পাচার : পরিপ্রেক্ষিত চট্টগ্রাম