কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকার ও একজন কমলা হ্যারিস

কাজী রুনু বিলকিস | শনিবার , ৫ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৫:৫৯ পূর্বাহ্ণ

কমলা, শ্যামলা মায়া, এমন নামগুলো শুনলেই মনে হয় কাছের কেউ। দরজা খুলে বের হলেই এমন নামের কারো সাথে দেখা হয়ে যেতে পারে। অতি সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচন হয়ে গেল। নির্বাচনে ডেমোক্রাট প্রার্থী জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিস জুটির বিজয় হলো। বিশ্লেষকেরা বলছেন এই বিজয় আমেরিকানদের বিভাজনের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক বিজয়। তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কমলা হ্যারিসই প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেও নারীরা ভোট দেওয়ার অধিকার পায়নি। বহু আন্দোলন সংগ্রামের পর ১৯২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে ১৯তম সংশোধনীর মাধ্যমে নারীর ভোটাধিকার নিশ্চিত করা হয়। নারী ভোটাধিকার নিশ্চিত হলেও ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকার ছিল না। এনি লী কুপার ২৫ জানুয়ারি ডালাস কমিউনিটির কোট হাউসে ভোটার হিসেবে নাম লিখাতে এসে দাঁড়িছিলেন সকাল সাতটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত তারপরেও নাম লেখাতে পারেননি। সেলমা শহরের অর্ধেকেরও বেশি ছিল কৃষ্ণাঙ্গ, তাদের মধ্যে ভোটার হতে পেরেছিলেন মাত্র এক শতাংশ। এনি লী কুপার বহুবারের মত আজও ব্যর্থ হলেন তার সঙ্গীদের সাথে নিয়ে। তারপরেও তারা লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। শহরের শেরিফ তাদের নির্দেশ দিলেন সেখান থেকে চলে যাবার জন্য। শেরিফ জীম ক্লার্ক তার হাতের লাঠি দিয়ে গুতো দিলেন এনি লী কুপারের ঘাড়ে। এবার লীর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়িয়ে কষে ঘুষি মারলেন শেরিফের চোয়ালে। সেই ঘুষিতেই মাটিতে পড়ে গেলেন জীম ক্লার্ক। এই অপরাধে এনি লী কুপারকে মাটিতে ফেলে বেদম পেটানো হলো। তার বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা করা হলো এবং তাকে বন্দী করা হলো জেলে। আর এ সবকিছুই হলো তিনি ভোটার হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বলে। ১৯৬৫ সালের প্রথম দিকে কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং আন্দোলনকারীদের সঙ্গে নিয়ে বিশাল লোক সমাগম করে আলবামার রাজপথে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ও আন্দোলন পরিচালনা করেন। তাদের দাবি ছিল কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের ভোটাধিকারের সমস্ত বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া এবং পূর্ণাঙ্গ নাগরিক সুবিধা আদায় করা। কিন্তু তাদের এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে শ্বেতাঙ্গরা বর্বরোচিত আক্রমণ করে। এতে করে আন্তর্জাতিক বিশ্বের নজর পড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আন্দোলনের দিকে। পরের বছর চাপের মুখে প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন ভোটাধিকার আইনে স্বাক্ষর করেন। এই আইনে মার্কিন নাগরিকদের ভোটাধিকার অর্জন করতে সাক্ষরতাসহ বিভিন্ন প্রকার যোগ্যতা প্রমাণের পদ্ধতি বাতিল হয়। ভোটাধিকার আইনে কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে যে বর্ণবৈষম্য ছিল তা দূর করে। ভোটাধিকার পেলেও এই মহাশক্তিধর বিশ্বের মোড়ল, গণতন্ত্রের ধ্বজাধারীর এই দেশে আজও জর্জ ফ্লয়েডেরা বর্ণবাদের ক্লেদে ডুবতে ডুবতে বাঁচার আকুতি জানায়, I can’t breath, I can’t breath. বলছিলাম কমলা হ্যারিসের কথা। নামটা আমাদের সংস্কৃতির সাথে মিলে যায় তাছাড়া তাঁর শিকড় এই উপমহাদেশের বলে হয়তো তাঁর প্রতি আমাদের আগ্রহটা বেশী। যুক্তরাষ্ট্রে এবারের নির্বাচনে যে ইতিহাস রচিত হয়েছে তা নারীর এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস। এই প্রথম তারা কোন নারীকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নিয়েছে। কোন নারীকে রাষ্ট্রের শীর্ষে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আনতে নারীর ভোটাধিকার পাওয়ার পরও একশ বছর লেগেছে। সেই হিসেবে আমরাও এগিয়েছি বহুদূর। স্বাধীনতার ৪৯ বছরের অর্ধেককাল জুড়ে নারীর শাসন চলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই অর্জনের জন্য যেমন দীর্ঘ প্রতীক্ষা, তেমনি দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হয়েছে কমলা হ্যারিসকে। দুই অভিবাসীর সন্তান কমলা ক্যালিফোর্নিয়ার অকল্যান্তে জন্মগ্রহণ করলেও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিশেষ করে তামিলনাড়ুতে ঘরে ঘরে তাঁর বিজয়ের জন্য প্রার্থনা করে বহু মানুষ। কমলার মা শ্যামলা গোপালন ছিলেন ক্যানসার গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী, জন্ম ভারতেই। আর ডোনাল্ড হ্যারিসের জন্ম জ্যামাইকা। তিনি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কমলার যখন ৫ বৎসর বয়স তখন তার মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়।
কমলা বেড়ে উঠেছেন ভারতীয় ঐতিহ্যকে ধারণ করে। মায়ের সাথে ভারতেও এসেছেন। তাঁর মা কৃষ্ণাঙ্গ সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেছিলেন ফলে তারা দুই বোন কমলা ও মায়া এক মিশ্র সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠেছেন। তাঁর মা জানতেন বসবাসের জন্য তিনি যে দেশটি বেছে নিয়েছেন সেই দেশটা তাঁকে কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবেই গ্রহণ করবে। তার মা একটি বিষয়ে নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন তাঁর সন্তানেরা যেন আত্মবিশ্বাস এবং গর্বিত কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবেই বেড়ে উঠে। কমলা বরাবরই নিজেকে কৃষ্ণাঙ্গ পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কমলা ২০০৩ সালে প্রথমবার নির্বাচনে জিতে ক্যালিফোর্নিয়ার সানফ্রানসিসের ডিস্ট্রিক অ্যাটর্নী জেনারেল নির্বাচিত হন। ২০১৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার সিনেটর নির্বাচিত হন। ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়ে তাঁর প্রথম ভাষণে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে তিনিই প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট তবে তিনি শেষ নন। এই ভাষণে প্রায় ১০০ বছর আগের নারীর ভোটাধিকার পাওয়ার ইতিহাসও তুলে ধরেন। তার দীর্ঘ কর্মজীবনে অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দেন তিনি। ১৯৯০ সালে ওকল্যান্ডের এ্যাটর্নী জেনারেল হিসেবে যাত্রা শুরু, ২০১০ সালে প্রথম নারী, প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ এটর্নী জেনারেল পদে জয়ী হন। ২০১৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার প্রথম নারী সিনেটর হিসেবে নির্বাচিত হয়ে প্রথম পা রাখেন যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের উচ্চ কক্ষে। শুরু হয় নতুন যাত্রা। এরপর স্বপ্ন দেখেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার। এরই অংশ হিসেবে ২০১৯ সালেই মার্কিন নির্বাচনে প্রেসিডেন্টপ্রার্থী হতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। মনোনয়ন লড়াইয়ে একের পর এক বক্তব্যে সবার নজরে আসেন। ডিসেম্বরে মনোনয়ন দৌড় থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে জো বাইডেনকে সমর্থন দেন। কমলা নির্বাচনে জয়ী হয়ে আমেরিকার আড়াইশ বছরের ইতিহাসে প্রথম কোন কৃষ্ণাঙ্গ নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট হলেন প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভ্থত, আফ্রিকান-আমেরিকানদের মধ্যে দ্বিতীয় মার্কিন সিনেটর হওয়ার আগে নির্বাচনী প্রচারণায় কমলা হ্যারিস অভিবাসন, বিচার প্রক্রিয়া সংস্কার, ন্যূনতম মজুরী বৃদ্ধি, নারীর প্রজনন নিয়ে খুব সোচ্চার ছিলেন।
২০১৯ সালে জানুয়ারিতে তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই “দ্য ট্রুথস উই হোল্ড অ্যান আমেরিকান জার্নি” প্রকাশিত হয়। ২০১৪ সালে ডগলাস এমহফকে বিয়ে করেন। ডগলাস একজন আইনজীবী। তাঁর আগের সংসারের দুটি সন্তান রয়েছে কিন্তু ওই দুই সন্তানের কাছে কমলা মোটেই সৎ মা নন। তাদের কাছে তিনি প্রিয় “মমালা”।
বহুজাতি, ধর্ম, বর্ণের সমন্বয়ে গঠিত মার্কিন সমাজে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদের সংকীর্ণ রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসুক।
“দিস ইজ দ্যা টাইম টু হিল আমেরিকা”
-জো বাইডেন

পূর্ববর্তী নিবন্ধরোকেয়ার নারীবাদী চিন্তা
পরবর্তী নিবন্ধহেফজখানার শিক্ষার্থীরা পেল শীতবস্ত্র