কর্তৃত্বপরায়ণ, ক্ষমতালোভী, বিত্তশালীদের প্রভাব-প্রতিপত্তি হয় ভঙ্গুর, জনগণের হৃদয়ে এর কোনো স্থায়ী প্রভাব থাকে না। ক্ষণিকের শ্রদ্ধা ভালোবাসা সবই পোষাকী। যে শ্রদ্ধা ভালোবাসা অন্তরের গভীর হতে উদগীরণ হয় সেটাই প্রকৃত ভালোবাসা শ্রদ্ধা। মানুষের মন হতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে শ্রদ্ধা ভালোবাসা উত্থিত হয় সেটাই হলো অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও অনুরাগ। এ রকম একজন জ্ঞানতাপস, ত্যাগী, নিরহংকার, নির্লোভ, সমাজসেবক ও আপনজন পাঠক নন্দিত জনপ্রিয় ‘দৈনিক আজাদী’ পত্রিকার শ্রদ্ধেয় প্রতিষ্ঠাতা চট্টল গৌরব ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেক ১৯৬২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ইন্তেকাল করেন। (ইন্না……রাজেউন।) এই মহান ব্যক্তির স্মরণে বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে কিছু স্মরণীয় কীর্তি উপস্থাপন করছি।
আন্দোলন সংগ্রামের সুতিকাগার, বহু পীর-আউলিয়া বুর্জুগদের আবাসভূমি জ্ঞানতাপসদের পদ চারণায় মুখরিত এক জনপদের নাম রাউজান। বহু শতাব্দী হতে এতদ্অঞ্চলে শিক্ষা-সংস্কৃতি, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও পরিবেশের স্নিগ্ধতায় বেড়ে উঠা এ জনপদের কেন্দ্রস্থলে সুলতানপুর গ্রামের মুকিম বাড়িতে বেলায়ত আলী চৌধুরী ও বেগম ফজিলতুন্নেছার ঔরসে ১৮৯৬ সালের ২০ জুলাই মোহাম্মদ আবদুল খালেক জন্মগ্রহণ করেন। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়কার চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান বড় আদম লস্করের বংশধর ছিলেন বেলায়েত আলী চৌধুরী। আবদুল খালেক অতি অল্প বয়সে পিতৃমাতৃহারা হয়ে বড়ভাই আবদুল গনী চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে বড় হতে থাকেন পরিবারের অন্যান্যদের সহায়তায়। ২য়, ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণিতে বৃত্তি নিয়ে কৃতিত্বের সাথে পাস করেন। মেধাবী এ তরুণ ১৯১২ সালে রাউজান আরএএসি ইনস্টিটিউশন হতে এন্ট্রাস পরীক্ষায় চট্টগ্রাম জেলায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে ঈর্ষণীয় কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। একচ্ছত্র হিন্দু ছাত্রদের আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে একজন মুসলিম ছাত্র অভাবনীয় সাফল্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। চারিদিকে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়লে দূর-দূরান্ত হতে অনেক শিক্ষানুরাগীসহ সাধারণ লোক তাকে দেখতে আসতেন। মুসলিম ছাত্র ও অভিবাকদের মনে এ প্রত্যয় উদ্দীপ্ত হলো যে মুসলমানেরাও সাধারণ শিক্ষায় অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জনে সক্ষম। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের নিকট তার সাফল্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠে। ১৯১৪ সালে চট্টগ্রাম কলেজ হতে জেলা বৃত্তি নিয়ে আইএসসি পাস করে মেধার ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখেন। মাসিক পনেরো টাকা বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব নয় ভেবে তাঁর মন অস্থির হয়ে উঠে। এমতাবস্থায় পিতা বেলায়ত আলী চৌধুরীর চাচাতো ভাই কলিকাতার উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা জনাব আহমদ মিয়া চৌধুরী (আনজুমান ট্রাস্ট’র সাবেক জেনারেল সেক্রেটারি আবু মোহাম্মদ তবিবুল আলমের পিতা) ভাইপোর উচ্চ শিক্ষার ভার গ্রহণ করে মহানুভূবতার পরিচয় দেন। তিনি আবদুল খালেককে শিব্পুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন।
কৃতিত্বের সাথে চূড়ান্ত পরীক্ষায় পাস করে তিনি মেধার বিকাশ ঘটান। তড়িৎ প্রকৌশলী হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করে চট্টগ্রাম ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানীতে চাকুরি নেন। কাজের প্রতি নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও দক্ষতা দেখে কর্তৃপক্ষ অতি অল্প সময়ে তাঁকে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি দেন। চাকুরীতে তিনি স্থিত হতে পারছিলেন না। মন যেন বলতে চাইছে, ‘হেথা নয় হেথা নয়, অন্য কোথা অন্য কোনোখানে’। অতৃপ্ত মনের খোরাক অন্বেষণের তাগিদে তিনি ১৯৩২ সালে লোভনীয় পদের চাকুরী থেকে ইস্তফা দেন। পদোন্নতি ও বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাবেও তিনি চাকুরীতে ফিরে যাননি। কেননা অনেক বড় ও মহৎ কাজ তাঁর জন্য অপেক্ষামান। বিনে সূতোর টানে নাড়ির স্পন্দনে যাত্রা শুরু করলেন জীবনের নতুন অধ্যায় সৃজনে ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাসে।’ ইতোমধ্যে ১৯২৯ সালে কোহিনূর লাইব্রেরী ও ১৯৩০ সালে কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন একটি অপরটির পরিপূরক হিসেবে। লাইব্রেরি জ্ঞান আহরণ বিতরণের স্থান, আর প্রেস হল লেখক কবি সাহিত্যিক সৃষ্টি করার অন্যতম একটি মাধ্যম। কেননা লেখকের সৃষ্টি ছাপার অক্ষরে পরিস্ফুট না হলে পাঠকের নিকট পৌঁছবে না। জ্ঞান নির্ভর সমাজ বিনির্মাণেও কবি সাহিত্যিক লেখক সৃষ্টির সফল উদ্যোক্তা ছিলেন এ মহর্ষি। সমাজসেচতন জ্ঞান পিপাসু বহু গুণে গুণান্বিত অনন্য প্রতিভাধর আবদুল খালেক’র প্রতিটি কর্মোদ্যোগ স্রষ্টার নির্দেশিত পথে মানবকল্যাণের পদাযাত্রায় উদ্ভাসিত ছিল। ১৯৬০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ঐতিহ্যকে ধারন করে দৈনিক আজাদী পত্রিকা প্রকাশ করেন, যা অদ্যাবধি অনেক ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে কালের বিবর্তনে মহীরূহ রূপ ধারণ করেছে। ধর্ম ও ধামিকর্তা তার পারিবারিক ঐতিহ্য, এই ঐতিহ্যের রক্তধারা বংশানুক্রমে তাঁর ধমনীতে প্রবাহিত ছিল। শিশুকাল হতেই তিনি ধর্মানুরাগী ছিলেন। মুয়াজ্জিন, ইমামতি’র গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও তিনি মাঝে মধ্যে পালন করেছিলেন। এছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনে শিক্ষাদানে তৎপর ছিলেন মনের আনন্দে।
আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট ও জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়ার সাবেক সম্পাদক ও সিলসিলায়ে আলিয়া কাদেরিয়ার অন্যতম খলীফা বন্ধুবর আবদুল জলিল বিএ (মাস্টার আবদুল জলিল)-এর সাথে ত্রিশ দশকের কোন এক সময় রেঙ্গুন ভ্রমণে যান আবদুল খালেক। সেখানকার মশহুর বাঙালি জামে মসজিদের খতীব বিশ্বনন্দিত আধ্যাত্মিক সাধক আওলাদে রসূল, কুতুবুল আউলিয়া, হযরত আলহাজ্ব হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি (রহ.)’র সাথে তাঁর মোলাকাত হয় জলিল সাহেবের মাধ্যমে। হুজুর ছিলেন জলিল সাহেবের মুর্শিদ। প্রথম সাক্ষাতেই ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের মন বিগলিত হয়ে উঠে। কিছুদিনের মধ্যে সিরিকোটি (রহ.)’র মুরীদ হয়ে অন্তরের প্রশান্তি লাভ করেন। নিজেকে ধন্য মনে করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন স্বল্প সময়ের ব্যবধানে। পরিশুদ্ধ মন নিয়ে নব উদ্যোগে যাত্রা শুরু হয় ভিন্ন এক অভিযাত্রায়। অর্থাৎ তিনি আল্লাহ্-রসূল প্রেমে গভীরভাবে উদ্বুদ্ধ হলেন পীরের তাওয়াজ্জু পাওয়ার কারণে। আপন মুর্শিদকে চট্টগ্রামে পদধুলি দিতে অনুরোধ করেন আদব ও বিনয়ের সাথে। রেঙ্গুন যাত্রাপথে ১৯৩৬ সালে সর্বপ্রথম হুজুর সিরিকোটি (রহ.) স্বল্প সময়ের জন্য চট্টগ্রামে যাত্রা বিরতি করেন।
১৯৪১ সাল থেকে হুজুর নিয়মিতভাবে প্রতি বছর চট্টগ্রাম ও ঢাকায় আসা যাওয়া শুরু করেন। কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস’র ওপর তলায় মুর্শিদ কিবলার আস্তানা (খানকাহ শরীফ) স্থাপন করা হয়। সৈয়দ আহমদ শাহ্ (রহ.) এখান হতেই ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত শরীয়ত তরীকত, সিলসিলায়ে আলিয়া কাদেরিয়া তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত’র প্রচার প্রসারে নবী, ওলী প্রেমিক সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে অহোরাত্র পরিশ্রম করেছেন। তাঁর অবিস্বরণীয় ভূমিকার কারণে আমরা আজ ঈমানদার সুন্নী মুসলমান দাবী করছি। বাতিলপন্থীদের খপ্পরে পরে ঈমানহারা হবার সমূহ সম্ভাবনা ছিল আমাদের। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব নিরবিচ্ছিন্নভাবে হুজুরের মিশনের প্রয়োজনীয় রসদের আঞ্জাম দিতেন। মহান মুর্শিদের অমূল্য অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্বীকার করার সাথে সাথে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের অবদানকে কখনো অস্বীকার করা যাবে না। হুজুরের ইহসান’র কোন মূল্য যেমন দেয়া অসম্ভব, তেমনি ইঞ্জিনিয়ার দম্পত্তির খেদমত সিলসিলায়ে আলিয়া কাদেরিয়ার জন্য অমূল্য সম্পদ।
বিশ্বনন্দিত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠা জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া প্রতিষ্ঠান লগ্নে ও আনজুমান -এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট’র বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত থেকে অতুলনীয় খেদমত করে যেমন মুর্শিদের স্নেহভাজন হতে পেরেছেন, তেমনি লক্ষ লক্ষ পীর ভাইবোনগণ তথা নবীওলী প্রেমিকদের মনেও তিনি শ্রদ্ধাসনে অধিষ্ঠিত হতে সক্ষম হয়েছেন। হুযূর প্রিয় মুরীদকে খেলাফত দানে ধন্য করেছেন এতে মুরীদের সারাজীবনের সাধনা পূর্ণতা পেয়েছে। দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতা অর্জনকারি আমাদের অগ্রজ পরম শ্রদ্ধাভাজন ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন আমাদের মনে। আজকের এ দিনে সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করছি এ মহামনীষীকে। তিনি এতিম মিসকিন গরীব-দুঃখীদের প্রতি সর্বদা সদয় ছিলেন। তাঁদের সাথে ইফতার করতেন অনেক সময়। অনেক ভিক্ষুককে আজাদী পত্রিকার হকার করে স্বাবলম্বী করেছেন। তুরস্কের ভূমিকম্প ও বাংলাদেশে (১৯৬০ সালে) প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জ্বলোচ্ছ্বাসের সময় রিলিফ টিম গঠন করে ত্রাণ পাঠিয়েছেন মানবদরদী আবদুল খালেক। তাঁর আদর্শ ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আমাদের জন্য অনুকরণীয় অমূল্য সম্পদ। তিনি সমাজের অনুপ্রেরণার উৎস। দৈনিক আজাদী প্রতিষ্ঠা ছাড়াও তিনি নিজে একজন সুলেখক ও কবি ছিলেন। তার লেখা ১৭টি ছোট বড় বইয়ের খোঁজ পাওয়া যায়। মাতৃভাষা, মাতৃভূমি ও দেশবাসীর প্রতি ছিল গভীর শ্রদ্ধা ও মমত্ববোধ। মেধা মনন ও ধর্মের সংমিশ্রণে গঠিত তাঁর কর্মস্পৃহা আমাদের মনে উৎসাহ্ আবহ সৃষ্টি করে। ‘তিনি নেই এ জগতে, তবুও তিনি জাগ্রত সদা আমাদের মনে।’ মানবপ্রেম, সততা, আল্লাহ্ রসূল (দ.) নিকট সমর্পিত বহুবিধ গুণাবলী সম্পন্ন আলোকিত মানুষ আব্দুল খালেক দ্যুতি ছড়াবে চিরকাল। নির্দ্ধিধায় বলতে পারি, ‘তোমার কীর্তির চেয়েও তুমি মহৎ।’
মরহুমের পুত্র জনাব এম.এ. মালেক পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছেন। আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট’র সম্মানিত উপদেষ্টা হিসেবে সম্পৃক্ত আছেন। দৈনিক আজাদীসহ প্রকাশনা জগতে অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজসেবামূলক বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃত্বে থেকে সমাজ বিনির্মাণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছেন এম.এ. মালেক।
লেখক : প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স সেক্রেটারি, আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট।