শুভবুদ্ধির সঙ্গে যুক্তি নির্ভরতাই ছিল আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের বৈশিষ্ট্য

মইনুদ্দীন কাদেরী শওকত | শনিবার , ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৮:৪৪ পূর্বাহ্ণ

যে সকল ক্ষণজন্মা ব্যক্তিদের চিন্তা ও পরিশ্রমে দেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে সংবাদপত্র প্রকাশনার ও সাংবাদিকতার পরিবেশ গড়ে উঠেছিল এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম সিকিভাগে বাঙালি মুসলমানদের নবজাগরণের গোড়াতে যে কয়জন বরেণ্য ব্যক্তি ত্যাগ ও সাধনার দ্বারা জাতীয় চিন্তা- চেতনাকে সমৃদ্ধ করেছিলেন-তাঁদেরই শীর্ষ স্থানীয় ব্যক্তিত্ব হলেন আলহাজ্ব আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার। পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার ও কৃতিত্বের সাথে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি লাভ করা সত্ত্বেও জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে দেশের মানুষের মানবিক বিকাশে সহায়তা করার জন্য তিনি লাইব্রেরি ও ইলেকট্রিক প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। মরহুম ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ছিলেন সমাজ সচেতন ব্যক্তিত্ব ও সংগঠক। তাই জনমত গঠনের সংবাদপত্র শক্তিশালী হাতিয়ার মনে করেই তদানিন্তন বৃটিশ আমলে যতগুলো সংবাদপত্র চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হয়েছিল প্রায় সবগুলো পত্রিকা প্রকাশের ব্যাপারে তিনি সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন।
১৯৪৭ সালের ১৪ই ও ১৫ আগস্ট ভারত বিভক্তির কিছুদিন পর মরহুম ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ‘সাপ্তাহিক কোহিনুর’ প্রকাশ করেন। ‘সাপ্তাহিক কোহিনুর’ এর মাধ্যমে তিনি তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার পক্ষে যুক্তিপূর্ণ ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। ১৯৬০ সালে তিনি দৈনিক আজাদী প্রকাশ করেন। আজাদীর প্রকাশের দিন ছিল ১২ই রবিউল আউয়াল অর্থাৎ হুজুর (সঃ) জন্ম দিবস। চট্টগ্রামের বাঙালি মুসলমান সমাজে মরহুম ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ছিলেন অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব। আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষিত মুসলমান যুবকদের মত তিনি গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেননি। দেশের মাটি আর মানুষের কাছাকাছি থেকে তাঁর জীবনের একটি আদর্শ ও উদ্দেশ্য গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তদানিন্তন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যেকার বৈষম্যে এ দেশের অনেক পত্রিকা সম্পাদক চুপ করে থাকাকে বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক মনে করেছিলেন। কিন্তু, আলহাজ্ব আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার সাহেব চুপ করে থাকেননি-প্রতিবাদ করেছেন। তাঁর জীবিত থাকাকালীন অর্থাৎ ১৯৬০ থেকে ৬২ সালের মধ্যে প্রকাশিত দৈনিক আজাদী্থর সম্পাদকীয় পড়লেই তা বুঝা যাবে।
শুভবুদ্ধির সাথে যুক্তি নির্ভরতাই ছিল আলহাজ্ব আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের বৈশিষ্ট্য। যুক্তিহীন কুসংস্কার ও বুদ্ধিহীনতার বিরুদ্ধে তিনি চির আপসষহীন ছিলেন। রাজনৈতিক ও সামপ্রদায়িক উত্তেজনায় দেশ যখন দিশেহারা ছিল, সে দুঃসময়েও তিনি বিচলিত হননি। তাঁর মধ্যে সবচেয়ে বড়গুণ ছিল মনুষ্যত্ববোধ। যেটাকে কেউ কোনদিন হার মানাতে পারেনি।
মরহুম ইঞ্জিনিয়ার বৃহত্তর দায়িত্ববোধ নিয়ে সংবাদপত্র প্রকাশ করেছিলেন এবং পত্রিকা চালাতেনও নিজের ঈড়হারপঃরড়হ-এ। তাই, তাঁর সম্পাদিত পত্রিকার মধ্যে বিবেকের, মনুষ্যত্বের ও সত্যজিজ্ঞাসা পরিচয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। তিনি স্বাধীনভাবে, সবরকম পল্লব গ্রহীতা বর্জন করে নিজের মতামত নিজস্ব ভঙ্গিতেই প্রকাশ করে গিয়েছিলেন। গতানুগতিক, চিন্তাধারার অনুসরণ তিনি করেননি-নতুন করে ভেবেছেন সব বিষয়েই। ফলে তাঁর ভূমিকা অন্যের চিন্তাকে দিয়েছিল নাড়া, পাঠকদের মনে জাগিয়ে তুলেছিল নতুন জিজ্ঞাসা। সমসাময়িক চিন্তাশীল ও সম্পাদকদের মধ্যে মরহুম ইঞ্জিনিয়ারের স্থান ছিল প্রথম সারিতে। দেশে সংবাদপত্রের যে কয়েকজন দিকপাল ছিলেন তাঁদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। স্বাধীন যুক্তি বিচার ছাড়া কোন জ্ঞান-সাধনাই সার্থক হতে পারে না। তাই আলহাজ্ব আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের পৃষ্ঠপোষকতায় চট্টগ্রামের মুসলিম সাহিত্যিকরা এই যুক্তি-বিচারের বীজ বপন করেছিলেন সেই সময়েই। মরহুম ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন কেন্দ্র থেকে দূরে, সেই নক্ষত্রমন্ডলীর একপাশে-যারা দেশের সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের নক্ষত্র ছিলেন। কেন্দ্রের দূরে থেকে এই নক্ষত্র (ইঞ্জিনিয়ার সাহেব) উজ্জ্বল ও স্নিগ্ধ আলো বিকিরণ করেছিলেন দীর্ঘকাল ধরে। যাঁরা তাঁকে জানতেন, তাঁর সান্নিধ্যে এসেছিলেন্ততাঁরা এই আলোর সন্ধান রাখতেন এবং এর মূল্য ভালভাবেই বুঝতেন।
আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন ইসলামী সংস্কৃতির এক শ্রেষ্ঠ ও পূর্ণ বিকশিত ধারক। তাঁর চলনে-বলনে, স্বভাব-চরিত্রে, পোশাক-পরিচ্ছদে, আদব-কায়দায়, মনের গড়ন ও জীবন দর্শনে ইসলামী ভাবধারা ও সংস্কৃতি এক চমৎকার রূপ নিয়েছিল। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আল্লাহ ও আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করে গিয়েছিলেন। পুরোপুরিভাবে আল্লাহর হুকুম মেনেছিলেন, হুজুরে পাক (সাঃ) এর তরীকার উপর জীবন কাটিয়ে ছিলেন।
আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার যখন সংবাদপত্র প্রকাশ করেছিলেন তখন আদর্শিক প্রেরণা থেকেই সংবাদপত্র প্রকাশ করা হত। দেশপ্রেম, বস্তুনিষ্ট সত্য, নীতি আদর্শই ছিল সংবাদপত্রের মূলমন্ত্র। দেশের মানুষের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক স্বার্থের নিরিখেই ছিল আমাদের সাংবাদিকতা। কারো উপর আক্রোশ চরিতার্থ করার জন্য বা কারো স্তাবকতায় পরিণত হবার জন্যে তখন সংবাদপত্র ভূমিকা পালন করতনা। অন্ধবিদ্বেষ এবং উন্মদনার আঁধি ঘন কুয়াশা সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের চোখে ঘোর সৃষ্টি করতোনা। সংবাদপত্র প্রশস্তি গাঁথার দিনপঞ্জীও ছিলনা।
আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার প্রতিষ্ঠিত দৈনিক আজাদীই বাংলাদেশে প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র। অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১এ দেশ স্বাধীন বা দখলদার বাহিনী মুক্ত হবার পর ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ দৈনিক আজাদী ছাড়া দেশে আর কোন সংবাদপত্র প্রকাশ হয়নি। ১৮ডিসেম্বর, ১৯৭১ থেকে বাংলাদেশে অন্যান্য সংবাদপত্র প্রকাশনা শুরু করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ জুনের ঘবংিঢ়ধঢ়বৎং অহহঁষসবহঃ ড়ভ উবপষধৎধঃরড়হং অপঃ বলে ১৬ জুন থেকে দেশের অন্যান্য সংবাদপত্রের মত আজাদীও বন্ধ হয়ে যায়। ১৫ আগষ্টের পট পরিবর্তনের পর সেপ্টেম্বর মাসে দৈনিক আজাদী পুনরায় প্রকাশের অনুমতি পায়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, যেই ঘবংিঢ়ধঢ়বৎং অহহঁষসবহঃ ড়ভ উবপষধৎধঃরড়হং অপঃ বলে দৈনিক আজাদী সহ দেশের সংবাদপত্রগুলো বন্ধ করা হয়েছিল-১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের নন্দনকাননে বাংলাদেশ টেলিভিশনের চট্টগ্রাম সমপ্রচার কেন্দ্র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যে ঐ অপঃ বাতিল করার কথা ঘোষণা করেছিলেন। পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালে নির্বাচিত সংসদ ঐ অপঃ বাতিল করে।
দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ত্যাগী ছিলেন। তিনি বুঝতেন ত্যাগ মানুষকে করে নিরহংকার, নির্লোভ, নিঃস্বার্থ, পরহিতব্রতী, দেশ ও মানবসেবামুখী। এই গুণাবলীই দেশপ্রেমের অন্তর্নিহিত মূলসুর। তখন যারা সংবাদপত্র প্রকাশ করতেন। তাঁরা প্রায় সকলেই ত্যাগী ছিলেন। সম্মানজনক ব্যতিক্রম ছাড়া এখন সংবাদপত্র প্রকাশনার সাথে যুক্ত হয়েছে অবসরপ্রাপ্ত দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর আমলা, চোরাকারবারী, কালোটাকার মালিক ও দেশের বাইরের বিভিন্ন কুচক্রী মহলের উচ্ছিষ্ট ভোগী ব্যক্তিরা। যাদের কাছে নেই দেশের মাটি ও মানুষের প্রতি কোন দরদ-ভালবাসা, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের কোন গুরুত্ব । এরা দেশের সংবিধান, আইন, অনুসরণীয় আচরণ বিধি কিছুই মানেনা। মিথ্যা, মুখরোচক, জনরঞ্জিনী, ভিত্তিহীন সংবাদ পরিবেশন করে জনমতকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চালায়। চালায় তথ্য সন্ত্রাস, সৃষ্টি করে তথ্য সন্ত্রাসী। সংবাদপত্র ও মহান সাংবাদিকতা পেশাকে কারো অপকর্মের ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হতে উচিত নয়। দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার পরমত সহিষ্ণুতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাস করতেন। কামনা করতেন জনগণে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সৎ ও দায়িত্ববান ব্যক্তিরা দেশ পরিচালনা করুক। জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতার অপব্যবহার বা এর অন্যায় সুযোগ গ্রহণের হীন মানসিকতার প্রতি ইঞ্জিনিয়ার সাহেব সমভাবে আপসহীন ছিলেন।
আলহাজ্ব আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের বহু রচনাই নানাকাগজে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সেগুলো আজো সংগৃহীত হয়নি, হয়নি পুস্তকাকারে মুদ্রিত। বাংলাদেশ প্রেস ইনষ্টিটিউট (পি আই বি) দেশের পথিকৃৎ সাংবাদিক-সম্পাদকদের কয়েকটি নির্বাচিত লেখা ও সংক্ষিপ্ত জীবনি দিয়ে ‘পথিকৃৎ’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছে ১৯৮৮ সালে। মরহুম আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার, মরহুম মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীসহ অন্যান্য পথিকৃৎদের নির্বাচিত লেখা ও জীবনি দিয়ে এ ধরনের আরো বই পিআইবি প্রকাশ করলে উত্তরসূরীরা উপকৃত হত।
পারিবারিক জীবনে আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার একমাত্র পুত্র সন্তান ও পাঁচ কন্যার জনক। তাঁর একমাত্র পুত্র জনাব আবদুল মালেক দৈনিক আজাদীর বর্তমান সম্পাদক। জনাব মালেক চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব ও চট্টগ্রাম ক্লাবের সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রামের সংবাদপত্র পরিষদের সভাপতি ছাড়াও বিভিন্ন সমাজসেবামূলক সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন। জান্নাতবাসী পিতার মত তিনিও মানুষের সেবা এবং কল্যাণে উদারমনে এগিয়ে আসেন। মরহুম ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের জামাতারা হলেনঃ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ মরহুম ডাঃ আবদুল আহাদ, মোহরা ইউনিয়নের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মরহুম শামসুল হুদা কাদেরী (বড়মিয়া), ডাঃ আফ্‌তাব উদ্দিন, সাবেক সংসদ সদস্য, আজাদীর সাবেক সম্পাদক মরহুম অধ্যাপক আলহাজ্ব মোহাম্মদ খালেদ, সাবেক সরকারি কর্মকর্তা বিরল সৎ ব্যক্তিত্ব মরহুম মোহাম্মদ আলী চৌধুরী। মরহুম ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের আত্মীয়-স্বজনদের অনেকেই সাংবাদিকতা পেশায় রয়েছেন।
আজাদীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার ১৮৯৮ সালের ২০ শে জুলাই রাউজান থানার সুলতানপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন এবং ১৯৬২ সালের ২৫ শে সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ইন্তেকাল (ইন্নালিল্লাহ্ত্ত্তে-রাজেউন) করেন। পশ্চিম ষোল শহরের জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া মাদ্রাসার মসজিদ সংলগ্নে তাঁকে দাফন করা হয়েছিল।
মনুষ্যত্ব, স্বদেশপ্রেম, দুঃস্থ মানুষের প্রতি অসাধারণ মমত্ববোধ, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতার বিকাশে কার্যকর অগ্রণী ভূমিকা, সর্বোপরি চট্টগ্রামের সর্বাধিক প্রচারিত ও জনপ্রিয় পত্রিকা “দৈনিক আজাদী”র প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আলহাজ্ব আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার সংবাদপত্রের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
লেখক : সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা

পূর্ববর্তী নিবন্ধআবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার যুগ সচেতন সত্তা
পরবর্তী নিবন্ধকীর্তিমানের কীর্তিকথা