কীভাবে শেষ হবে যুদ্ধ

হাইপারসনিক মিসাইল দিয়ে অস্ত্রভাণ্ডার ধ্বংস করল রাশিয়া, আজভ সাগর থেকে বিচ্ছিন্ন ইউক্রেন

আজাদী ডেস্ক | রবিবার , ২০ মার্চ, ২০২২ at ৮:১৫ পূর্বাহ্ণ

চার কোটি ৪০ লাখ মানুষের গণতান্ত্রিক দেশ ইউক্রেনে হামলার সময় ভ্লাদিমির পুতিনের দাবি ছিল যে, আধুনিক ও পশ্চিম-ঘনিষ্ঠ ইউক্রেন রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকি। কিন্তু চার সপ্তাহ ধরে বোমাবর্ষণ, হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু আর লাখো মানুষের ঘরবাড়ি হারিয়ে শরণার্থী হওয়ার পর প্রশ্ন রয়ে গেছে, যুদ্ধের পেছনে রাশিয়ার উদ্দেশ্য আসলে কী? এ থেকে বেরিয়ে আসার কোন পথ কি আছে?
কী চায় রাশিয়া : ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার জনগণের উদ্দেশ্যে দেয়া বক্তব্যে বলেছেন, তার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ইউক্রেনের নিরস্ত্রীকরণ এবং নাৎসি মুক্ত করা। তার দাবি, এর মাধ্যমে আট বছর ধরে ইউক্রেনের সরকারের নির্যাতন ও গণহত্যা থেকে মানুষজনকে মুক্ত করা হচ্ছে। ‘ইউক্রেন দখল করে রাখা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরা গায়ের জোরে কোনো কিছু বা কাউকে অপসারণ করতে চাই না,’ তিনি জোর দিয়ে বলেছেন। সর্বশেষ শান্তি আলোচনা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, রাশিয়া আর ইউক্রেনের সরকারকে
ক্ষমতাচ্যুত করতে আগ্রহী নয়। বরং তারা এখন ইউক্রেনকে নিরপেক্ষ একটি দেশ হিসেবে দেখতে ইচ্ছুক। তিনি দাবি করেন, রাশিয়া আর ইউক্রেনের মানুষ এক জাতি। তিনি ইউক্রেনের ইতিহাস অস্বীকার করে জোর দিয়ে বলেছেন, ইউক্রেন কখনোই প্রকৃত রাষ্ট্র ছিল না।
যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসার কী উপায় : ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের একজন পরামর্শক মিখাইলো পোডোলায়াক বিশ্বাস করেন, আগামী কয়েকদিন মধ্যেই একটি যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে। কারণ রাশিয়ার সৈন্যরা তাদের বর্তমান অবস্থানে আটকে গেছে। আলোচনায় উভয় পক্ষই ইতিবাচকভাবে কথা বলছে। পোডায়ালাক বলেছেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার দাবিদাওয়ার বিষয়ে নমনীয় হয়েছেন।
যুদ্ধের শুরুতে রাশিয়ার নেতা চেয়েছিলেন যেন ক্রাইমিয়াকে রাশিয়ার অংশ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয় এবং বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত দুটি এলাকার স্বাধীনতাকে মেনে নেয়া হয়। সংবিধান সংশোধন করে ইউক্রেনকে এই নিশ্চয়তা দিতে হবে যে, তারা কখনো ন্যাটো বা ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেবে না। তবে রাশিয়া সমর্থিত বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত লুহানস্ক এবং দোনেৎস্ক-এর ভবিষ্যৎ কি হবে, তা নিয়ে এখনো কোন সমঝোতা হয়নি। কিন্তু দুই পক্ষ যদি বিষয়টি নিয়ে পরবর্তীতে আলোচনা করতে চায়, তা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না।
রাশিয়ার আচরণে মনে হচ্ছে যে, ইউক্রেনের সরকারকে উৎখাত করে বেলারুশের মতো সেখানে পুতুল সরকার বসাতে পারবে না, সেটা তারা মেনে নিয়েছে। যুদ্ধের শুরুতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদামির জেলেনস্কি বলেছিলেন, শত্রুরা আমাকে এক নম্বর লক্ষ্যবস্তু করেছে, আমার পরিবার দুই নম্বর লক্ষ্যবস্তু। কার্নেগি মস্কো সেন্টার এবং আরপোলিটিক এর বিশ্লেষক তাতিয়ানা স্তানোভায়া বলছেন, মনে হচ্ছে ভ্লাদিমির পুতিনকে দাবি-দাওয়ার অনেক ছোট তালিকায় সম্মত হতে হবে। কারণ রাশিয়া এখন ইউক্রেনকে তার সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীসহ অস্ট্রিয়া বা সুইডেনের মতো একটি নিরপেক্ষ, নিরস্ত্র দেশ হিসেবে মেনে নেয়ার বিষয়ে বিবেচনা করছে।
ইউক্রেনের অস্ত্রভাণ্ডার ধ্বংস : রাশিয়া বলছে, শব্দের চেয়েও দ্রুত গতিসম্পন্ন হাইপারসনিক মিসাইল ব্যবহার করে তারা পশ্চিম ইউক্রেনের একটি ক্ষেপণাস্ত্রের ডিপো ধ্বংস করেছে। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইগর কোনাশেংকভ বলছেন, ইভানো-ফ্র্যাংকিভিস্ক অঞ্চলে মাটির নিচে তৈরি ইউক্রেন বাহিনীর এই অস্ত্রভাণ্ডারে মিসাইল এবং বিমান থেকে উৎক্ষপণযোগ্য গোলাবারুদ রাখা ছিল। রুশ মিসাইল আঘাতে ডিপোটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। তবে এই দাবির সত্যতা কোনো নিরপেক্ষ সূত্র থেকে যাচাই করা সম্ভব হয়নি। ইউক্রেন লড়াইয়ে রাশিয়া সম্ভবত এই প্রথম হাইপারসোনিক মিসাইল ব্যবহার করলো বলে ধারণা করা হচ্ছে। বায়ুমণ্ডলের উচ্চতম স্তর দিয়ে এই মিসাইল শব্দের চেয়েও পাঁচগুণ দ্রুত গতিতে চলে। রাশিয়ার সামরিক বাহিনী জানাচ্ছে, ইউক্রেনের ওপর হামলায় তারা ‘কিনঝাল’ মিসাইল ব্যবহার করেছে। এটি দুহাজার কিলোমিটারেরও বেশি দূরত্ব অতিক্রম করতে পারে এবং কোনো বিমান বা মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে একে ঠেকানো যায় না।
আজভ সাগর থেকে বিচ্ছিন্ন ইউক্রেন : বন্দরনগরী মারিউপোলে রাশিয়ার বাহিনীগুলো তাদের অবস্থান জোরদার করায় আজভ সাগরে ইউক্রেনের প্রবেশ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে গেছে বলে দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। গত শুক্রবার রাতে এক বিবৃতিতে মন্ত্রণালয়টি বলেছে, দখলকারীরা দোনেৎস্কের অভিযানরত জেলায় আংশিক সফলতা পেয়েছে আর ইউক্রেন আজভ সাগরে প্রবেশ থেকে সাময়িকভাবে বঞ্চিত হয়েছে। তবে ইউক্রেনীয় বাহিনীগুলো সাগরটিতে প্রবেশের অধিকার ফের আদায় করে নিতে পেরেছে কিনা, বিবৃতিতে মন্ত্রণালয়টি তা নির্দিষ্ট করে বলেনি, জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
শুক্রবার রাশিয়া জানিয়েছিল, তাদের বাহিনীগুলো মারিউপোলের চারপাশে অবস্থান জোরদার করে শহরটিকে আরও হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে আর তাতে শত্রুপক্ষের জন্য পরিস্থিতি মোকাবেলা কঠিন হয়ে পড়েছে। মারিউপোলের মেয়র ভাদিম বইশেঙ্কো জানিয়েছেন, লড়াই নগরীর কেন্দ্রস্থলে পৌঁছে গেছে। রুশ সেনারা শহরের কেন্দ্রস্থলে পৌঁছে গেছে বলে রাশিয়া এর আগে যে খবর দিয়েছিল, এর মাধ্যমে সেটিই নিশ্চিত করছেন ভাদিম।
বিবিসি জানিয়েছে, শহরটির ভেতরে লড়াই চলছে, রাশিয়ার সেনারা সাঁজোয়া বহর নিয়ে শহরের ভেতরে ঢুকে পড়ছে। এর আগে পশ্চিমা সমর বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন, সপ্তাহ দু’য়েকের মধ্যেই শহরটির পতন হতে পারে। রুশ বাহিনীর হামলায় নগরীর ৮০ শতাংশের বেশি আবাসিক ভবন হয় ধ্বংস নয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এর ৩০ শতাংশই আর পুনরুদ্ধার করার মতো অবস্থায় নেই বলে জানিয়েছেন মেয়র ভাদিম। তিনি জানান, মারিউপোলের যে নাট্যশালায় রুশ বাহিনী বোমাবর্ষণ করেছিল তার ধ্বংসস্তূপ থেকে বেসামরিকদের বের করে আনার কাজ চলছে, কিন্তু লড়াইয়ের কারণে উদ্ধারকাজ বিঘ্নিত হচ্ছে।
পশ্চিমারা তথ্য যুদ্ধ করছে : পশ্চিমারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে তথ্য যুদ্ধ চলাচ্ছে, যার মধ্যে তথ্য সন্ত্রাসও রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্জেই ল্যাভরভ। রাশিয়ার সরকার পরিচালিত টেলিভিশন চ্যানেল আরটি টিভিতে গত শুক্রবার প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে এ অভিযোগ তোলেন ল্যাভরভ। তিনি বলেন, যখন গণবিক্ষোভ, আন্দোলন বা এখন কিছু ঘটে যেটা তারা (পশ্চিমারা) পছন্দ করে না, তারা সঙ্গে সঙ্গে সেটিকে অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস বলে ফেলে। এটা একটি যুদ্ধ, এটা একটি যুদ্ধ সেখানে তথ্য সন্ত্রাসের কৌশলও অবলম্বন করা হচ্ছে। সেখানে এটা হচ্ছে এবং এটা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।
ল্যাভরভের মতে, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের মিডিয়া হাউজগুলো বিশ্বের তথ্য ক্ষেত্র নিয়ন্ত্রণ করে। রাশিয়া সেখানে একটি শালীন জায়গা দখল করে আছে। ওইসব (পশ্চিমা) হাউজগুলো কি ধরনের তথ্য দিচ্ছে, সেগুলো কতটা মানসম্পন্ন সেটা অন্য বিষয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজয়দেবপুরে জনতা এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে
পরবর্তী নিবন্ধইউক্রেনের পতাকার রঙের পোশাকে মহাকাশ স্টেশনে রুশ নভোচারী