গত ২২, ২৩ এবং ২৪ জুলাই চট্টগ্রামে আপাতত শেষবারের মত মঞ্চস্থ হলো ‘কিনু কাহারের থেটার’ । বিখ্যাত নাট্যনির্মাতা মনোজ মিত্রের এই স্যাটায়ারধর্মী নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক অসীম দাশ। নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী সহ আরো অন্যান্য বিভাগের অতিথি কলাকুশলীরা এতে অংশগ্রহণ করে। ভাবতে ভালো লাগে যে আমিও সেই দলের একজন ছিলাম।
শো শেষে দর্শকদের প্রতিক্রিয়া ছিলো ইতিবাচক। অসাধারণ শিল্পকর্ম, শৈল্পিক উপস্থাপনা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের বিশেষণ আমাদের উপর বর্ষিত হয়। তবে আমার বিষয়টি নিয়ে একটা ব্যতিক্রমী দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে।
আমরা শিল্পী কিনা জানি না, ‘শিল্প কী?’ এই শব্দ বা ভাব গাম্ভীর্যের জটিলতার মধ্যেও জড়াতে ইচ্ছা করে না। শিল্পী যদি তার সময়ের সন্তান হয় এবং শিল্পকর্ম নিয়ে সচেতন থাকেন তাহলে কোনো শিল্পবোদ্ধা কারো কাজকে শিল্পের কাতারে ফেলবেন কি না এতে কিছু আসে যায় না। ব্যাপারটি এমন যে রবীন্দ্রনাথকে কেউ কবিগুরু উপাধি না দিলেও রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথই থাকতেন তাঁর সৃষ্টিকর্মের জন্য। তিনি কেবল তাঁর কর্ম সাধন করে গেছেন। তিনি কখনো নিজেকে কবিসম্রাট বা বিশ্বকবি হিসেবে ভাবেননি, তিনি কেবল সৃষ্টি করে গেছেন। যে শিল্পবোদ্ধা একজনকে শিল্পী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, সেই শিল্পবোদ্ধাকে কে স্বীকৃতি দ্যায় ! বিষয়টি বেশ মার প্যাঁচের। যাই হোক আমাদের কাজ শিল্পসমৃদ্ধ হলো কিনা, আমরা শিল্পী কিনা, আমাদের কাজ শিল্প হলো কি না তা নির্ণয় করার জন্য শিল্পবোদ্ধারা আছেন আবার শিল্পবোদ্ধারা শিল্পবোদ্ধা কিনা তা বলার জন্য হয়তো আরও কেউ আছেন। আমরা কেবল যখন মানুষের উপর জুলুম দেখি, শোষণ দেখি, মানুষকে অচেতন দেখি, মানুষকে অন্ধ দেখি, মানুষকে নিভে যেতে দেখি, আমাদের ভিতরে কেমন যেন লাগে ! শুধু মনে হয় এটা অমন না হয়ে এমন হতে পারতো। এজন্য একটা তাগিদ কাজ করে। হয়তো আপনারা এর একটা নামও দিয়ে ফেলেছেন ‘সত্য সুন্দর’। হতে পারে ওরকম কিছু একটা।
তাই আমরা যা পারি তাই দিয়ে কেবল সেই অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই। কখনো তা কবিতা, কখনো গান, চিত্র, নাটক ইত্যাদি । এগুলো শুধু এক একটা উপায়। আমরা ঠুলি পড়া চোখের উপরের ঠুলিকে উঁচু করে ধরি, অকেজো হৃদয়কে ধাক্কা মেরে আবার সচল করার চেষ্টা করি, আমরা আবার মূর্চছাপ্রায় দেহকে বারবার ঝাঁকুনি দিয়ে সচেতন রাখার চেষ্টা করি এই উপায়গুলোর মাধ্যমে।
আমাদের এই চেষ্টাটা এমন যে ‘জীবনের জন্য শিল্প’।
আমরা মনে করি ‘মনোজ মিত্র’র এই সৃষ্টি আমাদের আরও একটা উপায়, যার প্রতিটি সংলাপে ঘুমন্ত মানুষকে ঘুম থেকে জেগে ওঠার আহ্বান জানানো হয়, যেখানে নাটকের প্রতিটি গানে দর্শকদের বিবেককে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়, যার প্রতিটি ঢোলের বাড়ি, বাঁশির সুর ঐকতান হয়ে শুধু আপনার ‘আপনি’কে ডেকে তোলার চেষ্টা করে। আপনাকে ভাবতে সহায়তা করে। এই পরিবেশনাটি আপনি এবং আপনার সময় সম্পর্কে সচেতনতার এক গায়েবি আওয়াজ দ্যায় ।
নাটকটির নামেও আছে এক সৌন্দর্য । ‘থিয়েটার’ না বলে বলা হচ্ছে ‘থেটার’। মূলত এটি এক ধরনের প্রতিবাদ, সেই একরোখা সব প্রমিত নিয়মের বিরুদ্ধে। এই নামকরণে প্রকাশিত হয় সেই সব খেটে খাওয়া শোষিত মানুষদের কথা যারা কেবল ‘থেটার’ বলে ‘থিয়েটার’–কে নির্দেশ করে নিজেদের আদর্শকে প্রচার করলেই চলে । অতো শুদ্ধতার স্কুলিং এদের নেই। এ–নামকরণেই মিশে আছে সেই সব শোষিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত মানুষের জীবনব্যবস্থা।
আরেকটি মজার ব্যাপার হলো নাটকটির কাহিনি এমন যে নাটকের মধ্যে নাটক। ‘কিনু কাহারের থেটার’ দলের দলনেতা কিনুমাস্টার পালা করতে যায় বিভিন্ন গ্রামে, মেলায় এধরনের জনসমাগমে, তাদের এমন একটি পালার নাম ‘ঘন্টাকর্ন’ যেটাকে ঘিরে মূল নাটকটি শুরু হয়।
কিনু’র লেখা ঘন্টাকর্ন পালা’র যে রাজ্য তার নাম হলো ‘পুতনা রাজ্য’ । ঘন্টাকর্ন হলো সেই রাজ্যের এমন এক সরল সহজ চরিত্র যে কিনা জীবিকার তাগিদে বিভিন্ন ধরনের কাজ করে। সেই রাজ্যের উজির একবার লাম্পট্যর দায়ে ১৪ ঘা চাবুকের সাজা পেলেঘন্টাকর্ন’র সরলতা ও অভাবের সুযোগ নিয়ে বউ এর কাছ থেকে ঘন্টাকর্নকে অপরাধী হিসেবে কিনে ফেলে। এভাবে সবার পাপের শাস্তি ঘন্টাকর্ণ নিতে থাকে। শেষ পর্যন্ত টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যায় নিজের সহধর্মিনীও। ‘সাজাখেকো অফিসার ‘তকমা নিয়ে বাধ্য হয়ে সবার পাপের সাজা ঘন্টাকর্ণ বইতে থাকে। অবশেষে পুতনা রাজ্যের রাজা নিজের মৃত্যুদন্ডের সাজাও ঘন্টাকর্ণকে নিতে বলে। সাজা যেখানে ‘মৃত্যুদন্ড’ তাই ভোম্বল–বোকাসোকা ঘন্টাকর্ণের মাঝেও উদয় হয় বিপ্লবের। কিন্তু তখনই চলে আসে পুলিশ ছাগল খুঁজতে। তখন ঘন্টাকর্ণ পালার চরিত্রগুলো হয়ে যায় কিনুর থেটারের কলাকুশলী।
পুরো ব্যাপারটি মিলেই একটা নাটক যেটা দর্শকরা দেখে। গ্রামীণ পালাগুলোতে যেমন অসচেতনভাবে হয়ে যাওয়া ভুলগুলো থাকে, যেমন হুট করে রাজার পার্ট আগে চলে আসা, লাট সাহেবের কোমরে বেল্টের পরিবর্তে পাটের দড়ি ইত্যাদি। এই বিষয়গুলো নাটকেরই অংশ হওয়াতে এই ভুলগুলো যেন সুনিপুণভাবে শুদ্ধতায় রূপ নেয়। বারবার ভুলবশত কিনুর লেখা ঘন্টাকর্নপালা ভেঙ্গে যায়, কিনু এসে আবার কৌশলে তা ঘন্টাকর্ণ পালায় নিয়ে যায়। ঘন্টাকর্ণ পালা ভেঙ্গে গিয়ে অভিনয়ের কাহিনির মধ্যে কিনুর বাস্তবতা ফিরে আসে । তবে এটাও নাটকেরই অংশ। আবার সেই নাটকের সাথে মিশে যায় আমাদের বাস্তবতা। অবশেষে কিনু মাস্টারের ‘ঘন্টাকর্ণপালা শেষ করতে পারে না এই কারণে যে পালার মধ্যে ছাগল নিয়ে একটা দৃশ্য থাকায় থেটারের লোকজন অদূরে ঘুরতে থাকা একটি ছাগল ধরে কোনোভাবে সিনটা সেরে ফেলে। ঘন্টাকর্ণ পালার অন্তিম মূহুর্তে পুলিশ এসে বলে ‘দারোগা বাবুর মেমসাহেবের কোলের ছাগল কে ধরে এনেছে?’
ঘন্টাকর্ণ পালার দৃশ্যে ছাগলটির মৃত্যু হয় । তাই ছাগল মারার দায়ে পুলিশ এসে কিনুর থেটারের সব কিছু লন্ডভন্ড করে দেয়।
এসব কিছুর মধ্য দিয়ে দর্শকরা বুঝতে পারে বাংলা আর পুতনা রাজ্যে কোন তফাৎ নেই। রাজা উজিরের শোষন, লাট সাহেবের ঔপনিবেশিকতায় কিভাবে প্রতিটি সাধারণ জনগণ পুতনা রাজ্যের মতো এই তল্লাটে ঘন্টাকর্ণে পরিণত হয়। এছাড়া ‘মৌনিবাবা’র ভন্ড সাধুগিরি, উজির–লাটসাহেবের উদাসিনী নামক বেশ্যার কাছে নিয়মিত যাতায়াত, পুলিশের ছাগল খোঁজা রাজ্যর বিশেষ পরিস্থিতিকেই সামনে নিয়ে আসে। এই মূলত নাটকটির ফোকাস। তবে প্রকাশভঙ্গি কমেডি হলেও তার পেছনে লুকিয়ে আছে করুণ শোষণের স্যাটায়ার।
কিনু কাহারের থেটার–এর গল্পটা এমন যে প্রতিটি চরিত্রই মৃত। পরপার থেকে সেই থেটারের চরিত্রগুলো এসে হাজির হয় পালা দেখানোর জন্য। তাদের দলনেতা ‘কিনু’র লেখা ‘ঘন্টাকর্ণ’ নাটকের মাধ্যমে আমাদের মাঝে সচেতনতার বার্তা দিয়ে যায়। এ–এক গভীর অনুভব। যুগে যুগে ধর্ম বা ন্যায় যখন সংকটে পড়ে তখনই সত্যের আগমন ঘটে । সত্য স্বয়ং নিজেই অবতার রূপে আসে, আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে কৃষ্ণ, মোহাম্মদ, বুদ্ধ আর যিশুদের মত মহাজনেরা। কিনু কাহার প্রতীকী অর্থে সেই সত্যের বাহক। হয়তো আমাদের কয়েকটা শো হওয়ার পর এ–নাটক থেমে যাবে। কিন্তু কিনু কাহার থেটার দলের সেই অতৃপ্ত আত্মাগুলো আবার ভর করবে কোনও থিয়েটার কর্মীদের। এই অতৃপ্তি শেষ হবার নয়। এই অতৃপ্তি অনিয়মের বিপরীতে বহমান থাকে।