কিছুই হয়নি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের শাস্তি পেলেন সিস্টেম এনালিস্ট

এইচএসসির ফলাফলে অসঙ্গতি

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ২১ জুলাই, ২০২২ at ৭:১৩ পূর্বাহ্ণ

২০২১ সালে প্রকাশিত এইচএসসির ফলাফলে অসঙ্গতির ঘটনায় শাস্তি পেলেন চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট কিবরিয়া মাসুদ খান। শাস্তি হিসেবে এই কর্মকর্তার বেতন গ্রেড বিদ্যমান গ্রেডের এক ধাপ নিম্নস্তরে অবনমন করা হয়েছে। গতকাল বুধবার (২০ জুলাই) এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষ। বোর্ডের সচিব প্রফেসর আবদুল আলীমের স্বাক্ষরে জারিকৃত প্রজ্ঞাপনে এ আদেশ (বেতন গ্রেড নিম্নধাপে অবনমন) চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে কার্যকরের কথা বলা হয়েছে। তবে এ ঘটনায় শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ফলাফলে অসঙ্গতি ও হ-য-ব-র-ল অবস্থার নেপথ্যে বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথের দায় ও ব্যর্থতা উঠে আসলেও তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, বোর্ডের নিজস্ব কর্মকর্তা হওয়ায় সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে শিক্ষাবোর্ডের। কিন্তু বিসিএস (শিক্ষা) ক্যাডারের কর্মকর্তা ও বোর্ডে প্রেষণে নিয়োগ প্রাপ্ত হওয়ায় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের এখতিয়ার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বোর্ডের নিজস্ব কর্মকর্তা সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্টের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে একই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মন্ত্রণালয় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাছে ব্যাখ্যা তলব করে আরো ১৬ দিন পর! যদিও ব্যাখ্যা তলবের চিঠিতে সময়সীমাও উল্লেখ করেনি মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্টদের দাবি, স্বাভাবিকভাবে এ ধরনের ব্যাখ্যা তলবের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা উল্লেখ করে দেয়া থাকে। কিন্তু পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের বেলায় মন্ত্রণালয় সেটিও করেনি। যার কারণে এটিকে দায়সারা ব্যাখ্যা তলব হিসেবেই অভিহিত করেন সংশ্লিষ্টরা। মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা বলতে দায়সারা ওই ব্যাখ্যা তলব পর্যন্তই। পরবর্তীতে আর কোনো ব্যবস্থার কথা জানা যায়নি।

মন্ত্রণালয়ের লিখিত নির্দেশনার প্রেক্ষিতে বোর্ডের নিজস্ব কর্মকর্তা সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট কিবরিয়া মাসুদ খানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যান প্রফেসর মুস্তফা কামরুল আখতার। ব্যাখ্যা তলব-ব্যক্তিগত শুনানিসহ সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেই চূড়ান্তভাবে শাস্তিমূলক এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানান বোর্ড চেয়ারম্যান।

উল্লেখ্য, গত ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয় ২০২১ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল। ওই দিন দুপুরে ফল প্রকাশের পর চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের ওয়েবসাইটে পরীক্ষার্থীদের প্রাপ্ত নম্বর প্রদর্শনে নানা অসঙ্গতি দেখা দেয়। পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়ে এমন হ-য-ব-র-ল অবস্থায় প্রশ্নের মুখে পড়ে বোর্ডের ভাবমূর্তিও। এ ঘটনায় পাবলিক পরীক্ষা গ্রহণ, পরিচালনা, ফলাফল তৈরি ও প্রকাশের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষাবোর্ডের কার্যক্রমে আস্থার সংকটও তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন শিক্ষা বোর্ড সংশ্লিষ্টরা। ফল প্রকাশের পরদিন (১৪ ফেব্রুয়ারি) থানায় জিডির পাশাপাশি এ ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে শিক্ষাবোর্ড। পটিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহাম্মদ মোজাম্মেল হককে প্রধান করে গঠিত কমিটি গত ৩ মার্চ শিক্ষাবোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। কমিটির অপর দুই সদস্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এ এইচ এম সাজেদুল হক ও চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সহকারী সচিব সম্পাতা তালুকদার। ফলাফলে অসঙ্গতি ও হ-য-ব-র-ল অবস্থার নেপথ্যে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথের দায় ও ব্যর্থতা উঠে আসে তদন্ত প্রতিবেদনে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পরপরই তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পাঠায় শিক্ষাবোর্ড। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে বোর্ডের নিজস্ব কর্মকর্তা সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট কিবরিয়া মাসুদ খানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণে নির্দেশনা দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সরকারি মাধ্যমিক-২ শাখার যুগ্মসচিব খালেদা আখতারের স্বাক্ষরে গত ১৫ মার্চ এ নির্দেশনা দেয়া হয়। তবে একই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মন্ত্রণালয় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাছে ব্যাখ্যা তলব করে আরো ১৬ দিন পর। সরকারি মাধ্যমিক-২ শাখার উপসচিব আলমগীর হুছাইন কর্তৃক ১ এপ্রিল স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথের কাছে এ সংক্রান্ত ব্যাখ্যা তলব করা হয়। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে দেয়া মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়, গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে ২০২১ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে অসঙ্গতি সংক্রান্ত দৈনিক আজাদী পত্রিকায় ‘মোট নম্বর ২০০, পেল ২১৮! দুপুরে প্রাপ্ত নম্বর পাল্টে গেল সন্ধ্যায়’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ তারিখে ‘শিক্ষাবোর্ডের তদন্ত কমিটি, থানায় জিডি’ শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন দৈনিক আজাদী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

উল্লেখিত প্রতিবেদনের বিষয়ে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি তদন্ত শেষে নিম্নরূপ মন্তব্য করে- ‘তদন্ত কমিটি তদন্ত কার্য সম্পাদন করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, ১১/০২/২০২২ ইং তারিখ বিকাল ৫টা থেকে রাত ১০.১০টা পর্যন্ত ফলাফল প্রসেসিং রুমের কম্পিউটারের টেবুলেশন অনিরাপদ রাখায় ফলাফল তৈরিতে সন্দেহ সৃষ্টি করে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত। ফলাফল সংশোধনের বিষয়টি বোর্ডের নীতিমালার ব্যত্যয় ঘটিয়ে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এবং আইটি টিমের সদস্যরা নিজেরাই সংশোধনের কাজ করতে গিয়ে দুধরনের নম্বরফর্দ প্রাপ্ত হওয়ায় চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে। যেহেতু পরীক্ষার ফলাফল তৈরি সংক্রান্ত সকল দায়-দায়িত্ব পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের, সেহেতু এর সম্পূর্ণ দায় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের উপর বর্তায়।’

বর্ণিতাবস্থায় ২০২১ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে অসঙ্গতি এবং এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির মতামতের বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হয় চিঠিতে। তবে ব্যাখ্যা প্রদানে চিঠিতে সময়সীমাও উল্লেখ করেনি মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাভাবিকভাবে এ ধরনের ব্যাখ্যা তলবের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা উল্লেখ করে দেয়া থাকে। কিন্তু পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের বেলায় মন্ত্রণালয় সেটিও করেনি। যার কারণে এটিকে দায়সারা ব্যাখ্যা তলব হিসেবে অভিহিত করেন সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক ওই সময় আজাদীকে বলেন, কোন কোন ক্ষেত্রে সময় উল্লেখ করা থাকে না। তবে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের আলোকে ‘ব্যর্থতা ও দায় পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের/এইচএসসির ফলাফলে অসঙ্গতি নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন’ শিরোনামে গত ৪ এপ্রিল আজাদীর প্রথম পাতায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের সচিব এ মন্তব্য করেন।

প্রসঙ্গত, পরীক্ষা গ্রহণ, পরিচালনা, ফলাফল তৈরি ও প্রকাশের দায়িত্ব শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা শাখার। আর পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এ শাখার প্রধান। এদিকে, কেবল ফলাফলের এই অসঙ্গতিতেই শেষ নয়। ফলাফল প্রকাশ পরবর্তী ভুল তারিখে ছাপানো হয় এইচএসসির ৪০ হাজারেরও বেশি ট্রান্সক্রিপ্ট। এইচএসসি পরীক্ষা ২০২১ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হলেও ওই পরীক্ষার ফল প্রকাশের তারিখ উল্লেখ করা হয় ২০২১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি! ভুল তারিখে ছাপানো এসব ট্রান্সক্রিপ্টে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথ স্বাক্ষরও করেছেন। এর মধ্যে বেশ কিছু ট্রান্সক্রিপ্ট শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণও করা হয়। পরবর্তীতে বিষয়টি বোর্ড কর্মকর্তাদের নজরে আসে। এ ঘটনায় বোর্ডের বিপুল অর্থ গচ্চা গেছে বলে জানিয়েছে শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষ। এ নিয়েও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাছে ব্যাখ্যা চায় শিক্ষা বোর্ড। এর আগেও ২০২০ সালের অটোপাশের জেএসসিতে বড় ধরনের অনিয়মের খবর প্রকাশিত হয় দৈনিক আজাদীতে। ফল প্রকাশের ৯ মাস পর নতুন করে রেজিস্ট্রেশন ও রোল নম্বর জেনারেট করে ৩৪ জন শিক্ষার্থীকে জেএসসি পাসের তালিকায় যুক্ত করা হয়। বোর্ডের পরীক্ষা শাখা ও বিদ্যালয় শাখার সরাসরি সম্পৃক্ততায় ওই অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে। আর এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়নের ক্ষেত্রেও জটিলতা দেখা দেয়। সন্তান পরীক্ষার্থী এমন ১০/১২ জন শিক্ষককে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও মডারেশনের (পরিশোধন) দায়িত্ব দেয় শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা শাখা। পরবর্তীতে বিষয়টি জানাজানি হলে এসব প্রশ্ন বাতিল করে নতুন করে প্রশ্ন প্রণয়ন করা হয়। সংশ্ল্লিষ্টরা বলছেন, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও পরিশোধনের দায়িত্ব দেয়ার আগে কোনো শিক্ষকের সন্তান পরীক্ষার্থী কী না, সেটি যাচাই-বাছাই করার দায়িত্ব পরীক্ষা শাখার। কিন্তু দায়িত্ব প্রদানের আগে যাচাই-বাছাই না করেই ওই সব শিক্ষকদের দায়িত্ব দেয়া হয়। সবমিলিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে পরীক্ষা পরিচালনা, ফলাফল তৈরি ও প্রকাশ সংক্রান্ত বিষয়ে শিক্ষাবোর্ডের কার্যক্রমে মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। এর ফলে বোর্ডের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে মনে করছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। সচিব প্রফেসর আবদুল আলীমসহ শিক্ষাবোর্ডের একাধিক কর্মকর্তা এটি স্বীকার করছেন। তবে এত ঘটনার পরও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ণ চন্দ্র নাথের বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যা রহস্যজনক মনে করছেন কেউ কেউ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহাই কোর্টে শুনানি শুরু ১৮ অক্টোবর
পরবর্তী নিবন্ধদেড় বছর পর কমিটিতে ৯ যুগ্ম আহ্বায়ক