পত্রিকায় একটি চিঠি পাঠিয়েছেন কানন বালা দেবী নামের এক অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক। তাঁর বাড়ি নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার শাহবাজপুর গ্রামে। চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রামের বাড়ি থেকে জেলা শহরে স্থায়ীভাবে চলে গেলে আবদুল মজিদ খান নামের এক লোক তাঁদের বাড়িতে ঘর নির্মাণ করেন। খবর পেয়ে তিনি গ্রামে গিয়ে এর কারণ জানতে চাইলে মজিদ বলেন, ‘আপনারা তো কম আসেন, লোকজন পুকুরের মাছ ও গাছের ফল নিয়ে যায়। আমি পাহারা দেব। আপনার বাড়ি তো আপনারই থাকবে।’
কিন্তু সে বাড়ি আর কানন বালার থাকেনি। এরপর মজিদ খান এক প্রতিবেশীর ৪০ শতাংশ জমি কিনে তার সঙ্গে কানন বালার বসতবাড়ির পুরোটাই দখল করে নেন।
প্রতিকার চেয়ে কানন বালা জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের শরণাপন্ন হন। আবেদন জানান প্রধানমন্ত্রীর কাছেও। এই প্রেক্ষাপটে নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক বিষয়টি তদন্ত করতে বলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মোরশেদা খাতুনকে। তিনি ১৫ জুলাই ঘটনাস্থলে যান এবং দুই পক্ষকে কাগজপত্র নিয়ে তাঁর অফিসে আসতে বলেন। ১৯ জুলাই কানন বালা তাঁর বাড়ির দলিলপত্র দাখিল করেন। কিন্তু মজিদ খান সেখানে যাননি এবং কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। বাড়িটি এখনো মজিদ খান দখল করে আছেন। কানন বালার শেষ আকুতি: ‘আমার বয়স ৬৭ বছর। জীবনের বাকি দিনগুলো গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কাটাতে চাই।’
এমন ঘটনা হরহামেশা ঘটছে দেশে। কানন বালারা শেষ পর্যন্ত লড়াই করেও অনেক সময় মজিদ খানদের হাত থেকে নিজের স্বামী বা বাপ-দাদার সম্পত্তি রক্ষা করতে পারেন না। সমাজে মজিদ খানের সংখ্যা বেশি। তাদের সবার শ্যেন দৃষ্টি সর্বদা সংখ্যালঘুদের জমিজমার ওপর ।
আগে উপেনদের জমি কেড়ে নেয়ার আগে বাবুরা অন্তত ভদ্রতা করে বলতো “এ জমি লইব কিনে”। এখন সামন্ত প্রভুরা নেই, সময় বদলেছে। পুঁজিবাদী ও লুটেরা অর্থনৈতিক সমাজব্যবস্থায় বাবুদের চেহারা ও অবস্থান বদলে আরও চাকচিক্যময় ও সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে। বাবুদের এখন কোনো জাত-পাত-ধর্ম-বর্ণ- দেশ-কাল নেই তারা এখন সর্বব্যাপী, সর্বগ্রাসী ও সর্বভুক। এরা নিজ মাতৃভূমির পাহাড়-সাগর-নদী-খাল-পুকুর-জলাশয়-নালা-কবরস্থান-দেবোত্তর সম্পত্তি যা প্রায় গ্রাস করে নেয়। এরা অপ্রতিরোধ্য, স্বয়ং সরকার পর্যন্ত এদের ঘাঁটাতে ভয় পায় আর মিডিয়াগুলোর অধিকাংশ এদের বিজ্ঞাপনের টাকায় চলে বলে এদের লুটপাট ও সাগরচুরি নিয়ে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করে না। তাই এরা আর সামান্য ভদ্রতাটুকুও করে না। উপেনদের শেষ পর্যন্ত জমি দিতেই হতো এবং বাড়াবাড়ি করলে তাকে গ্রামছাড়া করা হতো চোর আখ্যা দিয়ে। এখন আখ্যা দেয়া হচ্ছে শত্রু, বাবুর ভূমিকায় স্বয়ং রাষ্ট্র আর ভিকটিমরা নিরীহ উপেন নয়, দেশ ও জাতির বরেণ্য সন্তানরাও। তাদের একমাত্র অপরাধ তারা সংখ্যালঘু, সোজা কথায় হিন্দু। হিন্দুস্থান শত্রুরাষ্ট্র, ওপথে যারা চলে যায় তারা শত্রু। দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্যে প্রাণ বিসর্জন দিলেও শত্রু।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়েছিলো দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে। দীর্ঘদিন ধরে যারা এক ও অভিন্ন শত্রু ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম করেছিলেন দু’টি আলাদা রাষ্ট্র হওয়ার পর তারাই পরস্পরের শত্রুতে পরিণত হলেন। এ ধরনের নীতিতে ভারত বিভক্তির বিরোধিতাও করেছিলেন অনেকে কিন্তু জিন্নাহ-নেহেরুর দ্রুত ক্ষমতালাভের তীব্র আকাঙ্ক্ষার কাছে সেদিন ম্লান হয়ে গিয়েছিলো অন্যদের মানবতাবাদী আবেদনও। সেই ভারত বিভক্তির নির্দয় ও নির্মম মূল্য পরিশোধ করতে হয়েছিলো সবচেয়ে বেশি বাংলা ও পাঞ্জাবকে। সেই ক্ষত এখনো শুকায়নি। দু’পাঞ্জাব ও দু’বাংলার ঘরে ঘরে এখনো কান পাতলে শুনতে পাওয়া যাবে বাপদাদার ভিটে ছাড়া মানুষের আহাজারি আর করুণ আর্তনাদ। এই আর্তনাদকে আরো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করেছে ’৬৫ সালে সংঘটিত পাক-ভারত যুদ্ধ। যার ফলে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার একটি আইন পাশ করে যার দ্বারা এই আইনের গ্যাঁরাকলে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে অনেক সংখ্যালঘু পরিবার।
সকল মানবতাবোধ আর সভ্যতাকে কালিমালিপ্ত করে ১৯৬৫ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার প্রণয়ন করে, “দ্য ডিফেন্স অব পাকিস্তান অর্ডিন্যান্স ১৯৬৫” যার মাধ্যমে প্রণীত হয়েছিলো “শত্রু সম্পত্তি আইন”। সে বছর পাক-ভারত যুদ্ধ হয়েছিলো, যে কারণে পাকিস্তান ভারতকে শত্রু দেশ আখ্যায়িত করে এবং ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে যারা ভারত চলে গিয়েছিলেন তাদের সব সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। আজ দীর্ঘ বছর ধরে এই অস্ত্র ব্যবহার করে লক্ষ লক্ষ সংখ্যালঘু তথা হিন্দু পরিবারের সর্বনাশ করা হয়েছে, পথে নামিয়ে দেয়া হয়েছে, অমানবিক ও বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে। কিন্তু এটাতো চলার কথা ছিল না। ১৯৭৪ সালে এই আইনটি বাতিল করে একে অর্পিত সম্পত্তি ও অনাবাসিক সম্পত্তি আইন হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। ১৯৭৬ সাল জিয়ার আমল থেকে পুনরায় এই আইনের ব্যবহার শুরু হয়।
১৯৭১ সাল, বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথম স্ব-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। যে বাঙালির দীর্ঘ ইতিহাসে কখনো স্বাধীন জাতির অস্তিত্ব নেই, তাই সম্ভব হয়েছিলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যোগ্য ও দূরদর্শী নেতৃত্বের গুণে। সংঘটিত হয়েছিলো সবচেয়ে গৌরবের, সবচেয়ে মহান, মুক্তিযুদ্ধ। যে যুদ্ধ ছিলো সমগ্র বাঙালি জাতির, হিন্দু-মুসলিম- বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নির্বিশেষে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের। সেই একাত্তর সালে সংঘটিত নয় মাসের যুদ্ধে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলো কারা? সংখ্যালঘুরা, নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে হিন্দুরা। সে সময় এমন একটি হিন্দু পরিবার পাওয়া যাবে না যারা কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি? জান-মাল- ইজ্জত কিছু না কিছু বিসর্জন দিতে হয়নি? এখন কেউ যদি প্রশ্ন করেন মুসলিম পরিবারে? আমি বলবো না, বরং অনেক মুসলিম পরিবারের ভাগ্য বদলে দিয়েছিলো ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ। শুরুতে হিন্দুদের সম্পত্তি লুট করে আর স্বাধীনতার পরে পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি দখল করে। মামা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান থাকলে ভাগিনা মুক্তিযোদ্ধা। বিজয়ের আগে পরে পরস্পরকে বাঁচিয়ে রাখার কাহিনীও অনেকে জানে। সেই মামাদের প্রেতাত্মারাই দীর্ঘ দীর্ঘ বছর ধরে ওই কালো আইন ঝুলিয়ে রেখে হিন্দুদের সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়ার অপকৌশল টিকিয়ে রেখেছে। যদিও ওই আইন বাতিল করেছিলেন বঙ্গবন্ধু । বর্তমান সরকার হিন্দুদের সম্পত্তি ফিরে পাওয়ার ব্যবস্থা করলেও সরকারের ভেতর লুকিয়ে থাকা পাকিস্তানি প্রেত্মারা বিষয়টিকে জটিল জটিলতর করে রেখেছে। এক্ষেত্রে- সরকারের দোদুল্যমানতা আমাদের হতাশ ও বিক্ষুব্ধ করে। হিন্দুদের দেশত্যাগের মতো পরিস্থিতি তৈরি করে (১৯৯০ ও ২০০১ সালে) তাদের সম্পত্তি দখলের কুশীলবদের কি আওয়ামী লীগ চিহ্নিত করতে পারে না বা আওয়ামী লীগ কি বুঝতে পারে না এদেশ থেকে হিন্দুরা চলে গেলে ক্ষতি কার? এদেশ সংখ্যালঘু শূন্য হলে রাজনীতিতে কারা লাভবান হবে?
২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনের পরে সারাদেশে যে সংখ্যালঘু নির্যাতন শুরু হয়েছিলো তা কি শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কিংবা হিন্দুরা সব সময় আওয়ামী লীগকে ভোট দেয় বলে এক ধরনের রাজনৈতিক দাঙ্গা? মোটেও তা নয়। ’৭৫ এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে যারা বা যে শক্তি বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছে, যারা এ দেশকে আফগানিস্তান বা চরম একটি মৌলবাদী ও ধর্মান্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছে তাদেরই সুদূরপ্রসারী নীল নকশার অংশ এটি। বাংলাদেশকে যদি একধর্মের রাষ্ট্রে পরিণত করা যায় তাহলে পাকিস্তান-আফগানিস্তান, ইরান-লিবিয়ার মতো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়া সম্ভব। যার প্রধান অন্তরায় বাঙালি জাতীয়তাবাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনা। যে জন্যে এই জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো বারবার আক্রমণ করে আমাদের পহেলা বৈশাখ, নববর্ষ উৎসব, একুশে ফেব্রুয়ারি বা সুফীবাদী দর্শন ভিত্তিক অনুষ্ঠান ও উৎসবকে।
এই করোনাকালেও স্বস্তি পাওয়ার মতো কোনো খবর নেই। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ ৭ অক্টোবর সন্ত্রাস-সহিংসতার যেসব তথ্য দিয়েছে, তা দেখে উদ্বেগ না জানিয়ে পারা যায় না। পরিষদের হিসাব অনুযায়ী, গত সাত মাসে (মার্চ-সেপ্টেম্বর) সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের ১৭ জন হত্যার শিকার হয়েছেন, ১০ জনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। এ সময় ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হন ৩০ জন সংখ্যালঘু নারী।
লিখতে বসেছিলাম কানন বালা দেবীকে নিয়ে। এই নারী আক্ষেপ করে বলেছেন, জীবনের শেষ সময়টুকু তিনি গ্রামে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে কাটাতে চান। কিন্তু যে যাই বলুক, তিনি সংখ্যালঘু বলেই এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে। আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছিলাম যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রামে সকল ধর্মের মানুষ অংশ নিয়েছিলো সে রাষ্ট্রে সকল ধর্মের মানুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক