‘মানুষ’ আছে মানুষে ‘মানবিকতা’ খুঁজি মানুষে

সফিক চৌধুরী | বৃহস্পতিবার , ১৫ অক্টোবর, ২০২০ at ৫:২০ পূর্বাহ্ণ

সিলেট এমসি (মুরারিচাঁদ) কলেজ ছাত্রাবাসে ঘটে যাওয়া সংঘবদ্ধ ধর্ষণ এবং তার রেশ কাটতে না কাটতেই নোয়াখালির বেগমগঞ্জে ন্যক্কারজনকভাবে গৃহবধূকে নির্যাতন করে ভিডিও ধারণ এবং তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া সহ দেশের নানা প্রান্তে বেড়ে যাওয়া সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, কিশোর অপরাধসহ এমন নানা অপরাধ প্রবণতায় একজন নাগরিক হিসেবে আমরা ভীষণভাবে লজ্জিত। এসব ঘটনা যখন শুনি তখন নিজেকে ‘মানুষ’ হিসেবে ভাবতে গ্লানিবোধ করি। এ জাতীয় অমানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় নিয়ে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে গভীরভাবে চিন্তা করার সময় এসেছে –আমাদের সমাজের চারিদিকে হচ্ছেটা কি? এভাবে কোথায় চলেছি আমরা? কেন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের যেদিকে তাকাই সেদিকেই শূন্যতা, নীতিহীন আদর্শ আর কদর্য চরিত্রহীনতার দৃষ্টান্ত? সামাজিক অবক্ষয়, নারী ও শিশু নির্যাতন, গুজব, বিচার বহির্ভূত হত্যা আজ যেন আমাদের সমাজের নিষ্ঠুর নিয়তি! সবচেয়ে উদ্বেগজনক ব্যাপার, নারী নির্যাতন আজ নারী ছাড়িয়ে শিশু পর্যন্ত বিস্তৃত!
কিশোর গ্যাং নামধারী কিছু কিশোরের প্রকাশ্যে ঘটানো হত্যাকাণ্ড, মারামারি-জখম, নারী ও শিশু নির্যাতন সহ এ জাতীয় বিভিন্ন ঘটনায় দেখা যায়, যথাযথ প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও প্রশাসন শুরুতে অনেক ক্ষেত্রেই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনা, সাময়িক কিছু আটক হয় বটে, কিন্তু তা ঐ সাময়িক আটক পর্যন্তই, পরবর্তীতে তার আর কোন খোঁজ থাকে না, বিচারতো আরও দূর! অন্যদিকে নাগরিক হিসেবে আমরাও থাকি নিশ্চল, নিশ্চুপ!
প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, কিশোর অপরাধ ও নারী-শিশু নির্যাতনের বিভিন্ন ন্যক্কারজনক ঘটনা পরবর্তীতে কিছু ক্ষেত্রে কাউকে কাউকে বলতে শোনা যায়, যেভাবে ঘটনার ব্যাপকতা প্রকাশ করা হয়েছে, আসলে ঘটনা এত বড় নয়! তাহলে প্রশ্ন, কি হলে আমরা ধরে নেব, ঘটনার ব্যাপকতা অনেক বেশি? আমরা হয়তো ফিরিয়ে দিতে পারবো না, সারা দেশে ঘটে যাওয়া সব নির্যাতিত ও তাদের পরিবারের মুখে হাসি, লাঞ্ছিত নারী ও শিশুর জীবনে উচ্ছলতা। কিন্তু, আমরা যদি এইসব ঘটনায় দায়ী কাপুরুষ হায়েনাদের কঠোর বিচার নিশ্চিত করতে না পারি, তবে সেই সব হায়েনাদের অট্টহাসিতে হারিয়ে যাবে, সব মানুষের হাসি আর সাধারণ বাঙালি নারীর উচ্ছলতা। দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংঘটিত নানা ন্যক্কারজনক ঘটনাগুলো ক্রমান্বয়ে ঘটতে থাকলেও আমরা নিজেরা যার যার অবস্থান থেকে প্রতিবাদী না হয়ে বাংলা ছবির নির্যাতিতদের মতো তাকিয়ে থাকি অন্যের দিকে আর ভাবনায় থাকি কেন কেউ প্রতিবাদী হচ্ছেনা? কিন্তু, আমরা নিজেরা মধ্যবিত্ত মানসিকতা নিয়ে চুপটি করে ঘরে বসে থাকি, নিজেকে নিজেই ধন্যবাদ দেই, যাক আমার পরিবারেরতো কারও কিছু হয়নি! কিন্তু, যেদিন নিজেই আক্রান্ত হই, সেদিন ক্ষোভে ফেটে পড়ি, আমার পাশে কেউ নেই কেন!
নারী ও শিশু নির্যাতনের বিভিন্ন ঘটনা পরবর্তীতে মাঝে মাঝে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যের প্রথম দিকের ভূমিকায় আমরা নির্বাক হই (যদিও অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা আমাদের আশাবাদীও করে), কিন্তু অবাক হই না! কারণ, আমাদের অন্য অনেক সাধারণ নাগরিকের মতোই প্রায় অধিকাংশ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যেও সংবেদনশীলতা, বোধ ও মানবিকতার অভাব প্রকট। যা আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থারই ফল। সমাজে মানবিক সংস্কৃতির বাতাবরণ তৈরি হয় যথার্থ শিক্ষার মাধ্যমে। কিন্তু, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার আধার সংস্কৃতির উপস্থিতি নেই বললেই চলে। আমাদের ভাবতে হবে, আমাদের শিক্ষায় গলদটা কোথায়? আমরা কেন, নারীকে ‘মানুষ’ হিসেবে সম্মান দিতে পারছি না? আমাদের মধ্যে কেন স্নেহ, মায়া-মমতা, সংবেদনশীলতা, বোধ আর মানবিকতার অভাব?
অনেক ক্ষেত্রেই এইসব বিভিন্ন ঘটনায় অপরাধীদের তাৎক্ষণিক আটক করা গেলেও পূর্বের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, কিছু দিন পরে তারা (অপরাধী) আদালত থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে এসে ভুক্তভোগী ও তার পরিবারকে হুমকি প্রদান ও হয়রানি করছে। প্রশ্ন এসে যায়, অপরাধীরা এতসব ঘৃণ্য অপরাধ করেও এত দ্রুত আদালত থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে আসে কিভাবে? এর সোজা উত্তর হচ্ছে, মামলা ঠিকভাবে সাজানো হয় না, সাক্ষীর অভাব, সাক্ষী ও অভিযোগকারীর নিরাপত্তার অভাব, আইনের বিভিন্ন অসঙ্গতি ইত্যাদি। অর্থাৎ সুশাসনের অভাব। দেশে সুশাসন, সু-শিক্ষা আর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা গেলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে থাকতে বাধ্য।
আমাদের ভাবতে হবে, কেন আমাদের মূল্যবোধের সংকট, আদর্শের অনটন, সৃজনশীলতা আর সংবেদনশীলতার অভাব? কেন আমরা প্রকৃত ‘মানুষ’ হতে পারছি না? আমার মনে হয়, আমরা আমাদের স্কুলের শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রাণী সম্পর্কে যতটা রচনা শেখাই, তাতে তারা সব প্রাণীর আকৃতি, প্রকৃতি ও আচরণ সম্পর্কে হয়তো জানে, কিন্তু, ‘মানুষ’ আর ‘মানবিকতা’ তাঁদের কাছে অজানাই রয়ে যায়। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? আমাদের অনুভূতিগুলো কি এতই ভোঁতা যে, আমরা নিশ্চল, নিশ্চুপ হয়ে থাকবো?
শহীদ শহীদুল্লাহ কায়সার তাঁর স্বাধীন দেশ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, “বেচারা ক্ষুদিরাম, বেচারা আশফাকুল্লাহ, বেচারা সূর্য সেন স্বাধীনতার জন্য তোমরা ফাঁসি গেছিলে। কোন রকমে পরপার থেকে এদেশে বেড়াতে এসে স্বাধীন দেশের এই চেহারাটা দেখলে তোমরা কি করতে? আত্মাহুতির বদলে আত্মহত্যা করতে?” -এ কথা এত বছর পর আজও কেন যেন সত্য বলে মনে হয়।
লেখক : বিতার্কিক ও কলাম লেখক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআবুল হুসেন : মুক্ত চিন্তার পথিকৃৎ
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজ কাল