কাল আজকাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ১৮ নভেম্বর, ২০২১ at ৫:৫৪ পূর্বাহ্ণ

দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচন
নিজের পায়ে কুড়াল মারছে আওয়ামী লীগ
স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান/মেম্বার নির্বাচন নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের আগ্রহ ও উৎসব-আনন্দের শেষ নেই। এই নির্বাচন প্রান্তিক মানুষের নিরানন্দ ও নিরুত্তাপ জীবনকে উত্তেজনায় ভরপুর করে দেয়। এই উপমহাদেশের সংস্কৃতির অংশই হয়ে উঠেছে এমন নির্বাচন। এখনো গ্রামীণ সমাজে মেম্বার/চেয়ারম্যানদের প্রভাব অপরিসীম। কাজেই জনগণ তাদের সবচেয়ে কাছের এই জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচন নিয়ে গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে।
ফলে এই নির্বাচন নিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামারও কমতি থাকে না। প্রতিবার নির্বাচনে খুন-খারাবির ঘটনা ঘটে থাকে। শুরু থেকে এই নির্বাচন নির্দলীয়ভাবেই হয়েছে যদিও প্রচ্ছন্নভাবে দলীয় রাজনীতির প্রভাব সবসময়ই ছিল।
হঠাৎ বলা নেই, কওয়া নেই, কারো কোনো দাবি নেই, এমনকি প্রয়োজনই নেই আওয়ামী লীগ সরকার গত টার্ম থেকে ইউপি নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া শুরু করে। এতে দলীয়ভাবে আওয়ামী লীগের কী লাভ হয়েছে জানি না তবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রান্তিক এই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভোটাধিকার। আওয়ামী লীগ যেহেতু ক্ষমতায় আছে অপ্রতিদ্বন্ধিভাবে সেহেতু আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া মানে নিশ্চিত জয়লাভ করা। এতে দলের মনোনয়ন পেতে মরিয়া হয়ে উঠছে একদল । এর সুযোগ নিয়ে মনোনয়ন বাণিজ্য করে টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছে কিছু কিছু নেতা । অন্যদিকে দলের নিবেদিত ও ভালো প্রার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছে। এই বঞ্চনা নিয়ে কেউ কেউ দল থেকে দূর সরে যাচ্ছে আর অধিকাংশই বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দলের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. শান্তনু মজুমদার এই পরিস্থিতিকে ‘শিওর শটের’ দ্বন্দ্ব হিসেবে দেখছেন। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘এখন ক্ষমতাসীন দল থেকে মনোনয়ন পাওয়া মানে শিওর শট। তাই প্রার্থীরা প্রথম মরিয়া হয়ে ওঠেন ক্ষমতাসীন দল থেকে মনোনয়ন পেতে। একই দলের যারা মনোনয়ন পান না তারা বিদ্রোহী প্রার্থী হন। দুই পক্ষই তখন সব ধরনের শক্তি প্রয়োগ করে জেতার জন্য বা প্রতিপক্ষকে হারানোর জন্য। ফলে আগে যে আন্তঃদলীয় সংঘাত হতো সেটা এখন অন্তঃদলীয় সংঘাতে রূপান্তরিত হয়েছে।’
এ বাস্তবতায় এখন সারাদেশে। বিরোধীদলবিহীন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী এখন আওয়ামী লীগ। ফলে খুনোখুনিও করছে তারা নিজেদের মধ্যে।
সদ্য হয়ে যাওয়া ৮৩৫টি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচনী সহিংসতায় মৃত্যু হয়েছে সাত জনের। এর মধ্যে নরসিংদীতে তিনজন, কুমিল্লায় দুইজন, কঙবাজার ও চট্টগ্রামে একজন করে মারা গেছেন। এর আগে ২১ জুন ও ২০ সেপ্টেম্বর প্রথম দফার ভোটে মারা যান ছয়জন। এরপর থেকে ভোটের মাঠের প্রচারণায় বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে আরও ২৪ জনের। সবমিলিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। দলটির একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এখন ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বরাদ্দ দিতে গিয়ে দলের তৃণমূলে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। মনোনয়নবঞ্চিতরা অনেকেই দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে স্বতন্ত্র প্রার্থী (বিদ্রোহী) হিসেবে নির্বাচন করছেন। দীর্ঘদিন ধরে দলে সক্রিয় আছেন এমন অনেক নেতাও নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলীয় নেতাকর্মীরা মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছেন। অনেক জায়গায় প্রাণঘাতী সংঘর্ষও হচ্ছে। এসব সামাল দিতে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা হিমশিম খাচ্ছেন। মনোনয়নবঞ্চিতরা সংসদ সদস্যদের প্রতি ক্ষুব্ধ হচ্ছেন। এ বিরোধ আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে-এমন আশঙ্কা রয়েছে। ফলে অনেক সংসদ সদস্যই চাচ্ছেন না ইউপি নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হোক। এরই মধ্যে অনেক সংসদ সদস্য মুখ খুলতে শুরু করেছেন। তারা এই সিদ্বান্ত প্রত্যাহারেরও দাবি জানাচ্ছেন। ইতিমধ্যে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুরসহ অন্তত পাঁচ জেলার ১২ থেকে ১৫ জন সংসদ সদস্য দলের প্রধান ও স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোডের্র সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে আবেদন করেছেন। তাঁদের যুক্তি, এসব জেলায় ইউপি নির্বাচনে যে-ই প্রার্থী হোক না কেন আওয়ামী লীগই জিতবে। এ ছাড়া আবেদন না করলেও আওয়ামী লীগের আরো অন্তত দুই ডজন সংসদ সদস্য তাঁদের এলাকায় চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীক চান না। এ ব্যাপারে তাঁরা দলের মনোনয়ন বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। (বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে সংগৃহীত তথ্য)।
দলীয় মনোনয়নে নির্বাচন করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের কতটা অর্জন হলো তা দলের নীতিনির্ধারকরাই ভালো বলতে পারবেন তবে সদ্য হয়ে যাওয়া নির্বাচনের কয়েকটা চিত্র পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করছি যাতে একটি ধারণা পাঠকরা পেতে পারেন। খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার রঘুনাথপুর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মনোজিৎ বালা ৬ হাজার ৬০৩ ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী একই দলের আরেক বিদ্রোহী এএম আমিনুর রহমান। তিনি পেয়েছেন ৪ হাজার ৬২২ ভোট। এ দুই বিদ্রোহী প্রার্থীর দাপটে কোণঠাসা আওয়ামী লীগের প্রার্থী খান সাকুর উদ্দীন ভোট পেয়েছেন মাত্র ১ হাজার ৫৯১। ২১ হাজার ৬১৪ ভোটারের এই ইউপি নির্বাচনে ভোট পড়েছে ১৭ হাজার ৫১১টি। অর্থাৎ ৮১ দশমিক ০২ শতাংশ। এ হিসাবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তার জামানতের টাকাও রক্ষা করতে পারেননি। একই ধরনের ফল দেখা যায় পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বুড়াবুড়ি ইউপি নির্বাচনে। এখানে ৩ হাজার ৩১৫ ভোট পেয়ে দ্বিতীয়বারের মতো চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মো. তারেক হোসেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের আরেক বিদ্রোহী কামারুজ্জামান কামু ভোট পেয়েছেন ২ হাজার ৮৬৬টি। আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. শেখ কামাল এতই কম ভোট পেয়েছেন যে, তিনিও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসতে পারেননি। এমনকি জামানতও রক্ষা করার মতো ভোটও পাননি। শুধু জামিরা বা বুড়াবুড়ি নয়, এমন ১৩৮টি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে প্রতিযোগিতায় আসতে পারেননি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। এসব প্রার্থী এতই কম ভোট পেয়েছেন যে তারা দ্বিতীয় অবস্থানও অর্জন করতে পারেননি। ১৩৮টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে দুটিতে জাতীয় পার্টি ও বাকি ১৩৬টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ভোট পাওয়ার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বেশিরভাগই শাসক দলের মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। মাঠপর্যায়ের দলটির কয়েক নেতার অভিযোগ, যোগ্য ও জনপ্রিয় প্রার্থীকে মনোনয়ন না দেওয়া এবং বিদ্রোহী প্রার্থীদের দাপটের কারণে সরকারদলীয় প্রার্থীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। এ কারণে তারা জয়ী প্রার্থীর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ও আসতে পারেননি।
এটি দলের জন্য কতটা মঙ্গলজনক হয়েছে সে প্রশ্ন তোলার সময় হয়েছে এখন। কারণ একটি কথা মনে রাখা দরকার ‘যারা নিজেদের মধ্যে খুনখারাবি করে তারা একদিন বিলীন হয়ে যায়’ এটা ইতিহাসের শিক্ষা। আওয়ামী লীগ নিজেদের মধ্যে মারামারি করে নিজেরাই নিঃশেষ হয়ে পড়বে তার জন্য কোনো বিরোধীদলের প্রয়োজন হবে না। শুধু ইউপি নির্বাচন নয়, দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে প্রায় সবখানে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী আজ আওয়ামী লীগ। ছাত্রলীগের প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রলীগ। এরা নিজেদের মধ্যেই মারামারি করছে, নিজেদের কর্মী-সমর্থকদের নিজেরাই হত্যা করছে। স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনগুলো আগের মতো খোলাখুলিভাবে হলে তাতে জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধি নির্বাচনে সুবিধা হতো। আমি জানি না ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার লক্ষ্যে দলীয়ভাবে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে কি না। যদি তেমন হয়ে থাকে আমি মনে করি তার প্রয়োজন ছিল না। কারণ, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের স্বাধীনভাবে বড় কিছু করার থাকে না। তারা স্থানীয় এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ডিসি-ইউএনওদের মতের বাইরে যেতে পারে না। কাজেই নির্বাচনে অন্য দল থেকে জিতে আসলেও সরকারের সিদ্ধান্তের বাইরে অবস্থান নেওয়া চেয়ারম্যান/মেম্বারদের পক্ষে সম্ভব নয়।একটি দলে উপদল থাকতে পারে। দ্বিমতও থাকতে পারে। নিজেদের সভায় একে অন্যকে যুক্তিতর্ক দিয়ে ঘায়েলও করতে পারে এমনকি চেয়ার ছোঁড়াছুঁড়ির মতো ঘটনাও ঘটতে পারে কিন্তু নিজেদের লোককে নিজেরা সশস্ত্রভাবে আক্রমণ করে কীভাবে? বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মেধাবী শিক্ষার্থীরা কীভাবে একই আদর্শের, একই দলের কর্মীকে হত্যার উদ্দেশে আক্রমণ করতে পারে?
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে আওয়ামী লীগ যদি নিজেদের ঘর সামলানোর ব্যবস্থা না নেয় তাহলে একদিন হয়তো খুব বেশি দাম দিতে হতে পারে।
লেখক : কবি সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধমনের মতো আয়না
পরবর্তী নিবন্ধড. মইনুল ইসলামের কলাম