কালজয়ী নাটকের সচ্ছন্দ অনুবাদ এবং চৌকস নির্দেশনা

গণায়নের-জুলিয়াস সিজার

শৈবাল চৌধূরী | সোমবার , ১৮ মার্চ, ২০২৪ at ৫:৩৪ পূর্বাহ্ণ

বিশ্ব নাটকে বেশ কয়েকটি কিংবদন্তি নাট্যকৃতি রয়েছে, যে কালজয়ী নাট্যসৃষ্টিগুলি প্রয়োগ ও উপস্থাপনার অভিনবত্বে যুগের পর যুগ দর্শক হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে এসেছে। এই নাটকগুলি প্রাসঙ্গিকতা ও অন্তর্নিহিত বক্তব্যের গুণে শতকের পর শতক জুড়ে যুগপৎভাবে ধ্রুপদিয়ানা ও সমকালীনতার মর্যাদা অর্জনে সমর্থ হয়েছে এবং শাশ্বতরূপ অর্জন করেছে। তেমনই একটি অসাধারণ নাট্য প্রযোজনা দেখার সৌভাগ্য হলো ২৯ ফেব্রুয়ারি লিপ ইয়ার সন্ধ্যায় গ্রুপ থিয়েটার উৎসবে চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি মঞ্চে। চট্টগ্রামের প্রতিনিধিত্বশীল নাট্যদল গণায়নের প্রযোজনায় জুলিয়াস সিজার। উইলিয়াম শেক্সপিয়রের কালজয়ী এই নাটকের চমৎকার অনুবাদ করেছেন গণায়ন নাট্য সম্প্রদায়ের দলপতি বিশিষ্ট নাট্যজন অধ্যাপক ম. সাইফুল আলম চৌধুরী। তিনি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র ও শিক্ষক। গত এক দশক ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত রয়েছেন। শেক্সপিয়রের নাটকটি তিনি বাংলায় অনুবাদ করেছেন নাটকের সংলাপ আঙ্গিক, বর্ণনা শৈলি অক্ষুন্ন। শেক্সপিয়রের সব নাটকের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য সাধারণ সংলাপ।

. সাইফুল আলম চৌধুরী সে বৈশিষ্ট্য ও ভাবকে অক্ষুন্ন রাখতে পেরেছেন তার স্বাদু অনুবাদে। বাংলা গদ্যের ধ্রুপদি ও আধুনিক রীতির মধ্যবর্তী এক স্বচ্ছন্দ আঙ্গিকে তিনি শেক্সপিয়রের সংলাপগুলির সাবলীল অনুবাদ করেছেন যা নাটকটিকে গতিশীল করে তুলেছে।

অনুবাদকের পরিশ্রম ও মেধাকে একইভাবে মূর্ত করে তুলেছেন নির্দেশক অধ্যাপক অসীম দাশ। দিল্লির এনএসডি স্নাতক অসীম প্রায় দেড় দশক ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে শিক্ষকতায় নিয়োজিত। বর্তমানে তিনি সহযোগী অধ্যাপক। ইতোপূর্বে আমরা অসীমের নির্দেশনায় অনেকগুলি সফল নাটকের মঞ্চায়ন দেখার সুযোগ পেয়েছি। তার নির্দেশনার স্বকীয় কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে যেসবের গুণে নির্দেশিত নাটকটি রীতিমতো উপভোগ্য হয়ে ওঠে। অসীম নির্দেশিত সাম্প্রতিক স্মরণীয় নাট্য মঞ্চায়ন মনোজ মিত্রের কিনু কাহারের থেটার, যেটি ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের প্রযোজনা। অন্যটি ওয়াজদি মাওয়াদ রচিত খোঁজা (ফেইম প্রযোজনা)। জুলিয়াস সিজারের চৌকষ নির্দেশনা অসীমের নাট্য নির্দেশনার আরেকটি উজ্জ্বল পরিচয়।

নাটকটি সম্পর্কে অনুবাদক ও নির্দেশকের বক্তব্য এই আলোচনার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। অনুবাদক ম. সাইফুল আলম চৌধুরী বলেছেন, “উইলিয়াম শেক্সপিয়ার ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটকের কাহিনিটি গ্রহণ করেছেন টমার্স নর্থ কর্তৃক অনুদিত পুতার্কের ‘‘প্যারালাল লাইভস অব দি নোবল গ্রিকস এন্ড রোমানস”এ অন্তর্ভুক্ত সিজার ও ব্রুটাসের জীবনী থেকে। এ নাটকের পূর্ণ শিরোনাম ‘‘দ্য ট্র্যাজেডি অব জুলিয়াস সিজার।’’ নাটকটি ১৫৯৯ সালে প্রথম মঞ্চস্থ হয়।

জুলিয়াস সিজার নাটকটি ইতিহাসের বেশকিছু গুপ্ত হত্যার কথা আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এই গুপ্ত হত্যার তালিকায় রয়েছেন আব্রাহাম লিংকন, জন এফ কেনেডি, সালভেদর আলেন্দে, মহাত্মা গান্ধী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে উপর্যুক্ত গুপ্তহত্যাগুলো জনগণের জন্য কোনো কল্যাণ বয়ে আনেনি। বরং সেসব জাতিকে পশ্চাৎপাদ করে ফেলেছিলো। অতএব জুলিয়াস সিজার নাটক থেকে আমরা এই বার্তা পাই যে, জনগণের গণতন্ত্রকে পরিহার করে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে বা গুপ্তহত্যার মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা কখনোই ফলপ্রসূ হয় না। অগণতান্ত্রিকতা, অনিয়মতান্ত্রিকতা কখনো জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে না।

সেদিন সন্ধ্যায় নাটকটি দেখার সময় ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সেই নারকীয় হত্যাকান্ডের কথা বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল। মনে পড়ছিল তৎপরবর্তী অরাজকতার কথা। বোধ হচ্ছিল ৪২৫ বছর আগের এনাটক এখনও সমান প্রাসঙ্গিক।

নির্দেশক অসীম দাশ বলেন, “শেক্সপিয়রের নাটক একজন পরিচালক, এমনকি একজন ডিজাইনারের জন্যও একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ। আর নাটক যখন ‘জুলিয়াস সিজার’ তখন এই চ্যালেঞ্জটা একটু বেশিই তীব্র হয়ে ওঠে। আমার ক্ষেত্রেও তার অন্যথা ঘটেনি। তথাকথিত অবকাঠামোগত উন্নয়নের এই সময়ে ‘জুলিয়াস সিজার’ এর প্রাসঙ্গিকতার খোঁজে, এই প্রযোজনা। ক্ষমতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অর্থলোলুপতা….. এবং দিন দিন ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক ব্যবস্থা আমাদের বাধ্য করেছে একটি নতুন ভাবনা মুখে ধাবিত হতে, সিজারের হত্যার ব্যাখ্যা এবং ষড়যন্ত্রকারীদের চূড়ান্ত পরিণতির পুনর্ব্যখ্যা করতে। ক্ষমতালিপ্সুরা এই পৃথিবীকে চিরতরে ধ্বংস করবে এটাই বাস্তবতা। সুতরাং ‘তুমিও ব্রুটাস!’ এই সংলাপ, আজকের বিশ্বের ‘পাওয়ার প্লে’র সিগনোচার টিউন হয়ে উঠেছে যেন এবং এটাই আমাদের উপস্থাপনার প্রতিপাদ্য বিষয়।’’ অনুবাদক ও নির্দেশকের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে শেক্সপিয়রের নাটকের বিশ্বজননীতা এবং সর্বকালীন প্রাসঙ্গিকতার দিকটি উঠে আসে। হাজার বছর ধরে চলা ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র এবং ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধের চিত্র বিশ্বজুড়ে একইরকমভাবে বিরাজমান। আজকের হিংসান্মোক্ত পৃথিবীতে তা যেন আরও ক্রমবর্ধনশীল। অর্থলিপ্সা আর ক্ষমতালোলুপতায় মানবিকবোধ আজ চরম বিপন্ন। চারশো বছরের বেশি আগে যুগদ্রষ্টা উইলিয়াম শেক্সপিয়রের বাণী তাই আজও নিভৃতে কাঁদে। তবে নিভৃতে না রেখে তাকে আবার সঠিক সময়ে প্রাসঙ্গিকতার সঙ্গে উপস্থাপন করে অনুবাদক ও নির্দেশক এবং তাঁদের সহযোগী শিল্পী কলাকুশলীরা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতার স্বাক্ষর রেখেছেন শৈল্পিক উৎকর্ষে।

প্রাসঙ্গিক ও বিশ্বজনীনতার গুণে শেক্সপিয়রের নাটক কেবল নাটকে সীমাবদ্ধ না থেকে রূপান্তরিত হয়েছে সাহিত্যে, সংগীতে (অর্কেস্ট্রা) ও চলচ্চিত্রে। বিশ্ব চলচ্চিত্রে বারবার চিত্রায়িত হয়েছে তাঁর নাটক। যার মধ্যে কোজিনেৎসেভ, কুরোশাওয়া, পোলানস্কির কাজ বিশেষভাবে স্মরণীয়। ভারতেও আমরা বিশাল ভরদ্বাজ, ঋতুপর্ণ ঘোষ এবং অপর্ণা সেনের হাতে শেক্সপিয়রের নাটকের চমৎকার চলচ্চিত্রক রূপান্তর দেখেছি। ব্রিটিশ কাউন্সিলের সৌজন্যে দেখার সুযোগ পেয়েছি রয়েল শেক্সপিয়র একাডেমির মঞ্চায়িত নাটকের চলচ্চিত্ররূপ। সব মিলে উইলিয়াম শেক্সপিয়র আমাদের সকলের আপনজন। গণায়নের প্রযোজনাটি তাই নিজেদের কাজ বলেই মনে হচ্ছিল সেদিন সন্ধ্যায়।

অসীম নির্দেশনার পাশাপাশি আলো এবং আবহ সংগীতের দায়িত্বও পালন করেছেন। এই দুই কাজেও তিনি সমান দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তার নির্দেশনার অভিনবত্বের ফলে পুরো মিলনায়তনটিই মঞ্চে পরিণত হয়েছে এবং মিলনায়তনপূর্ণ দর্শকেরা পরিণত হয়েছেন শিল্পী কলাকুশলীতে। বিশেষ করে সিজারের হত্যা পরবর্তী দৃশ্যে রক্তিম শামিয়ানায় পুরো মিলনায়তনকে আচ্ছাদিত করা এবং তৎপরবর্তী দৃশ্যগুলোতে রক্তিম শামিয়ানাটিকে মঞ্চের পাটাতনে স্থাপনের মধ্য দিয়ে যে অভিনব প্রয়োগ তিনি করেছেন এর ফলে সিজারের হত্যাকান্ডের পরবর্তী অংশে দর্শকমনে বিক্ষোভ ও প্রতিশোধ স্পৃহার তীব্রতা সৃষ্টিতে তিনি সক্ষম হয়েছেন সফলভাবে।

এই নাটকের অভিনয় অংশে যথেষ্ট সুসংহত ও পরিণত। দুয়েকজন ছাড়া সকলেই অভিনয় দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন। এক্ষেত্রে চরিত্র অনুযায়ী অভিনয় শিল্পী নির্বাচনের দক্ষতা প্রশংসনীয়। যীশু দাশের অবয়ব ও ব্যক্তিত্বময় অভিনয় জুলিয়াস সিজারের চরিত্র সমীহপূর্ণ করে তুলেছে। ব্রুটাস চরিত্রে অনিবার্ন ভট্টাচার্য, ক্যাসকা চরিত্রে সঞ্জীব ভট্টাচার্য্য এবং অক্টাভিয়াস সিজার চরিত্রে শাহ মোঃ মাহফুজার রহমান অনবদ্য অভিনয় করেছেন। অন্যান্য চরিত্রে আসাদ বিন রহমান, সায়হাম মাহমুদ, লাব্রিচাই মারমা, অনিমেষ দাশ, অমিতা বড়ুয়া যথেষ্ট স্বতস্ফূর্ত। অ্যান্টোনিয়াসের চরিত্রে বাপ্পা চৌধুরী, ক্যাসিয়ামের চরিত্রে বিশ্বজিৎ দাশ গুপ্ত এবং মামুনুল হক ভেসিয়াস ব্রুটাসের চরিত্রে দক্ষ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তিনটি চরিত্রে প্রাণসঞ্চার করেছেন। সুকান্ত চৌধুরীর মঞ্চভাবনা সুপরিকল্পিত। তবে মঞ্চ আরও বিস্তৃত হলে তাঁর ভাবনার পরিসরও ব্যাপ্ত হতো বলে মনে হলো। প্রাচীন গ্রীক ও রোমান পোশাকের সঙ্গে ইউরোপীয় পোশাকের সমন্বয়ে আইভী হাসানের পোশাক পরিকল্পনাও বুদ্ধিবৃত্তিকতার স্বাক্ষর রাখে। ইয়াকিন হায়দারের আবহ প্রক্ষেপনও যথাযথ। সব মিলে গণায়নের জুলিয়াস সিজার সুসংহত একটি নাট্য প্রযোজনার দাবি রাখে।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর গণায়ন নাট্য সম্প্রদায়ের ৫০ বছর পূর্তি হতে চলেছে। নিরবচ্ছিন্ন এই চলা নিঃসন্দেহে একটি নাট্যদলের জন্যে শ্লাঘার বিষয়। গণায়নের এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধএসো কিংশুক ফাগুনে