কাব্য শৈলীর গল্প শোনা

জোনাকী দত্ত | বুধবার , ২৮ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৫:০৫ পূর্বাহ্ণ

খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো

বর্গী এলো দেশে,

বুলবুলিতে ধান খেয়েছে

খাজনা দেব কিসে?

ছড়া বলতে বলতে ঠাকুরমা নাতি নাতনির চুলে বিলি কাটতে কাটতে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছেন। আট বছরের কাব্য বিছানা থেকে উঠে বসল। তার দেখাদেখি ছোট বোন ছয় বছরের শৈলীও উঠে গেল। ঠাকুরমা বলল, একি! তোমরা উঠে গেলে কেন? কাব্য ঠাকুরমার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, আর ছড়া শুনতে ভালো লাগছে না। তুমি গল্প বলো। যুদ্ধের গল্প। দাদু যে যুদ্ধ করেছে সেই যুদ্ধের গল্প বলো। সাথে সাথে শৈলীও বলে উঠলো, হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমিও শুনবো। ঠাকুরমা ওদের আগ্রহ দেখে বলল, তোরা শুনতে চাস দাদুভাই? ঠিক আছে, আমি বলব। দাঁড়া আগে কিছু ছবি নিয়ে আসি। তোদের দেখাবো। বলে ঠাকুরমা বিছানা থেকে উঠে আলমারি খুলে একটা ফাইল বের করলো।

কাব্য আর শৈলী উনার একমাত্র সন্তান বিজয় এর ছেলে মেয়ে। কাব্য ৩য় শ্রেণিতে আর শৈলী ১ম শ্রেণিতে পড়ে। উনার ছেলে আর ছেলের বউ একটা সরকারি ব্যাংকে চাকরি করে। ওদের আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। বাসায় কাজের লোক আছে। বিজয় সকালে ছেলে মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে যায়। বিজয়ের মা নাতি নাতনিদের স্কুল থেকে এনে স্নান করিয়ে খাইয়ে দাইয়ে দুপুরে ঘুম পাড়ানোর সময় ছড়া, গান আর গল্প শোনায়।

ঠাকুরমা একটা ফাইল থেকে কিছু পত্রিকার কেটে রাখা অংশ ওদের দেখিয়ে বলল, কাব্য দেখ, উনি হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শৈলী বলল, ঠাকুরমা ওখানে দাঁড়িয়ে দাদুটা আঙুল উঁচিয়ে কি বলছে? ওমা! দেখ দাদা, সামনে কতো মানুষ বসে আছে। কাব্য বলল, তোর বকবকানি থামা। ঠাকুরমা কি বলে সেটা শোন। ঠাকুরমা ওদের শান্ত করে বলল, শোন এই ছবিটা হলো বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের। তিনি ভাষণে বলেছিলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” ঐ জনসভায় তোর দাদুও ছিল। শৈলী ছবিতে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, কই, কই, দাদু কোথায়? আমি তো দেখতে পাচ্ছি না ঠাকুরমা। ঠাকুরমা হেসে বলল, আরে, এতো মানুষের মধ্যে তো বোঝা যাবে না। এই দেখ, এই ছবিগুলো মুক্তিযুদ্ধের। নয় মাস যুদ্ধ করে আমাদের এই দেশ স্বাধীন করেছে মুক্তিযোদ্ধারা। এই তো, এই যে বন্দুক হাতে তোদের দাদুর ছবি। কাব্য চোখ বড় বড় করে বলল, দাদু এই বন্দুক দিয়ে যুদ্ধ করেছে? ঠাকুরমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ রে। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর বাঙালিরা যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তোর দাদু ওর কয়েকজন বন্ধু মিলে কলকাতা থেকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে এসে যুদ্ধ করেছে। কাব্য বলল, আচ্ছা ঠাকুরমা, যুদ্ধ তো ভালো না। তাহলে কেন যুদ্ধ হলো? ঠাকুরমা বলল, পাকিস্তানিরা যখন বাঙালিদের ওপর শাসন শোষণ শুরু করেছে, সব অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে, মানুষের মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছে তখন বাঙালিরা ওদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। আর বাঙালিকে নেতৃত্ব দিয়েছে কে, জানিস? শৈলী বলল, কে বলো না। ঠাকুরমা বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখিয়ে বলল, এই যে ইনি। সবার প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। উনি দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য অনেক লড়াই করেছেন, প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এ জন্য তাঁকে বহুবার জেল খাটতে হয়েছে। পরিবার থেকে দূরে থাকতে হয়েছে। কাব্য বলল, তাহলে তো ঠাকুরমা দাদুটার অনেক কষ্ট হয়েছে, না? ঠাকুরমা বলল, হ্যাঁ রে। উনি নিজে কষ্ট সহ্য করে বাঙালিকে একটি সোনার বাংলা দিতে চেয়েছিলেন। পাকহানাদার থেকে আমাদের দেশকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। শৈলী বলল, যে দাদুটা ভাষণ দিচ্ছেন উনি যুদ্ধ করেন নি? ঠাকুরমা বলল, কি করে করবে, উনাকে তো ২৫শে মার্চ পাকহানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। এই ২৫শে মার্চকে কাল রাত্রি বলা হয়। ঐদিন নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালির ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল পাকবাহিনী। আর যুদ্ধ চলাকালীন বঙ্গবন্ধু তো পাকিস্তানে বন্দী ছিলেন। কিন্তু বন্দী হওয়ার আগে উনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তাঁর নির্দেশ মতো বাঙালিরা যুদ্ধ করে এই দেশ স্বাধীন করেছে। কাব্য বলল, তাহলে ঠাকুরমা বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে ছাড়া পায়নি? ঠাকুরমা আর একটা পত্রিকার অংশ দেখিয়ে বলল, এই যে দেখ, বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার ছবি। সবাই স্বাধীন দেশে তাদের প্রিয় নেতাকে বরণ করে নিচ্ছে। শৈলী বলল, দাদা দেখেছিস দাদুটার গলায় কতো মালা পরানো হয়েছে। ঠাকুরমা বলে চলল, তোর দাদু যুদ্ধ চলাকালীন একদিন আমাদের দেখতে এসেছিল। তোর দাদু বলেছিল, তোমরা সাবধানে থেকো। পাকহানাদার বাঙালিদের ওপর অনেক অত্যাচার, নির্যাতন করছে। ঘরের মহিলাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, বাড়ি ঘরে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। হারামজাদা রাজাকার ওদের সব চিনিয়ে দিচ্ছে। বাবা, মা তোমরা ভয় পেয়ো না। একটু চোখ কান খোলা রেখ। জানি না আর দেখা করতে আসতে পারি কিনা। আমি আর তোর দাদুর বাবা মা ভয়ে ভয়ে ছিলাম যদি রাজাকার দেখে ফেলে। আমরা শুধু নীরবে চোখের জল ফেলে যাচ্ছি। হঠাৎ দরজায় ধাক্কা দিল। আমি আর আমার শ্বাশুড়ি ভিতরের ঘরে চলে গেলাম। আমার শ্বশুর দরজা খুলে দিল। আসলে রাজাকার ওৎ পেতে বসেছিল তোর দাদু কখন আসে। তোর দাদুকে যখন ধরে নিয়ে যাচ্ছে তখন উনি বললেন, এদেশ স্বাধীন হবেই, বঙ্গবন্ধুও আবার ফিরে আসবেন। সেই যে তোদের দাদুকে নিয়ে গেল আর ফিরে এলো না। জানি না কি নির্মম, নিষ্ঠুরভাবে তোর দাদুকেবলে উনি ডুকরে কেঁদে উঠলো। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, দেশ স্বাধীন হলো। তোর বাবার জন্ম হলো। ওর নাম রাখা হলো বিজয়। বলতে বলতে ঠাকুরমার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। শৈলী আর কাব্য ঠাকুরমার চোখের জল মুছে দিলো। ঠাকুরমা ওদের বুকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর ওরা তিনজন কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো টেরও পায়নি। বিজয় আর বৌমা অফিস থেকে এসে চায়ের টেবিলে যাওয়ার আগে ওদের ডেকে তুলল। সবাই একসাথে চা নাস্তা খেতে খেতে কাব্য বলল, জানো বাবা আজ মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনেছি। শৈলী পাউরুটি মুখে দিয়ে খেতে খেতে বলল, হ্যাঁ বাবা ঠাকুরমা আজ আমাদের দাদুর যুদ্ধের গল্প বলেছে। মা বলল, ঠিক আছে, আগে খেয়ে নাও। বাবা বলল, ওমা, তাই নাকি? আচ্ছা, আমি তোমাদের ছোটদের মুক্তিযুদ্ধের গল্পের বই এনে দেব। তাহলে তোমরা অনেক কিছু জানতে পারবে। ঠাকুরমা বলল, ঠিক বলেছিস, ওদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সঠিক ইতিহাস জানতে হবে। মা শৈলীকে খাইয়ে দিতে দিতে বাবাকে বলল, ছবিসহ কতগুলো ছোটদের বই আছে তুমি ওগুলো নিয়ে এসো। তাহলে ওরা ছবিও দেখবে আর পড়ে জানতেও পারবে। তাছাড়া মা তো আছেন। ওরা ওদের ঠাকুরমার কাছে সব জানতে পারবে। বাবা বলল, ঠিক বলেছ। ঠাকুরমা চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, দাদুভাই তোমরা বড় হলে আরো অনেক কিছু জানতে পারবে। বড় বড় বই পড়ে অনেক জ্ঞানী হবে। শৈলী বলল, না না আমি বড় বই পড়ব না। ওতে বেশি বেশি পড়া থাকে। দাদা ওগুলো পড়বে। আমি শুধু ঠাকুরমার থেকে গল্প শুনব আর ছবি থাকে ঐরকম বইগুলো দেখব। সবাই ওর কথায় হেসে উঠলো।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপৃথিবীর একমাত্র উড়ন্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী
পরবর্তী নিবন্ধআঞ্জুমান-এ-মোত্তাবেয়ীনে গাউছে মাইজভাণ্ডারীর সভা