কর বৃদ্ধি করবেন না মাননীয় মেয়র

মো. শফিকুল আলম খান | শুক্রবার , ২৮ জানুয়ারি, ২০২২ at ৮:১১ পূর্বাহ্ণ

সমপ্রতি পত্রিকার এক সংবাদে জানা গেছে পৌর কর নির্ধারণে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) পঞ্চবার্ষিকী কর পুনমূল্যায়নের ওপর আরোপিত স্থগিতকরণ আদেশ সরকারের স্থানীয় মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রত্যাহার করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে এর আগের মেয়র আ জ ম নাসিরউদ্দিনের সময় পৌর কর বৃদ্ধি করে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হলে চট্টগ্রাম শহরের সমগ্র ভবন মালিকেরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়। যার প্রেক্ষিতে সরকার দুহাজার সতের সালে নেয়া এই বর্ধিত আ্যসেসমেন্ট স্থগিতকরণ করে।

বর্তমান মেয়র রেজাউল করিম সাহেব আগের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার চেয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগে গত মাসে প্রস্তাব দেন। তার প্রস্তাবে সারা দিয়ে সরকার স্থগিতকরণ আদেশ প্রত্যাহার করে নেয়। বর্তমানে পুনরায় গৃহ কর প্রত্যাহারের এই সর্বশেষ সিদ্ধান্তটি ভবন মালিকদের ভীষণ দুশ্চিন্তায় নিপতিত করেছে। গত তিন বছর যাবত ভবন মালিকেরা মহা বিপদগ্রস্থ। বিশ্ব মহামারী করোনো সমগ্র অর্থনীতিকে টালমাটাল অবস্থায় নিমগ্ন করেছে। সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা দাঁড়িয়েছে সর্বনিম্নে। শহরে বসবাসকারী সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার যারা পরিবার পরিজন নিয়ে এক সময় বাসা ভাড়া নিয়ে শহরে থাকতো তাদের একটি বৃহত্তম অংশ এখন গ্রামে শিকড় পাততে বাধ্য হয়েছে। এদিকে শহরের কোনো বাসা একবার খালী হলে মাসের পর মাস ভাড়া হয় না। তাছাড়া কোনো সময় ভাড়া হলেও বাড়ি ভাড়া গড়ে বিশ/ত্রিশ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। পক্ষান্তরে দ্রব্যমূল্যের দাম হু হু করে বেড়েই চলেছে। অন্যদিকে মরার ওপর যেন খড়ার ঘা। প্রতি বছর আয়কর বিভাগ গূহ আয়ের ওপর একটি বিরাট অংশ আয়কর হিসেবে আদায় করে থাকে। অন্যদিকে বাড়ছে গ্যাস, বিদ্যুত ও পানির বিল জ্যামিতিক হারে। ইতোমধ্যে রান্নার ডাবল বার্নার চুলার গ্যাস বিল মাসে একুশ শত টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। যারা সারা জীবনের সঞ্চয় থেকে মাথা গোঁজার জন্য একটা বাড়ি করেছেন সে বাড়ি ভাড়া দিয়ে দুর্দিনে দুঃসময়ে দুমুটো খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকবে, বুঝতে পারছি না তারা এখন কোথায় যাবে? কোথায় তাদের ফরিয়াদ জানাবে? তারা এখন বড়ই অসহায়।

সিটি কর্পোরেশনের আয়ের মূল উৎস পৌর কর। সিটি কর্পোরেশন আ্যক্ট দুহাজার নয় এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকারি / বেসরকারি উভয় খাত থেকেই চসিক সতের শতাংশ হারে পৌরকর আদায় করতে পারে। তন্মধ্যে সাত শতাংশ হোল্ডিং ট্যাক্স, তিন শতাংশ বিদ্যুত এবং বাকি সাত শতাংশ আবর্জনা অপসারণ বাবদ আদায় হয়। পরিবর্তে সিটি কর্পোরেশন নাগরিক সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে বাধ্য।

তুলনা করলে দেখা যায় রাজধানী ঢাকার সাথে রয়েছে এই হারের যথেষ্ট তারতম্য। দ্বিতীয়তঃ সিটি কর্পোরেশন থেকে নাগরিক সুবিধা কতটুকু পাওয়া যায় তা শুধু ভূক্তভোগীরাই বেশি বলতে পারবেন। সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়তই মশার যন্ত্রণায় অস্থির। ছাত্র ছাত্রীরা সন্ধ্যেয় পড়ার টেবিলে বসতে পারে না। বই খাতা নিয়ে আশ্রয় নিতে হয় মশারীর নিচে। আর আমাদের মত বৃদ্ধাদের সন্ধ্যে থেকে শুরু হয় এ গালে এক থাপ্পড় আবার অন্য গালে আর এক থাপ্পড়। এ যেন মশা মারতে কামান দাগানো। কিন্তু খুবই চতুর মশা মশাইয়ের নাগাল পাওয়া বড়ই দুষ্কর। তাই তো সে ছোট বেলার মশা মারা কেরানীর গল্পটা রোমন্থন করতে ইচ্ছে হয়।

আর রাস্তা ঘাটে চলাচলের কথা নাই বা বললাম। রাস্তা দিয়ে চলার পথে নালার গন্ধে হাঁটা বড়ই দায়। পেটের ভিতর থেকে যেন সব নাঁড়ি ভুঁড়ি এক সাথে বের হয়ে যায়। অবশ্যই আমরা অসেচতন নাগরিকেরা এর জন্য কম দায়ী না। কষ্ট করে নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা না ফেলে যেখানে সেখানে ফেলে দি। আর দায় চাপাই সিটি কর্পোরেশনের ওপর। রাতে সড়ক বাতি প্রায় জায়গায় দেখা মিললেও অনেক সময় সকাল সাতটায় আটটায়ও এগুলো নিভানো হয় না। সকালে প্রাতঃভ্রমণে বের হয়ে সড়ক বাতি জ্বলতে দেখলে মনে বড় কষ্ট লাগে। তখন মনে পড়ে ‘যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি’ কবিতাটি। অন্যদিকে সিটি কর্পোরেশনের দিকে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে প্রচুর। এগুলোর লাগাম টেনে ধরতে পারলে কর্পোরেশন এর ব্যয়ভার বহুলাংশে হ্রাস পাবে। কমবে জনগণের ওপর করের চাপ।

মেয়র রেজাউল করিম সাহেব জানিয়েছেন স্থগিতকরণ আদেশ প্রত্যাহার করা হলেও এই দুঃসময়ে ট্যাক্স বাড়ানো হবে না। শুধু ট্যাক্সের আওতা সমপ্রসারণ করা হবে। অন্য কোনো পরিকল্পনা নেই। তাই তাকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাতে হয়। খুবই ভালো কথা, যুক্তিযুক্ত। ইতোমধ্যে শহরের বিভিন্ন জায়গা বহু নতুন বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়েছে। অনেক বাড়ির পরিধি বড় হয়েছে। একতলা / দোতলা বাড়িকে আরো বাড়ানো হয়েছে। হ্যা, এই নব নির্মিত বা বর্ধিত ঘর বাড়িগুলো অবশ্যই করের আওতায় আসতে হবে। প্রতিটি নাগরিকেরও স্বেচ্ছায় সেগুলোর হিসেব কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগে দেয়া বাঞ্চনীয়। মেয়র আবার এও বলেছেন যারা আপিল করবে তাদের ট্যাক্স সহনশীল পর্যায়ে রাখা হবে। এখানে বিষয়টি অস্পষ্ট। এটাকি নতুনদের জন্য? নাকি পুরাতনদেরও আবার নতুন করে এর আওতায় নিয়ে আসা হবে? মেয়র সাহেব সেটা হলে বিষয়টি সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক ও বিপরীতধর্মী। এ দেশের আম জনতা আর্জি নিয়ে আপনার দরবারে কতজন কতবার পৌছাতে পারবে তাও বিবেচনার দাবী রাখে। চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা আলহাজ্ব এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী এক নাগাড়ে সতের বছর চট্টগ্রামের নগর পিতার দায়িত্ব সফলতার সাথে পালন করেছিলেন। তিনি সত্যিই এই নগরের প্রকৃত পিতাই ছিলেন। সব সময় ছিলেন নগরবাসীর সুখে দুঃখে। মেয়র পদে দীর্ঘ সময় ধরে দায়িত্ব পালনকালে তিনি একটাকাও গৃহকর বৃদ্ধি করেননি। তিনি তার উত্তরসূরীদের জন্য জলন্ত নজির রেখে গেছেন কি করে কর না বাড়িয়েও অতি সুন্দর নির্মল বাসযোগ্য একটা শহর চট্টলবাসীকে উপহার দেয়া যায়। তিনি বিভিন্ন আয়বর্ধক প্রকল্প গ্রহণ করে একদিকে চসিকের আয় বাড়িয়েছেন অন্যদিকে চট্টগ্রামবাসীকে করের বোঝা থেকে মুক্তি দিয়েছেন। তার কাজে কর্মে তিনি চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষের খুবই আপনজন হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন।

আমরা জানি বর্তমান মেয়র রেজাউল করিম চট্টলার সফল মেয়র মরহুম মহিউদ্দিন চৌধুরীর যোগ্য উত্তরসূরী। স্বাধীনতার আগে একসাথে ছাত্র রাজনীতি করার সময় দেখেছি আপনার মধ্যে ছিল খুবই নির্মোহ, দৃঢ়চেতা ও সুদুরপ্রসারী চিন্তাভাবনার বহিঃপ্রকাশ। রাজনীতিতে আপনি নিঃসন্দেহে একজন খুবই প্রবীণ, করিতকর্মা নিবেদিত প্রাণ। তাই জনগণের মনের ভাব, দুঃখগাথার ইতিহাস আপনার মনের অতলে শিকড় পুঁতে আছে। আমরা আশা করব আপনি এই দুর্দিনে নগরবাসীর ওপর গৃহ করের অহেতুক বোঝা ছাপিয়ে না দিয়ে করের আওতা সমপ্রসারণের বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। সমগ্র চট্টগ্রামবাসী জননেতা মহিউদ্দিন চৌধুরীর মত আপনাকেও তাদের মনের মনিকোটায় দীর্ঘ স্থান করে দেবে। স্মরণ করবে আজীবন শ্রদ্ধার সাথে।

লেখক : বাংলাদেশ রেলওয়ের অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানুষ সৃষ্টির সেরা
পরবর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা