কর্মজীবী নারী : ঘরে ও বাইরে

উম্মে সালমা | শনিবার , ২৬ আগস্ট, ২০২৩ at ৫:৪২ পূর্বাহ্ণ

যে রাধে, সে চুলও বাঁধে’এদেশের নারীরা শিশুকাল থেকেই এই প্রবাদ বাক্যটি শুনে শুনে বড় হয়েছে। এই বাক্যটি আজো আপামর নারী সমাজের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ী এবং আমাদের পরিবারেসমাজে নারীরা দশহাতে কাজও করেন! কিন্তু, এই প্রবাদ বাক্যটি খানিকটা তোষণমূলকও নয় কি? হাজার বছর ধরে চর্চিত এই ভাবনাটি কী নারীর উপর চাপও তৈরি করে না?

পরিবারে, কর্মক্ষেত্রে, সমাজেসর্বত্রই নারীর জন্য বাধা বা চ্যালেঞ্জ একটু বেশিই, আর কর্মজীবী নারীর চ্যালেঞ্জটা এক্ষেত্রে যেন বহুগুণ। সংসারসন্তান সামলে কর্মক্ষেত্রকেও দিতে হয় সমান গুরুত্ব। কর্মজীবী নারী শব্দটি শুনলেই চোখে ভেসে ওঠে একজন ব্যস্ত ও দায়িত্বশীল নারীর চেহারা। দশভূজার মতো কর্মজীবী নারী ঘরে ও বাইরে দুই জায়গাতেই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। দায়িত্ব পালন শুরু হয় সেই ভোর থেকেই। সকালের খাবার তৈরি করা, বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর জন্য তৈরি করা, তাদের টিফিন তৈরি করা, সকাল ও দুপুরে বরের খাবার গুছিয়ে দেয়া, দুপুরে পরিবারে বাকি সদস্যরা কী খাবে সেই দিকটা সামলে অফিসের জন্য নিজেকে তৈরি করা ইত্যাদি ইত্যাদি। বাচ্চারা ঠিকমতো স্কুলে গেল কি না, বাসায় এলো কি না, খেল কি না, বাসার অসুস্থ বয়স্ক সদস্য থাকলে তার খাওয়া হলো কি না কিংবা ওষুধ খেল কি নাএ সবের খোঁজ নেয়াটাও কর্মজীবী নারীর নিত্য রুটিনেরই অংশ। এসব তদারকি করার পাশাপাশি অফিসকেও দিতে হয় সমান গুরুত্ব।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ অনুযায়ী কর্মজীবী পুরুষের তুলনায় কর্মজীবী নারী কাজ করেন তিনগুণ। তবে কর্মজীবী নারীর গৃহস্থালি কর্মকাণ্ডের আর্থিক মূল্যায়ন করা হয় না, ফলে যার গুরুত্বও দৃশ্যমান নয়। শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ দিন দিন বাড়ছে; কিন্তু ঘরের কাজ বাদ দিয়ে নয়। কারণ অনেকেই মনে করেন ঘরের কাজ শুধু নারীরা করবেন। অনেক পরিবার আছে, নারীকে শর্তই দেয় যে ঘরের কাজ সামলে যদি চাকরি করতে পার তাহলে কর। যিনি বেশি বেতনে চাকরি করেন, তিনি হয়ত ঘরের কাজে সহায়তা করার জন্য সহযোগী রাখতে পারেন। কিন্তু কম পারিশ্রমিক পাওয়া কর্মজীবী নারীদের সমস্যা হয় বেশি। চাকরি সামলে একজন কর্মজীবী মা সন্তানের দেখভাল শুধু নয়, তাদের সঠিক লেখাপড়ার দিকে নজর দেয়ার দায়িত্বটাই যেন ওই মায়েরই। এক কথায় সন্তানের সুষ্ঠু লালনপালনের দায়িত্বটা যেন অনেকটা অবধারিতভাবেই মায়ের। তাই অফিস থেকে ফিরে কর্মজীবী নারীকে নামতে হয় আরেক দফা সংসারের কাজে। অনেকটা যুদ্ধ ক্ষেত্রের মতো। যুদ্ধক্ষেত্রে মাঝেমধ্যে যুদ্ধবিরতি থাকলেও এই সংসার সামলানোর যুদ্ধে বিরতি বলে কিছু নেই। প্রতিনিয়তই তাকে লড়ে যেতে হয়। ঘরঅফিস, আবার ঘর।

ঘরে বাইরে যে নারী এত শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন দিনের পর দিন পরিবারে তারা কতটুকু মর্যাদা পাচ্ছেন? আমাদের দেশে চলমান পিতৃতান্ত্রিক পরিবার ব্যবস্থায় একজন মা কিংবা পরিবার প্রধানের স্ত্রী হিসেবে নারী শুধু কাজেকর্মে ব্যস্ত থাকবেন, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তার মতামতের ভূমিকা খুব একটা থাকে না। তিনি যেহেতু ঘরে ও বাইরে দুই জায়গাতেই দায়িত্ব পালন করছেন, আয়উপার্জন করছেন, তাই পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও তার মতামতের গুরুত্ব আছে বৈকি। যৌক্তিক বিবেচনায় যতখানি গ্রহণযোগ্য, ঠিক ততটাই নারীর মতামতকে আমলে নিতে হবে। আমরা যেনো ভুলে না যাই যে, কর্মজীবী নারীরাই অফিস এবং পরিবার এই দুটো প্রতিষ্ঠানকে বস্তুত বাঁচিয়ে রাখেন।

এই যুদ্ধের আরেকটি ভয়াবহ দিকও রয়েছে। কর্মজীবী নারীরা বাইরে যাওয়ার আগে পানাহার বন্ধ করে রাখে টয়লেট খোঁজার বিড়ম্বনা এড়াতে গিয়ে, প্রায় ৭০ শতাংশ নারী জরায়ু মুখে ইনফেকশন বাঁধিয়ে রেখেছেন। কর্মক্ষেত্রে নারীর শারীরবৃত্তীয় কোন অসুবিধার ওরিয়েন্টেশন নেই বললেই চলে, যতটুকু আছে সেটুকুও হেনস্তার অপর নাম! সরকারিবেসরকারি কোন অফিসেই এ সম্পর্কিত আলাদা কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না। উল্টো, কোন সমস্যা হলে তা এড়িয়ে গিয়ে নারী কর্মীকে ছাঁটাই করার ঘটনাই বরং গতানুগতিক। নারীর ঋতুকালীন, মাতৃত্বকালীন, মাতৃত্ব পরবর্তী কোন সময়েই কর্মক্ষেত্র থেকে মানবিক সহায়তাটুকু এই দেশের নারীরা পান না। মুষ্টিমেয় যেসব কর্মক্ষেত্র এই দায় এড়ায় না, তারা প্রচলিত প্রতিষ্ঠান সমূহের প্রতিনিধি নয়। এখন পর্যন্ত নারীপুরুষ নির্বিশেষে সমপদমর্যাদার বেতন কাঠামোই যেখানে বৈষম্যমুক্ত হতে পারেনি, সেখানে আলাদা করে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উৎপাদন ব্যবস্থায় নারীর ভূমিকা পর্যালোচনা করে সে মোতাবেক তার প্রাপ্য অধিকার দেয়ার কথা বলাটা বাতুলতা।

নারীর সমতা, মর্যাদা, অধিকারের প্রসঙ্গে বড় পরিসরে পরিবর্তন রাতারাতি আনা অসম্ভব হলেও ব্যক্তিগত চর্চা দিয়ে তার কিছুটা উপশম অন্তত করা যায়। প্রত্যেকেরই নিজের একটা জীবন আছে। নারী, সে জীবনে বছরে একটিদিন বিশেষ শুভেচ্ছা নিয়ে বা না নিয়ে যেভাবেই হোক নিজের যাপনটুকু করে যাক, এই প্রত্যাশাই করি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বাস্থ্যবান তরুণেরা দেশের সম্পদ, এদের ভবিষ্যৎ নির্মাণের দায়িত্ব আমাদেরই
পরবর্তী নিবন্ধস্মৃতিসুধা