কর্মক্ষেত্রে নারীর অধিকার ও প্রয়োগ

রিমঝিম আহমেদ | শনিবার , ২৪ জুন, ২০২৩ at ৭:৪০ পূর্বাহ্ণ

আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে আমাদের দেশের নারীদের কর্মক্ষেত্রের পরিধিও ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছে। নারী এগোচ্ছে বিভিন্ন পেশা, ব্যবসা, রাজনীতি সবখানেই অংশগ্রহণ বাড়ছে কিন্তু কর্মক্ষেত্রে নারীকে কোন দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে। তার কাজের পরিবেশ এবং নিরাপত্তাই বা কেমন?

কর্মক্ষেত্রে নারীর অবস্থান

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশের ৫ কোটি ৪১ লাখ কর্মজীবীর মধ্যে ১ কোটি ৬২ লাখ নারী ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ১৬ হাজার ৬৯৭ জন। বিদেশে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত ৭৬ লাখ প্রবাসীর মধ্যে ৮২ হাজার ৫৫৮ জন নারী আর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পের ৮০ ভাগ কর্মীই নারী। দেশের ৯০ শতাংশ ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবহারকারীও নারী।

বাংলাদেশে সরকারি ও আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে অনুমোদিত পদের সংখ্যা ১০ লাখ ৯৭ হাজার ৩৩৪টি।

এর মধ্যে নারীর সংখ্যা ৮৩ হাজার ১৩৩, অর্থাৎ শতকরা ৭.৬ ভাগ। উপসচিব পদ থেকে সচিব পদ পর্যন্ত নারীদের সংখ্যা মাত্র ১ শতাংশ বা তারও কম। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের বিচার বিভাগে বিচারক পদের ১০ শতাংশ হলো নারী।

এতকিছুর পরও আমরা জানি, নারী শুধু কর্মক্ষেত্রে নয়, সংসারেও তাদের কর্তৃত্ব করেন। সে হিসেবে নারীর কর্মক্ষেত্র দুটো। সংসার সামলে তাদের কর্মক্ষেত্রেও শ্রম দিতে হয়। একই পরিবারে স্বামীস্ত্রী উভয়েই কর্মজীবী হলেও দেখা যায়, পুরুষটি তার কর্মক্ষেত্রের জন্য সংসারের দায়িত্ব থেকে যতটা মুক্তি পেয়েছে, স্ত্রী নামক নারীটি কিন্তু সংসার থেকে সে পরিমাণ উদারতা পাচ্ছে না। পারিবারিকসামাজিক দায়িত্ব, সন্তান কিংবা পরিবারের কোনো সদস্যের অসুখবিসুখ ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীকে যতটা ভূমিকা পালন করতে হয়, পুরুষের ভূমিকা ততটা হয় না। এমন বিরূপ পারিবারিক অবস্থায় থেকেও তাকে সংসারের সাথে তাল রেখে অফিস সামলাতে হচ্ছে।

এটাই বাস্তবতা যে, নারী কর্মক্ষেত্রে পুরুষের সমান অধিকার ও সুযোগ ভোগ করতে পারছে না। ছুটির ক্ষেত্রেও তাদের বাড়তি সুযোগসুবিধা দেওয়া হচ্ছে না, কেবল প্রসবকালীন ছুটি ব্যতীত।

দেশের কর্মজীবী নারীরা ছয় মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটি পাওয়ার অধিকারী। কিন্তু আমাদের পোশাক ও শিল্প কারখানাগুলোর নারী শ্রমিকেরা অনেক ক্ষেত্রেই তাদের মাতৃত্বকালীন ছুটির অধিকার থেকে বঞ্চিত হন।

নিয়োগ কর্তা বা মালিকপক্ষরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে গর্ভবতী নারীদের ছুটি দিতে চান না। তার ওপর আবার বেতনসহ ছুটি, সে তো আরো পরের বিষয়। এভাবেই নারী শ্রমিক বিশেষ করে গর্ভবতী নারী শ্রমিকরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে।

আইনানুযায়ী শিল্প কারখানার কর্মপরিবেশ তাদেরকে ও অধিকার রক্ষায় একটি সরকারি পরিদর্শকের পদ রয়েছে। তার কাজ হচ্ছে নিয়মমাফিক কলকারখানা পরিদর্শন করা ও সে মোতাবেক সুপারিশ করা। কিন্তু বাস্তবে এরকম পরিদর্শন ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া কতটা ঠিকঠাক হয় তা এক প্রশ্ন।

নারী শ্রমিকদের সন্তান প্রসব করার পর আরেকটি বিশেষ সুবিধা বা অধিকারের কথা বলা আছে। তা হচ্ছে ডে কেয়ার সেন্টার। দেশের খুব কম কর্মস্থলেই শিশুদের জন্য ডে কেয়ার সেন্টার আছে। আইনে বিধান থাকলেও তার কোনো বাস্তবায়ন নেই। আইনানুযায়ী কোনো প্রতিষ্ঠানে যদি ৫০ জনএর বেশি নারী শ্রমিক থেকে থাকেন তবে সে প্রতিষ্ঠানে নারী শ্রমিকদের শিশু সন্তানদের জন্য শিশু কক্ষ বা শিশু পালন কেন্দ্রএর ব্যবস্থা থাকতে হবে। কিন্তু ৫০ এর অধিক নারী শ্রমিক কাজ করে এরকম প্রতিষ্ঠান দেশে অনেক আছে। দেশে ডে কেয়ার আছে এমন প্রতিষ্ঠান ৫০টিও আছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে।

মূলত ২০০৬ সালের শ্রম আইনের চতুর্থ অধ্যায়ে বর্ণিত অধিকারগুলো থেকে নারীরা বিভিন্নভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন।

জাতিসংঘের নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ বা সিডও সনদে মাতৃত্বকালীন ছুটিকে নারীর অধিকার বলা হয়েছে। সনদে মাতৃত্ব, সন্তান লালনপালন পরিবার ও রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই অধিকার দেশের অনেক মা ভোগ করতে পারছেন না।

বাংলাদেশে মাতৃত্বকালীন ছুটির আইন

২০১১ সালের ৯ জানুয়ারি প্রকাশিত গেজেটের ১৯৭ ধারার উপধারা১ সংশোধন করে সরকারী চাকুরীজীবী নারীদের মাতৃত্বকালীন ছুটির মেয়াদ বেতনসহ চারমাস থেকে ছয় মাস করা হয়। এ সংশোধনের আরও বলা হয় চাকুরীকালীন নারীরা সর্বোচ্চ ২ বার এই ছুটি ভোগ করতে পারবেন। মাতৃত্বকালীন ছুটিকে চাকুরীকাল হিসেবে গণ্য করা হবে। এ ছুটি জমাকৃত কোন ছুটি থেকে বিয়োগ করা হবে না। ২০২১ সালের ১৯ মে মাতৃত্বকালীন ছুটি সংক্রান্ত আরেকটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে তা গেজেট আকারে প্রকাশ হয়। বলা হয়, ছয় মাসের কম বয়সী শিশু সন্তান নিয়ে প্রথম সরকারি চাকরিতে যোগ দিলে সন্তানের বয়স ছয় মাস হওয়া পর্যন্ত পূর্ণ বেতনে মাতৃত্বকালীন ছুটি কাটাতে পারবেন। বাংলাদেশ ব্যাংক, তফসিল ব্যাংকসমূহেও কর্মরত নারী কর্মীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ছয় মাস। এছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ বেতনে ছুটি ছাড়াও স্বাস্থ্যবীমা, গ্রাচুইটি ইত্যাদি ভাতার সুবিধা আছে।

১৯৭() বিধি সংশোধিত হওয়ায় প্রসূতি ছুটি সংক্রান্ত বিদ্যমান বিধানসমূহ নিম্নরূপ:

() প্রসূতি ছুটির মেয়াদ ৬ (ছয়) মাস। গর্ভবতী হওয়ার পর যে তারিখ হইতে ছুটিতে যাইবার আবেদন করিবে, ঐ তারিখ হইতে ৬ (ছয়) মাসের ছুটি মঞ্জুর করিতে হইবে। তবে উক্ত ছুটি আরম্ভের তারিখ সন্তান প্রসবের উদ্দেশ্যে আতুর ঘরে আবদ্ধ হইবার তারিখের পরবর্তী কোন তারিখ হইতে পারিবে না। অর্থাৎ ছুটি আরম্ভের সর্বশেষ তারিখ হইবে সন্তান প্রসবের তারিখ। উল্লেখ্য গর্ভবতী হইবার স্বপক্ষে ডাক্তারি সার্টিফিকেটসহ আবেদন করা হইলে প্রসূতি ছুটির আবেদন না মঞ্জুর করিবার বা ছয় মাস অপেক্ষা কম সময়ের জন্য ছুটি মঞ্জুর করিবার কিংবা ছুটি আরম্ভের তারিখ পরিবর্তন করিবার ক্ষমতা ছুটি মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষের নাই [বি, এস, আর, বিধি১৯৭()

() গেজেটেড কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে সরকার অথবা সরকার কর্তৃক গমন কর্মকর্তা এবং ননগেজেটেড কর্মচারীদের ক্ষেত্রে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ অথবা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এই প্রসূতি ছুটি মঞ্জুরীর জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত। অর্থাৎ উভয় ক্ষেত্রেই অর্জিত ছুটি মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ প্রসূতি ছুটি মঞ্জুরীর জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত বি,এস,আর, প্রথম খণ্ড, বিধি১৯৭(), ১৪৯ ও ১৫০)

() সমগ্র চাকুরী জীবনে প্রসূতি ছুটি দুইবারের বেশী প্রাপ্য নয় [বি, এস, আর, পার্ট১ বিধি১৯৭ (১এ)]

() প্রসূতি ছুটি “ছুটি হিসাব” হইতে বিয়োগ হইবে না বি, এস, আর, পার্ট, বিধি১৯৭ (১বি)]

() ছুটিকালীন সময়ে ছুটিতে যাইবার প্রাক্কালে প্রাপ্য বেতনের হার পূর্ণ বেতন। প্রাপ্য [বি, এস, আর, পার্ট, বিধি১৯৭(১বি)]

() ডাক্তারী সার্টিফিকেটের ভিত্তিতে গড় বেতনে অর্জিত ছুটিসহ যে কোন প্রকার ছুটির আবেদন করিলে প্রসূতি ছুটির ধারাবাহিকতাক্রমে উক্ত প্রকার ছুটি মঞ্জুর করা যাইবে [বি, এস, আর, পার্ট, বিধি১৯৭()]

() অস্থায়ী কর্মচারীও স্থায়ী কর্মচারীর অনুরূপ সময় পর্যন্ত প্রসূতি ছুটি প্রাপ্য। তবে অস্থায়ী কর্মচারীর চাকুরীর মেয়াদ সন্তান প্রসবের তারিখে ন্যূনতম ৯ (নয়) মাস হইতে হইবে [বি, এস, আর, পার্ট, বিধি১৯৭() এর নোট]। বর্তমানে যোগদানের পর হতেই প্রযোজ্য। সন্তান জন্ম নিলেও অবশিষ্ট সময়ের জন্য প্রযোজ্য। শিশুর জন্মের পরও মাতৃত্বকালীন ছুটি মঞ্জুর করা যাবে।

() মহিলা শিক্ষানবীশ (Lady Apprentices) এবং পার্টটাইম মহিলা ল’ অফিসার প্রসূতি ছুটি প্রাপ্য [ফান্ডামেন্টাল রুলস এর সাবসিডিয়ারী রুলস২৬৭ এর সরকারী সিদ্ধান্ত]

তবে বাংলাদেশে প্রচলিত শ্রম আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩), ধারা ৪৬, ৪৭ এবং বিধি ৩৮ অনুযায়ী যেকোন নারী শ্রমিকের সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য তারিখের আগের আট সপ্তাহ এবং পরের আট সপ্তাহ অর্থাৎ মোট ষোল সপ্তাহ পর্যন্ত পারিশ্রমিকসহ প্রসূতিকালীন ছুটি নেয়ার অধিকার আছে। একটি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগকর্তা প্রসূতিকালীন সুবিধা প্রদান করেন এবং এটি প্রতিষ্ঠানের সকল নারী শ্রমিকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এজন্য নিয়োগকর্তার কাছে একজন গর্ভবতী নারীকে তার শিশু জন্মদানের প্রত্যাশিত তারিখের আট সপ্তাহ পূর্বে প্রসবের সম্ভাবনার কথা জানিয়ে বা প্রত্যাশিত তারিখের সাত দিনের মধ্যে জন্মদান করেছেন তা জানিয়ে মৌখিক বা লিখিত নোটিশ দিতে হবে। কোন প্রতিষ্ঠান মালিক সজ্ঞানে কোন নারীশ্রমিককে তার সন্তান প্রসব তারিখের পরবর্তী আট সপ্তাহের মধ্যে কাজ করাতে পারবে না এবং কোন নারী নিজেও সন্তান প্রসবের আট সপ্তাহের মধ্যে কোন প্রতিষ্ঠানে কাজের জন্য নিয়োগ নিতে পারবে না। একজন নারীর ষোল সপ্তাহের প্রসবকালীন ছুটির মজুরী তার পূর্ববর্তী দৈনিক, সাপ্তাহিক বা মাসিক মজুরীর গড় হারে প্রাপ্য হবে।

এর জন্য শর্তাবলী হলো, একজন নারীশ্রমিককে সেই প্রতিষ্ঠানে সন্তান প্রসবের আগে ন্যূনতম ছয় মাস কাজ করতে হবে। মাতৃকালীন সুবিধা পাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট নারী শ্রমিককে চিকিৎসকের প্রত্যয়নপত্রসহ সরকার নির্ধারিত নির্দিষ্ট ফরমে প্রথম আট সপ্তাহের ছুটি শুরুর কমপক্ষে আটচল্লিশ ঘন্টা পূর্বে কর্তৃপক্ষের নিকট নোটিশ প্রদান করতে হবে। মাতৃকালীন সুবিধা পাওয়ার জন্য ছুটির জন্য নির্ধারিত ফরমে আবেদন করতে হবে পরবর্তী আট সপ্তাহের আর্থিক সুবিধার জন্য সন্তান প্রসবের প্রমাণসহ নোটিশ প্রদান করতে হবে। তবে যদি আগেই দুই বা তার অধিক সন্তান জীবিত থাকে সেক্ষেত্রে সে মাতৃকল্যাণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিনা মজুরীতে ছুটি প্রাপ্য হবে।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সরকারি এসব আইন ও নির্দেশনার বাস্তবায়ন খুবই কম হয়। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদ্যমান উদাসীনতাই এর প্রধান কারণ। অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিক সচেতনতারও অভাব রয়েছে।

কর্মক্ষেত্রে নারীর সব ধরনের নিরাপত্তা বিধান করা নিয়োগকারীর আইনগত দায়িত্ব। কিন্তু শুধু নারীরা কেন কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা একটি স্বাভাবিক বিষয়। অধিকাংশ কর্মীই মনে করেন তারা একটি ঝুকিপূর্ণ কর্মক্ষেত্রে কাজ করছেন। শুধু শারীরিক নিরাপত্তাই মূল বিষয় নয়। শ্রমিকদের আর্থিক নিরাপত্তা তথা সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টিই আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। কর্মক্ষেত্রে নারীর সব অধিকার প্রতিষ্ঠা করে নারী ক্ষমতায়নের পথকে প্রশস্ত করতে হবে।

শিশু সুরক্ষা সমাজকর্মী , সিএমএম কোর্ট, প্রবেশন কার্যালয়, চট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধছুটির দিনে ৩ কিলোমিটার জুড়ে সরকার হাট
পরবর্তী নিবন্ধমধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশী নারীর নির্যাতন