চট্টগ্রাম বন্দরের ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের কাজ ও মেয়াদ বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই সাথে বাড়ছে প্রায় ১শ কোটি টাকা খরচও। ইতোমধ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষের এই প্রস্তাব নিয়ে মন্ত্রণালয়ে আলোচনা হয়েছে। কর্তৃপক্ষের এই প্রস্তাবের যৌক্তিকতা আজ রোববার সরেজমিনে পরিদর্শন করবেন নৌ পরিবহন সচিব। নদী পরিদর্শন শেষে তিনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকও করবেন। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিবের মতামতের ওপর প্রকল্পটির মাটি খননের কাজ বৃদ্ধি করার বিষয়টি নির্ভর করছে। একই সাথে নির্ভর করছে ব্যয় অনুমোদনের ব্যাপারও।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের জন্য মালয়েশিয়ার কোম্পানির সাথে চুক্তি করার পর তারা স্থানীয় একটি এজেন্সিকে কাজ দিয়ে গা ঢাকা দেয়। এরপর কর্ণফুলীর বিপর্যয় শুরু হয়। পরবর্তীতে কাজ ফেলে রেখে দেশীয় কোম্পানির গা ঢাকা দেওয়া এবং আদালতে মামলা পরিস্থিতি আরো জটিল করে। পরবর্তীতে নতুন নামে নতুন পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হলেও দখলে, দূষণে বিপর্যস্ত কর্ণফুলীর ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ে গতি আসেনি। নদী ভরাট হয়ে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। নদীর তলদেশে প্রায় বিশ ফুট পলিথিনের আস্তর। ড্রেজিংয়ের কাটার কাজ করতে পারছে না। ম্যানুয়ালি কাজ করতে গিয়ে সময় এবং অর্থ দুটোই বেশি খরচ হচ্ছে। তাই নতুন করে কাজ এবং সময় বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ১০০ কোটি টাকা বেড়ে যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা গতকাল আজাদীকে জানান, কর্ণফুলী নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের সময় পার হয়ে গেছে। আরো আগে এই কাজ শেষ করার প্রয়োজন থাকলেও নানা জটিলতায় তা হয়নি। তিনি বলেন, ১৯৯০ সালে কর্ণফুলীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং হয়েছিল। নিয়ম অনুযায়ী এর দশ বছর পর ২০০০ সালে পুনরায় ড্রেজিং করার কথা। ২০০৮ সালে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও কাজ শুরু হয়েছিল ২০১১ সালের ৫ জুলাই। ‘ক্যাপিটাল ড্রেজিং ও ব্যাংক প্রটেকশন’ নামের প্রায় ২৩০ কোটি টাকার ওই প্রকল্পটির কাজ পেয়েছিল মালয়েশিয়ার মেরিটাইম অ্যান্ড ড্রেজিং কর্পোরেশন। মালয়েশিয়ায় কোম্পানিটি স্থানীয় প্যাসিফিক মেরিন নামের একটি কোম্পানিকে নিজেদের সাব-কন্ট্রাক্ট দেয়। এতে ভাগ্য বিপর্যয় শুরু হয় কর্ণফুলীর। প্রতারণা ও দুর্নীতির মাধ্যমে বন্দরের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে গা ঢাকা দেয় মালয়েশিয়ার কোম্পানি এবং তাদের এদেশীয় এজেন্ট প্যাসিফিক মেরিন সার্ভিসেস। কাজ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। বন্দর কর্তৃপক্ষ চুক্তিটি বাতিল করে ২০১৪ সালের ১৩ জুলাই। এই নিয়ে শুরু হয় মামলা।
বর্তমানে ২৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘সদরঘাট টু বাকলিয়ার চর ড্রেজিং’ প্রকল্প নামে নতুন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। এই প্রকল্পের আওতায় সদরঘাট থেকে বাকলিয়ার চর পর্যন্ত প্রায় আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২৫০ মিটার চওড়া এলাকায় ড্রেজিং করার কথা। নৌবাহিনীর মাধ্যমে চীনা কোম্পানি ই-ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্পটির কাজ করছে। প্রকল্প এলাকা থেকে ৪২ লাখ ঘনমিটার মাটি ও বালি তোলার মাধ্যমে ড্রেজিং সম্পন্ন করা হবে। ড্রেজিং থেকে উত্তোলিত বালি ও মাটি বন্দরের হামিদচর এলাকা ভরাট করার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু পলিথিন জঞ্জালে কাজের গতি না থাকায় এক বছর ধরে কাজ করা হলেও প্রকল্পের কাজ ৩৫ শতাংশও শেষ হয়নি। নানারকম বর্জ্যের জন্য নদীর তলদেশের মাটি কাটা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ কাজ শুরুর আগে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছিল, এক বছরের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ হবে।
২৫৮ কোটি টাকার প্রকল্পটির মেয়াদ আগামী বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমানে প্রকল্পটির কাজ অর্ধেকও শেষ হয়নি। অপরদিকে নদী থেকে ৪২ লাখ ঘনমিটার মাটি ও বালি উত্তোলনের কথা থাকলেও এখন সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আরো অন্তত ৯ লাখ ঘনমিটার বাড়তি মাটি ও বালি উত্তোলন করা না হলে প্রকল্পের সুফল পুরোপুরি পাওয়া যাবে না।
এই অবস্থায় নতুন করে আরো ৯ লাখ ঘনফুট বাড়িয়ে মোট ৫১ লাখ ঘনমিটার মাটি ও বালি উত্তোলনের প্রস্তাব করা হয়েছে। নদীর তলদেশ থেকে ৯ লাখ ঘনমিটার বাড়তি বালি উত্তোলন করতে খরচ আরো ১০০ কোটি টাকা বাড়িয়ে প্রকল্প ব্যয় ৩৫৮ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই কাজের জন্য সময় ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের এই প্রস্তাব নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
মন্ত্রণালয়ে সম্প্রতি এ বিষয়ে বৈঠক হয়। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নৌ পরিবহন সচিব মেজবাহউদ্দিন চৌধুরী ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম এসে পৌঁছেছেন। আজ সকালে তিনি সরেজমিনে কর্ণফুলী নদী ভ্রমণ করবেন। এই সময় বন্দরের শীর্ষ কর্মকর্তারা তাঁর সাথে থাকবেন। পরিদর্শন শেষে সচিব বন্দর ভবনে বৈঠক করবেন। বৈঠকে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হবে। একই বৈঠকে নদী দখল এবং দূষণ নিয়েও আলোচনা হবে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক কমান্ডার মোহাম্মদ আরিফ গতকাল বলেন, বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে। কাজের পরিমাণ বাড়ার সাথে সময় এবং খরচ দুটোই বাড়ার সম্পর্ক রয়েছে। সবকিছু নিয়ে মন্ত্রণালয় থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।