করোনাকালীন সামাজিক দায়বদ্ধতায় বিকাশ

মহিউদ্দীন বাবর | সোমবার , ২৪ মে, ২০২১ at ৭:০২ পূর্বাহ্ণ

ব্যবসার উদ্দেশ্য শুধুই ব্যবসা হওয়া উচিৎ নয় -নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান এর মতো অনেকে হয়তো এ কথার সাথে একমত নাও হতে পারেন। কিন্তু কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যখন মুনাফার পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে জনকল্যাণমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং তা মানুষের বিশ্বাস অর্জন করে, তখন তা হয়ে যায় সমাজ এবং ব্যবসার জন্য দারুণ ইতিবাচক। দেশের শীর্ষস্থানীয় মোবাইল আর্থিক সেবা (এমএফএস) প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বিকাশ এর সামপ্রতিক কিছু উদ্যোগ দেখলে কথাটির সত্যতা উপলব্ধি করা যায়। প্রতিষ্ঠানটি ব্যবসা প্রসারের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ; যাদের অনেকেই হয়তো বিকাশের গ্রাহকও নয়, এমন সবার কল্যাণে অবদান রেখে চলেছে।
প্রথম যখন করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হ’ল, পুরো পৃথিবী এক অভূতপূর্ব এবং ভয়াবহ সংকটে পড়লো। সবার মনে আতঙ্ক, দুঃখ, হতাশার উদ্রেক করার পাশাপাশি এই মহামারী আমাদের জীবনব্যবস্থা এমনকি চিন্তাভাবনাকেও বদলে দিয়েছে। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো করোনা সংকট মোকাবেলা করতে লড়াই অব্যাহত রেখেছে এবং ‘নিউ নরমাল’ পরিস্থিতিতে নতুন সব চাহিদার সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করে চলেছে।
হঠাৎ করে বদলে যাওয়া এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য মানিয়ে চলাও ছিল একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। সীমিত স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী নিয়ে মহামারীর ধাক্কাটা সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছিলো, দরকার হয়ে পড়েছিল সব মহলের সহমর্মিতা এবং সহযোগিতা। এই সময়েই আর্থিক সেবা খাতের প্রতিষ্ঠান বিকাশ এগিয়ে আসে স্বাস্থ্যসেবায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে।
করোনা চিকিৎসা সহায়তায় দুই দফায় চীনের আলীবাবা ফাউন্ডেশন এবং জ্যাক মা ফাউন্ডেশনের দেয়া মোট ৩৫০টি ভেন্টিলেটর সহ থার্মোমিটার, মাস্ক, প্রোটেক্টিভ ক্লোদিং, মেডিকেল গগলস এর মত সাড়ে ৯ লক্ষ জরুরি স্বাস্থ্যসামগ্রী হস্তান্তর করে বিকাশ। এটিকে মহামারীকালীন কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বড় সামাজিক দায়বদ্ধতার উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে। দেশের স্বাস্থ্য খাতে অবদানের পাশাপাশি এটি সাধারণ মানুষের মনোবল বাড়াতেও সাহায্য করেছে।
এছাড়াও বিকাশ নিজ অর্থায়নে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা কার্যক্রমে আরো সক্ষমতা বাড়াতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা শিশু হাসপাতাল, ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) ও কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালকে ৩০টি ভেন্টিলেটর প্রদান করেছে এবং বারডেমের সহযোগী ডায়াবেটিক হাসপাতালে অক্সিজেন প্ল্যান্ট নির্মাণ করে দিয়েছে। এই উদ্যোগের ফলে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার পাশাপাশি হাসপাতালগুলোর সার্বিক চিকিৎসা সেবার পরিধিও বেড়েছে। সরকার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন হাসপাতাল এবং সম্মুখ সারিতে কর্মরত চিকিৎসক, নার্স এবং প্যারামেডিকদের জন্যও অত্যন্ত স্বস্তির কারণ ছিল বিকাশের এই সহায়তা। এই অনুদানগুলো কেবলমাত্র প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বশীল ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলনই নয়, বরং সাধারণ মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করার মানসিকতারও প্রতিফলন।
বিকাশ গত বছরের মার্চ মাসে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকেই দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে নীরবে কিন্তু সক্রিয়ভাবে কাজ করে গেছে। সবারই মনে থাকার কথা, মহামারীর প্রাথমিক পর্যায়ে দেশব্যাপী লকডাউন, চলাচলে সীমাবদ্ধতা, কর্মক্ষেত্রে ছাঁটাই এসব ছিলো সাধারণ ঘটনা যা জনমনে আতঙ্ক, হতাশা ও অনিশ্চয়তার জন্ম দিয়েছিল। তবে বিকাশ ঐ সময়ে সার্ভিস চার্জ বাবদ ২২ কোটি টাকারও বেশি ভর্তুকি দিয়ে গ্রাহকদের কিছুটা স্বস্তি দেয়ার চেষ্টা করে।
এক টাকায় আহার সহ দৃষ্টান্তমূলক সব দাতব্য কাজের জন্য সবার আস্থা ও প্রশংসা অর্জন করা প্রতিষ্ঠান বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনকে চট্টগ্রামে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করার জন্য অনুদান দেয় বিকাশ। করোনা মহামারীতে বিকাশের অবদান শুধু এতোটুকুতেই থেমে থাকেনি। সেনা কল্যাণ সংস্থার মাধ্যমে ৫ হাজার দরিদ্র পরিবারকে জরুরি খাদ্য সামগ্রী সরবরাহ করার পাশাপাশি আরো কিছু বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে স্বল্প আয়ের মানুষকে সহযোগিতা করেছে বিকাশ।
কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ে প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক প্রণোদনা ১৫ লক্ষ সুবিধাভোগীকে প্রেরণ করার দায়িত্ব পেয়ে সে অর্থ যথাসময়ে পৌঁছে দেয়াটাও ছিল বিকাশের একটি উল্লেখযোগ্য অবদান। এছাড়া, দ্রুততম সময়ে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের কাছে উপবৃত্তি পৌঁছে দেয়ার কাজও বিকাশ সফলতার সাথে করেছে। প্রণোদনা ও উপবৃত্তি প্রাপ্ত উপকারভোগীরা সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা ২ লক্ষ ৪০ হাজার এজেন্টের যে কারও কাছ থেকে ক্যাশ আউট করে নিতে পেরেছে যা শিক্ষার্থী তাদের অভিভাবক এবং উপকারভোগীদের জন্য ছিল বাড়তি স্বস্তির কারণ।
মহামারীর শুরুর দিকে যখন সবকিছু স্থবির হয়ে ছিল তখন বিকাশ দেশের ৯টি বাণিজ্যিক ব্যাংক হয়ে বিকাশ অ্যাকাউন্টে রেমিটেন্স আনার সুবিধা করে দেয় যা গ্রাহকের আস্থা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিকরা এ সঙ্কটকালে তাদের পরিবারের বিকাশ অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে পেরেছেন যা তাদের দিয়েছে অন্যরকম স্বস্তি ও নির্ভরতা। এদিকে দেশে থাকা রেমিটেন্স গ্রহীতারা তাৎক্ষণিকভাবে রেমিটেন্স পাওয়ায় এই অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যেও এটি তাদের মনোবল ও আত্মবিশ্বাসকে বাড়িয়ে তুলতে সহায়তা করেছিল।
করোনাকালীন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার এই সময়ে বিকাশ ডিজিটাল আর্থিক লেনদেন নিশ্চিত করার মাধ্যমে গ্রাহককে নিরাপদ রাখার জন্য সবসময় সচেষ্ট ছিল। এর একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হ’ল লকডাউনের সময় তৈরি পোশাক খাত এবং বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের ১০ লক্ষ শ্রমিককে সময়মতো বেতন এবং উৎসব ভাতা প্রদান করা। রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের মাঝে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রেও সফল হয় বিকাশ। সময় মতো প্রণোদনা পৌঁছে দেয়া খুব জরুরি ছিল কারণ সেসময় বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য প্রায় অচল হয়ে যাওয়ার আর্থিক চাপে ছিলো এই খাতটি। বিকাশ এর মাধ্যমে সুবিধাভোগীরা তাৎক্ষণিকভাবে, সহজে এবং নিরাপদে প্রণোদনা পেয়ে যায়। ফলে নগদবিহীন লেনদেনের দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়।
মহামারীর মধ্যে মানুষকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে সহায়তা করার জন্য বিকাশ তার বিস্তৃত অ্যাড মানি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে গ্রাহকদের মোবাইল অ্যাকাউন্টে তাদের ব্যাংক এবং কার্ড থেকে টাকা আনার সুযোগ করে দেয়। নিরলস প্রচেষ্টায় এই মুহূর্তে দেশের ২৪ টি শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকের গ্রাহকরা এখন তাদের বিকাশ অ্যাকাউন্টে যেকোনো সময় সহজেই টাকা আনতে পারেন। গ্রাহকরা ভিসা এবং মাস্টারকার্ড থেকেও অ্যাড মানি করতে পারেন।
‘পে বিল’ হ’ল বিকাশের এমন আরও একটি সেবা যেখানে ব্যাপকভাবে কাজ করা হয়েছে। মহামারী চলাকালীন ঘরে থাকার সময় বিকাশের উপর গ্রাহকদের নির্ভরতা বেড়েছে কারণ তারা সব ধরণের ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করার জন্য একটি স্মার্ট উপায় খুঁজছিলো। বর্তমানে ডেসকো, ডিপিডিসি, বিপিডিবি, নেসকো, পল্লী বিদ্যুৎ সহ সমস্ত বিদ্যুতের বিল বিকাশের মাধ্যমে পরিশোধ করা যায়।
বিদ্যুতের পাশাপাশি অন্যান্য ইউটিলিটি সেবা যেমন পানি, গ্যাস, ইন্টারনেট, টেলিফোন, কেবল এবং ডিটিএইচ টিভি’র বিলও পরিশোধ করা যায় বিকাশের মাধ্যমে যা গ্রাহকদের করোনা সংক্রমনের সময় ঘরে থাকতে সহায়তা করেছে। এই মুহূর্তে তিতাস গ্যাস, জালালাবাদ গ্যাস, ওয়াসা, বিটিসিএল, সিলেট সিটি কর্পোরেশন ইত্যাদির বিল পরিশোধ করা যায় বিকাশে। তিতাস গ্যাস, ওয়াসার পানির বিল পরিশোধ এর মতো সেবাগুলো করোনাকালীন সময়েই যুক্ত হয়েছে বিকাশের প্ল্যাটফর্মে।
কোভিড দুর্যোগকালীন সময়ে দেশের মানুষের কল্যাণে অসামান্য অবদান রাখা এবং আর্থিক লেনদেন স্বাভাবিক রাখতে নিরবচ্ছিন্ন সেবা নিশ্চিত করা সহ নানা সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) কর্মসূচি গ্রহণ করার স্বীকৃতি হিসেবে সমপ্রতি “বেস্ট ই-ক্যাশ/মানি অ্যান্ড সিএসআর অ্যাওয়ার্ড” পেয়েছেন বিকাশ এর চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার (সিইও) কামাল কাদীর।
দেশজুড়ে মোবাইল আর্থিক সেবা খাতে একটি বিশাল নেটওয়ার্ক তৈরির মাধ্যমে বিকাশ ঘরে ঘরে থাকা নির্ভরতার আরেক নাম। অনেক দিন থেকেই মানুষ “টাকা পাঠাও” না বলে “বিকাশ করো” বলে। মহামারীর সময়ে জরুরি ভেন্টিলেটর ও চিকিৎসা সামগ্রীগুলো প্রদান করার এই উদ্যোগ সকলের কাছেই প্রশংসিত হয়েছে। পাশাপাশি অনেক সমস্যার সহজ সমাধান দিয়ে দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে বিকাশ।
লেখক : ফ্রিল্যান্স লেখক ও সিএসআর কনসালট্যান্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমার ছোটবেলার খেলাগুলো
পরবর্তী নিবন্ধবহমান সময়