করুণ ক্যাসিনো

যেন এক ফুটন্ত ফুলের শোভা

মোহছেনা ঝর্ণা | শুক্রবার , ২৪ মে, ২০২৪ at ৬:৫৯ পূর্বাহ্ণ

কথাসাহিত্যিক পাপড়ি রহমানের গল্প পড়ে কিছুক্ষণ বিভোর থাকি আমি শব্দের মায়াবী খেলায়। উপমার নিপুণ কারুকার্যে তাঁর গল্প স্পর্শ করে যায় মনের ভেতরটা। যে কারণে গল্প পড়ে শেষ করে ফেললেও কিছু শব্দ, কিছু বাক্য হাঁটাহাঁটি করে অবিরত মনের বারান্দায়। সেই কবে কোনো এক গল্পে পড়েছিলাম “জুঁই ফুলের মতো সাদা ভাত”, এখনো সরু চালের ভাত খেতে গেলে আমার এই উপমাটা মনে পড়ে যায়।

জলধি থেকে প্রকাশিত পাপড়ি রহমানের গল্পগ্রন্থ “করুণ ক্যাসিনো”র গল্পগুলো পড়ার পর আবার সেই বিভোরতায় আচ্ছন্ন হয়েছি। তিনি যেন গল্প বলেন না, গল্পের চরিত্রগুলোকে কেমন করে রক্তেমাংসে গড়ে তোলেন। সেই চরিত্রগুলোর কেউ কেউ হয়ে ওঠে আমাদের স্বজন, পরিচিতজন। তাদের অতি সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম আনন্দবেদনাগুলোও হয়ে ওঠে আমাদের আনন্দবেদনা। পাপড়ি রহমানের গল্প খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তে হয়। না হলে বাক্যের বুননের সৌন্দর্য হাত ফসকে যায়। কখনো কখনো এমনও হয় একই বাক্য কয়েকবার পড়তে ইচ্ছে করে।

নদীর যে দিকটা কচুরির ঠেকে সবুজবেগুনি হয়ে আছে, জলিলের নেশা ওই দিকেই। অথচ খলিল কিনা পারতপক্ষে দামের জঙ্গলে ঢুকতে চায় না। দামের জঙ্গলে নাও একবার ঢুকে পড়লে তাকে নানান ব্যারাচ্যারা পোহাতে হয়। তুমি যতই জল কেটে, পানা তুলে পথ করো না কেন ভুলভুলাইয়ার ভেতর তোমাকে পড়তে হবে।” পাপড়ি রহমানের গল্পগ্রন্থ “করুণ ক্যাসিনো”র প্রথম গল্প “গাঙকলা ও জোয়ারের সংহরণ”এর প্রথম কয়েকটি লাইন পড়ে ভেতরে প্রবেশের ইচ্ছে কোন পাঠকের না হবে? খলিল, জলিল দুই ভাইকে নিয়ে তাদের মা রসুমতির সংসারে খলিলের বউ হয়ে শনতারার প্রবেশ। নামটা কী সুন্দর! শনতারা। তারপর একদিন দুম করে শনতারার হারিয়ে যাওয়া। কিন্তু এর ভেতরই গল্পকারের ভাষা শৈলী গুণে অনবদ্য পাঠ হয়ে যায় পাঠকের। টাগইয়ের ফুল, আজদহা সাপ, গাঙকলা, বেভারসহ কত গ্রামীণ নাম, যেগুলোর অনেকটাই যেন ভুলতে বসেছি। শনতারার হারিয়ে যাওয়ার কারণটার কোনো কূল কিনারা করতে পারিনি। আচ্ছা, জলিলের কোনো ভূমিকা নেই তো! বিছানার উপর ছড়িয়ে থাকা বেগুনি আর হলদে ফোঁটা কচুরিপানার ফুলের স্তূপ দেখে খলিলের দৃষ্টি কেন ঘুরপাক খায়? গল্প শেষ হয়ে যায় কিন্তু গল্পের ঘোর থেকে পাঠক বের হতে পারে না।

হলুদ ফুলের বিকেল” গল্পে ক্ষীণদৃষ্টি শক্তিসম্পন্ন নয়নের জীবনের ইতিবৃত্ত যেন আমাদের গ্রামীণ পটভূমির চিরায়ত রূপ। রূপের কিছু কমতি হলেই রেহাই নেই। আর সেখানে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সহজভাবে মেনে নেবে এমন সহজ মানুষ বিরল। তাই তো সাত্তার মিয়ার অবহেলা অনাদরে নিজের সংসার তবু সাজিয়ে নেয় নিজের মতো করে। কিন্তু বয়সের ভারে চোখের আলোর ঘাটতি মেনে নিবে কেন পুত্রবধূ আঁখি! “নিজের মাওডা যে আন্ধা সেইটা আমারে আগে বলে নাই! এই কানা বেটিরে আমি কি সারাজীবন টাইন্যা যাব নাকি?” আঁখির মুখ দিয়ে লেখক কিন্তু সমাজ সংসারের চলমান রূপটাই উন্মোচন করেছেন মাত্র। আর তাই তো নয়নের শেষ পরিণতিটা এত ভয়াবহ সত্ত্বেও খুব বেশি অনাকাঙ্‌ক্িষত মনে হয়নি। নয়নের প্রায়ান্ধ চোখজোড়া চন্দ্রবোড়া সাপটাকে হয়তো কোনো হলদে ফুল ভেবে ভুল করেছিল! এই একটি বাক্য দিয়েই নিয়তির পরিহাসকে কেমন তাচ্ছিল্য করলেন লেখক!

সাত্তার মিয়ার শাহনজর এর সময় নয়নকে নিয়ে লেখকের বর্ণনাটুকুর কী শোভা উল্লেখ না করে পারা গেলো না। “উজ্জ্বল আয়নার চারকোনা ফ্রেমের ভেতর নয়নের গোলগাল মুখটা ফুটন্ত শাপলার মতো স্থির ছিল। তার ক্ষুদ্রাকৃতি কপালের উপর টায়রাটিকলির ঝালর তিরতিরিয়ে দুলছিল, যেনবা ঢেউ এসে নাড়িয়ে দিচ্ছিল ফুটন্ত ফুলের শোভা।”

হাওয়াকলের গাড়ি” গল্পটা খুব যন্ত্রণা দিয়েছে আমাকে। ছোট্ট তোজাম্মেল আমার মনোজগতে বিচরণ করেছে দীর্ঘ সময়। খুলনার টুটপাড়ার রাকিবের মুখটা শুধু ভাসছিল চোখের সামনে। ছোট্ট তোজাম্মেলের কেন এত খিদা লাগে ইব্রাহীম মোটরস এর মালিকের তো তা বোঝার দরকার নেই। তাকে রিকশার চাক্কায় হাওয়া ভরার হিসেব বুঝতে হবে। ছোট্ট তোজাম্মেল এর খিদার হিসাব বুঝলে তো তার হবে না। তা না হলে ইব্রাহীম মিয়া কেন এত নির্দয় হয়। সে তো চাইলে তোজাম্মেলকে চাকরি থেকে বের করে দিতে পারতো! আহ্‌! জীবন। তোজাম্মেলের বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। একটু পানি! বলেশ্বরের জল ছাড়া তার এই তৃষ্ণা মিটবে না। গল্পকার কেমন করে যেন ছোট্ট তোজাম্মেলের মনটা স্পর্শ করে গেলেন। সেই সাথে স্পর্শ করলেন পাঠকমনও।

ইতিহাস মিশ্রিত গল্প “উড়ন্ত গিরিবাজের ইন্দ্রজাল” কিছুটা সময় নিয়ে পড়তে হলো। আখসিকেল্লার পোড়ামাটির ছাদের রূপটা কী দারুণ করে তুলে ধরলেন লেখক। “রোদ্দুরের উত্তাপ ক্ষীণ হওয়া মাত্রই পোড়ামাটি ফের রঙ বদলে ফেলে। তখন তাকে দেখায় কোনো প্রাচীন পুকুরে জমাটবাঁধা শ্যাওলার মতো।” আহ্‌! বাক্যের বুননে কিছুক্ষণ বুঁদ হয়ে থাকি আমি।

এই বইয়ের ভিন্ন স্বাদের গল্প বলা যায় “বনভূমি ও ঝিরির সংহরণ” গল্পটিকে। বনভূমিতে বেড়াতে আসা দম্পতির নারীটির সাথে বাঘরোলের কথোপকথন, ভাবের আদানপ্রদানের মাধ্যমে লেখক কিন্তু অনেক গভীর কথা বলেছেন। কিন্তু বলার ভঙ্গিটা এত রসময় ছিল যে খুব মজা নিয়েই পড়েছি। বাঘরোলটাকে ভালোবেসে ফেললাম। বাবুদের মতো সঙ্গীর চেয়ে বাঘরোল অনেক বেশি বিশ্বস্ত। অনেক বেশি আপন। জীবন কী আর এমন গল্পের মতো পরাবাস্তব ভালোবাসায় পূর্ণ হয়! তবু গল্পের মায়া অনেকটা সময় ঘিরে রাখে এই বা কম কি!

করুণ ক্যাসিনো” বইয়ে আমি “করুণ ক্যাসিনো” নামে গল্পটা খুঁজছিলাম। কিন্তু বইয়ের সবগুলো গল্প পড়ে মনে হলো আলাদা গল্পের দরকার কি! সবগুলো গল্পের সুর মিলিয়েই তো এই করুণ ক্যাসিনো। শিল্পী রাজীব দত্তের নান্দনিক প্রচ্ছদে জলধি থেকে প্রকাশিত “করুণ ক্যাসিনো” দেখতেও বেশ নান্দনিক।

কথাসাহিত্যিক পাপড়ি রহমানের গল্পের স্বতন্ত্র স্বর আছে। এই স্বতন্ত্র স্বতঃস্ফূর্ত স্বরে তিনি আরও অনেক অনেক গল্প উপহার দেবেন আমাদের, এটাই প্রত্যাশা। পাপড়ি রহমানের জন্য শুভকামনা। বইটির প্রকাশ করেছে জলধি প্রকাশনী আর প্রচ্ছদ করেছেন রাজীব দত্ত।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবায়েজীদ বোস্তামি (র.) দরগাহ মসজিদের সংস্কারের দায়িত্ব পেলেন মনজুর আলম
পরবর্তী নিবন্ধঅরণ্যের গান: বাঘের পায়ের ছাপ খেয়ে ফেলবে পুরো বাঘটাকে