কবি বিপিন বিহারী নন্দী

নেছার আহমদ | মঙ্গলবার , ১৬ নভেম্বর, ২০২১ at ৬:১৫ পূর্বাহ্ণ

বীর চট্টলা নামে খ্যাত চট্টগ্রামের পটিয়াকে বলা হয় ব্রিটিশ বিরোধ আন্দোলনের সূতিকাগার। ঐতিহাসিক পটিয়ার চক্রশালা ইতিহাসের প্রাচীনতম বিখ্যাত শহরের মধ্যে অন্যতম। প্রাচীন ও মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে পটিয়ার নাম ইতিহাসে আলোকোজ্জ্বল। চট্টল গবেষক ও ইতিহাসবিদ শ্রী পুর্ণচন্দ্র দেব ব্রহ্মণ পটিয়াকে দেড় হাজার বছরের প্রাচীনতম শহর হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আমাদের প্রাচীন সাহিত্যের ইতিহাসে যে সকল ব্যক্তিত্ব সমগ্র ভারতবর্ষকে আলোকিত করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম কবি বিপিন বিহারী নন্দী। সাহিত্য, সংস্কৃতি, কবিতা ও দেশ উন্নয়নমূলক কাজে অভূতপূর্ব ভূমিকা রেখে ইতিহাসে লাভ করেছেন অমরত্ব।
ক্ষণজন্মা মহান কবি বিপিন বিহারী নন্দী পটিয়ার জঙ্গলখাইন গ্রামে ১৮৭০ এর ২৫ জানুয়ারী জন্মগ্রহণ করেন। পিতা অখিল চন্দ্র নন্দী, মাতা মনোরমা দেবী। প্রাচীন কায়স্থ পরিবারের সন্তান বিপিন বিহারী নন্দী বঙ্গীয় প্রাচীন সংস্কৃতির কবি সন্ধ্যাকর নন্দীর বংশধর। সে হিসেবে পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে নিজেকে গড়ে তুলেছেন একজন সংস্কৃতিক মনস্ক মানুষ হিসেবে।
শিক্ষাজীবনে কেশব ভারতী প্রাইমারী স্কুল, পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম কলেজে লেখাপড়া করেন। পরবর্তীতে কলকাতা হতে এফ.এ (ফার্স্ট আর্টস, বর্তমানে এইচ.এস.সি) পড়তে যান। কলকাতা হতে আইন পরীক্ষা দিয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। সে সময়কালে এফ.এ পাশ করে আইন বিষয়ে লেখাপড়া করা যেত। তাকে কমিটি (আইনের কমিটি) পাশ বলা হয়। পরবর্তীতে বি.এ এবং আইন শাস্ত্রে বি.এল ডিগ্রি লাভ করেন।
বিপিন বিহারী অসম্ভব ও অসাধারণ কবি প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। সেই প্রতিভা ধর্মীয় খাতেই বেশি প্রবাহিত হয়। যার কারণে দেখা যায় তাঁর প্রতিটি কাব্যগ্রন্থ্‌ ধর্মাশ্রয়ী।
১৯০৬ সালে তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ এর সদস্য পদ লাভ করেন। ১৯১০ সালে পটিয়ায় আদালত প্রতিষ্ঠা হলে বিপিন বিহারী নন্দী এ আদালতে উকালতি পেশা শুরু করেন। এলাকার মানুষকে তিনি আইনী সহায়তা প্রদান করে জনসাধারণের মাঝে অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ১৯১১ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ চট্টগ্রাম শাখা প্রতিষ্ঠা হয়। তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ চট্টগ্রাম শাখার প্রতিষ্ঠাতা অন্যতম সদস্য। সে সময়কালে তাঁর মাধ্যমে চট্টগ্রাম ও কলকাতার সাহিত্যিকদের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন তৈরি হয়। বিপিন বিহারীর সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড এবং বক্তিগত যোগাযোগের কারণে চট্টগ্রামের চক্রশালায় সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সাহিত্য সভায় তিনি সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সম্মেলনে কলকাতা ও বাংলাদেশের ৭০ জন কবি সাহিত্যিক অংশ নেন।
১৯১৮ ইংরেজী ১৩২৫ বাংলা সনে নোয়াপাড়ায় কবি নবীন চন্দ্র সেনের শ্মশানের নিকটে চট্টগ্রাম সাহিত্য পরিষদের বার্ষিক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সে অধিবেশনেও কবি বিপিন বিহারী নন্দী সভাপতিত্ব করেন। সভাপতির অভিভাষণটি ‘সাধনা’ পত্রিকায় আশ্বিন ও কার্তিক ১৩২৭ বাংলা ১৯২০ সালে প্রকাশিত হয়। ১৩২৭ বাংলা ১৯২০ ইংরেজিতে গোমদণ্ডী শ্রীপঞ্চমী লাইব্রেরীর অধিবেশনে তিনি সভাপতিত্ব করেন। সভাপতির অভিভাষণে বিপিন নন্দী গ্রামে গ্রামে গ্রন্থাগার স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে অভিমত ব্যক্ত করেন যা সমগ্র বাংলায় প্রশংসিত হয়। অসাধারণ মেধাবী ও উচ্চমানের কবি ছিলেন তিনি। রামায়ণ, মহাভারত, মনসামঙ্গল প্রভৃতি পুরাণ গ্রন্থই তাঁর কাব্য প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করেছে।
কবির পূর্বপুরুষ কবি সন্ধ্যাকার নন্দী রামচরিত প্রণয়ন করেছিলেন। বিপিন নন্দীর কাব্যে! তাই পূর্বপুরুষের ধারাবাহিকতা লক্ষ্যণীয়। কবি বিপিন বিহারী নন্দী অনেক কাব্য গ্রন্থ এবং প্রচুর প্রবন্ধ ও কবিতা রচনা করেন। তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য গ্রন্থ ‘সপ্তকাণ্ড রাজস্থান’ পটিয়া থেকে বিপিন বিহারী নন্দী কর্তৃক প্রকাশিত হয়। রাজপুতদের বীরত্বগাথা নিয়ে কাব্যটি রচিত হয়। তাঁর এ কাব্যের জন্য উদয়পুরের মহারাণী তাঁকে ‘রাজস্থান কী কৃত্তিবাস’ উপাধীতে ভূষিত করেন। তাঁর রচিত “চন্দ্রধর” প্রাচীণ ভারতীয় সংস্কৃতির পরিচিতিমূলক কাব্য। ‘অর্ঘ্য’ গীতিকাব্যটি চারটি অঞ্জলিতে বিভক্ত। তাঁর ‘শিখ’ কাব্যটি শিখদের গুরু- গুরু গোবিন্দ সিং এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দের বীরত্বগাথা ও শক্তিমূলক একটি দৃশ্য কাব্য। প্রধানত, রাজপুত রমনীদের আত্মত্যাগ নিয়ে রচিত তাঁর অপর দৃশ্যকাব্য ‘নারী’। তাঁর আরেকটি কাব্যগ্রন্থ ‘চন্দ্র’। কবি বিপিন বিহারী নন্দীর অর্ধসমাপ্ত কাব্য ‘পার্থ’।
১৯১২-১৩ সালে চট্টগ্রাম ধর্মমণ্ডলীর বার্ষিক অধিবেশনে কবির পঠিত দীর্ঘ মূল্যবান প্রবন্ধ ‘কঃ পন্থা’ ‘গৃহস্থ’ পত্রিকায় ১৩২০ বাংলার আশ্বিন ১৯১৩ ইংরেজীর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। ১৩২১ বাংলা ১৯১৪ ইংরেজীতে ‘তপোবন’ পত্রিকায় তাঁর রচিত ‘আবাসের পত্র’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। ১৩২৭ বাংলা ১৯২০ ইংরেজীতে গোমদণ্ডী শ্রীপঞ্জমী লাইব্রেরীর অধিবেশনে সভাপতির অভিভাষণটি ‘পল্লী সেবা” শিরোনামে ‘সাধনা’ পত্রিকায় (মাঘ-১৩২৭ বাংলা, ১৯২০ ইং) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
বিপিন বিহারী নন্দীর রচনাবলী ‘নভ্য’ ‘ভারত’, ‘ভারতী’, ‘বান্ধব’, ‘নবনূর’, ‘প্রবাস’ী, ‘বসুমতি’ প্রভৃতি সে সময়কালের পত্রপত্রিকায় উচ্চশিত প্রশংসা পায়।
কবি নবীনচন্দ্র সেন, কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, জাস্টিস গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রাবন্ধিক ও বৈজ্ঞানিক রামেন্দ্র সুন্দর ত্রিবেদী, সাহিত্য সমালোচক ডঃ দীনেশ চন্দ্র সেন, বিশ্বকোষ সম্পাদক নগেন্দ্র নাথ বসু প্রভৃতি বিজ্ঞজন বিপিন বিহারী নন্দীর কাব্য প্রতিভার উচ্চ প্রশংসা করেছেন। তাঁদের মতে, স্বদেশী ভাবধারায় অনুপ্রাণিত কবির বিপ্লবী আদর্শের প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর কাব্য সমূহে।
কবি জাতীয় জাগরণের প্রয়োজনীতায় বিশ্বকর্মী ছিলেন, যা তাঁর ‘শিখ’ কাব্যগন্থের মধ্যে পরিচয় পাওয়া যায়। বিপিন নন্দীর রচনাবলীতে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটেছে বলে কাব্য সমালোচকরা মনে করেন। তাঁর কাব্য ‘সপ্তকাণ্ড রাজস্থান’ এর মাধ্যমে তাঁর কাব্য খ্যাতি সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি এ কাব্যের জন্য ‘কবি শেখর’ উপাধিতে ভূষিত হন। এছাড়াও তিনি রাজপুতনা থেকে ‘রাজস্থান বা কৃত্তিবাস’ উপাধিতে ভূষিত হয়। তিনি বিদ্যাবিনোদ উপাধিও লাভ করেন। যা সমসাময়িক কাব্য চর্চার ক্ষেত্রে অনন্য সম্মান হিসেবে বিবেচিত।
কবি বিপিন বিহারী নন্দীর সাহিত্য সাধনাকে এবং এক্ষেত্রে তাঁর অসমান্য অবদানকে সে সময়কালে সমগ্র ভারতে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হতো। তাঁর প্রকাশিত পুস্তুকাদি সমগ্র ভারতে প্রসিদ্ধি লাভ করে। সাহিত্য সাধনায় অসামান্য অবদানকে মূল্যায়ণ করে চট্টগ্রাম আদালত থেকে বিপিন বিহারী নন্দীকে ‘ব্যবহারজীবী বৃত্তি’ প্রদান করা হয়। নিখিল ভারত সাহিত্য সভা কর্তৃক কাব্যবিনোদ ‘বিদ্যাভূষণ সাহিত্য সরস্বতী’ উপাধিও প্রদান করা হয়।
সে সময়কালে তাঁর এলাকায় শিক্ষা বিস্তারে তিনি কাজ করেছেন। তিনি তাঁর নিজ এলাকায় একটি প্রাইমারী স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময়কালে বিপিন বিহারী নন্দী ও শশাঙ্ক মোহন সেন সহপাঠী ও আবাল্য সুহৃদ ছিলেন। তাঁদের বন্ধুত্ব ছিল খুবই গভীর ও আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ। কবি বিপিন বিহারী নন্দী বয়াতী দেবীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। জঙ্গলখাইনের নন্দী বাড়ির প্রাচীন বিশাল মন্দিরের পাশে পারিবারিক শ্মশান। এতে দুটো সমাধি রয়েছে। একটি কবি বিপিন বিহারী নন্দীর অপরটি তাঁর পিতা অখিল চন্দ্র নন্দীর।
কবিতা ছাড়াও সাহিত্য সংস্কৃতি ও অনুবাদক হিসেবে সমগ্র ভারতে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। সমাজ উন্নয়ন, দেশপ্রেমিক ও মানবতার কবি ও সাহিত্যিক বিপিন বিহারী নন্দী, ১৯৩৭ এর ২১ জুলাই নিজ গ্রাম জঙ্গলখাইনে ইহলোক ত্যাগ করেন।
১৯৩৭ সালে অনুষ্ঠিত পূরবী সাহিত্য সম্মেলনে কবি বিপিন বিহারী নন্দীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করা হয়। ১৯৩৮ সালে কবির নিজ গ্রামে প্রয়াত কবির মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষ্যে স্মৃতি সভা সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয়। সেই স্মৃতি সভায় সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপন যোগেশ চন্দ্র সিংহ। আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ, আশুতোষ চৌধুরী প্রমূখ স্বনামধন্য সাহিত্যিকেরা কবির স্মৃতিচারণ পূর্বক সাহিত্যর্কীতি নিয়ে জ্ঞানগর্ব আলোচনা করেন।
দুঃখজনক হলেও সত্যি এই যে, ক্ষণজন্মা মহান কবি এবং উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান কবিসহ ইতিহাসের সোনালী অধ্যায়গুলোকে আমরা ভুলতে বসেছি।
আজকে প্রজন্মের নিকট কবি সাহিত্যিক বিপিন বিহারী নন্দীকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমাদের হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্যকে স্মরণ রাখা এখন খুবই প্রয়োজন আমাদের জন্য এবং প্রজন্মের জন্য।
সূত্র : ১। সংসদ বাংলা চরিতাভিধান কলকাতা। ২। বাংলা একাডেমি চরিতাভিধান। ৩। সুনীতি ভূষণ কানুনগো সম্পাদিত ‘চট্টগ্রাম চরিতাবিধান’।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সম্পাদক-শিল্পশৈলী

পূর্ববর্তী নিবন্ধএ ভোগান্তির শেষ কোথায়?
পরবর্তী নিবন্ধপৃথিবী কি পারবে নবজাতকের বাসযোগ্য হতে!