কবি ও কবিতা : স্বাপ্নিক উদ্বোধনের ভিন্ন নাম

রিজোয়ান মাহমুদ | শুক্রবার , ৩০ অক্টোবর, ২০২০ at ৭:০৫ পূর্বাহ্ণ

কবি চূড়ান্ত এক মানবিক সত্তা। সন্ত ও দরবেশের মতো যার নির্নিমেষ দৃষ্টিভঙ্গি। যার দেখার ইচ্ছা এবং সংবেদী অনুভব আছে। সবার অলক্ষে নিজের ভেতর ভিন্ন একটি স্কুল তৈরির ক্ষমতা আছে যার। আবার তিনি সেই কবি যিনি জগতের সমস্ত প্রকার নশ্বরতার বিপক্ষে সটান দাঁড়াতে পারেন। পাহাড়ের খুব উচুতে ওঠে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণায় যার শরীর বিন্দুবৎ কাঁপেনা অথচ পরিপার্শ্ব সমাজ কেঁপে ওঠে।
প্রচলিত যে জীবন ব্যবস্থা তার বিপক্ষে ক’জনইবা দাঁড়াতে পারেন একমাত্র প্রকৃত কবি ছাড়া! কবিতা অনুভূতির তীক্ষ্ম সংশ্লেষ এবং সংবেদনশীলতার সর্বোচ্চ রঙ। সে কারণে কবিতা প্রাত্যহিক জীবনের ভাষা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অথচ সাধারণ মানুষের মতো কবিও সেই সাধারণ সমাজে বসবাস করেন। কিন্তু সমাজের প্রচলিত অনুশাসন তাকে বশ করতে পারে না। সমাজ – রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে থেকেও কবি আলাদা হয়ে ওঠেন স্বভাব চরিত্রে। কবি সর্বদা বোঝা না বোঝার দোলাচালে সাধারণের চোখে থাকেন অধরা। স্পর্শহীনতা, বিগলিত ভাবাবেগ এবং চূড়ান্ত দহন তাকে অন্য দশজন থেকে ক্রমশঃ পৃথক করে তোলে। কবি ধারণ করেন ভিন্ন জীবন প্রবাহ। সৃষ্টির উন্মাদনায় কবি নিজেকে লীন করে দিতে পারেন। মুদ্রিত ভাষ্য থেকে কবির অনুভূতি রচিত হতে থাকে। এই অনুভূতির নাভিকূপ সমাজের বীজ চারা। পর্যায়ক্রমে সমাজ থেকে উপাদান সংগ্রহ করে নতুন এক অনুষঙ্গের জন্ম দেয়া কবির কাজ। মানুষের মনোজগৎ খুবই জটিল। এই দুর্বোধ্য জটিল গ্রন্থি উন্মোচন করে কবি মোক্ষ লাভ করেন। অসম্ভব দুর্মদ প্রাণশক্তি নিয়ে উজ্জীবিত করেন যাবতীয় মানবানুভূতি। যে ভাষার ভেতরে কবির বাস সে ভাষার অনুবাদে কবি ছড়িয়ে পড়েন এক বিশ্ব থেকে অন্য মানববিশ্বে।
কবি ধ্বনিত করেন সময় সমাজ রাষ্ট্র এবং অন্তস্থলে বেড়ে ওঠা স্রোতের দহন, যা তার নিজের। এই উদযাপন সমাজ ও জনগোষ্ঠীর আশা – আকাঙ্‌ক্ষার চরিত্রায়ন। স্বপ্নের নৈনিতালে একটি বিন্দুতে এসে সিন্ধু হয়ে ঢেউ ওঠা কবির কাজের মহার্ঘ্য অংশ। কবি সবুজ ও নীল রঙের সাঁতারু স্রোতের বিপক্ষে। শব্দের সম্রাট কবি প্রাত্যহিক মানবিক দর্শনের ভেতরে আগাতে চান। কবিতা অনেকটা এ- ভাবে সুন্দর সুস্নাত রবির শুভেচ্ছাদূত। এবং আচ্ছন্ন হতে থাকে ব্যাকুল উচ্ছ্বাসে। কোথা থেকে ঝড় ওঠে সব তছনছ করে দেওয়া, কোথা সে বিকলাঙ্গ শান্তি, কবি তা খোঁজেন কেন!? কেন তার এতো গরজ ; এই জিজ্ঞাসা ও প্রশ্নাকুল অধিবিদ্যা থেকে মূলত কবিতার জন্ম বলে, মানছি। অথচ তার সব অনুষঙ্গ সমাজ ও প্রকৃতির মধ্যেই প্রতিদিন আবর্তিত।
আমাদের কবিতা আগাগোড়া ইউরোপ শাসিত এক অভিজ্ঞান। সেখানে আয়ুস্মান হওয়া বিভিন্ন আর্ট ও শিল্প ভিত্তিক আন্দোলনের ঘাতপ্রতিঘাত আমাদের মনোজগতে প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে দীর্ঘদিন। এই উপনিবেশিকতার লালনে আমাদের সহজিয়া, নাদীভর্তি মানুষ লোকজ সংস্কৃতি ইতিহাস এবং আমাদের নিজস্ব যে চারণভূমি তা উপেক্ষিত হয়েছে।
কবিতা ইউরোপীয় ঘাটে তরী ভিড়িয়ে জটিল সম্পাদ্যে অনুবর্তীত হয়েছে। আমাদের সবকিছু থাকা সত্ত্বেও আমরা হাস্যসুখে দাস্যসুখ মেনে নিয়েছি। এখানেই আমাদের ব্যর্থতা। প্রদাহ নিয়ে কবিতার সোরাইয়াসিস ফাংগাস এ-খান থেকেই শুরু। কাঠিন্য নিয়ে একটি জাতির চরিত্র বোঝা যায় না। প্রতিনিয়ত সংগ্রাম মুখর একটা জাতির পিঠের ওপর আরোপিত শ্বাস শবানুগমনের মতো। শব্দের লাশ নিয়ে আমরা দৌড়াচ্ছি প্রতিদিন। অথচ কবরের মাটি নেই। কিংবা আমাদের মাটি সেসব লাশের জন্য অধিকার ছাড়ছেনা।
আমরা আধুনিকতার দীক্ষা নিয়েছি হুবুহু পশ্চিমাদের ডায়াসে। একটি মনোকলোনি তৈরি করে আমাদের মধ্যে মূল্যবোধহীনতার চর্চা এসেছে। এটি পশ্চিমাদের খুশি করার উপলক্ষ্য মাত্র। ফলে, অর্থনৈতিক সামাজিক এবং রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের মতো সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্বও মেনে নিতে হয়েছে।
আশির কবিতার একাংশ যে দেশজ অনুভব্য প্রণোদনায় সামনে দিকে এগিয়েছিল তারই অনুসরণীয় লক্ষ্য যোগ্যতায় নব্বইয়ের কবিতা প্রলম্বিত হয়েছে ভিন্ন বাতাবরণে। যে শৃঙ্খলা ও যুক্তিবোধ তৈরি হয়েছে মাটিও মানুষের আশাভরীতে, তাতে দেখতে পেয়েছি গ্রাম, মাঠের কৃষক, ধানিজমি, ইতিহাস ঐতিহ্য লোকজ বিশ্বাস।
কবিতা হয়েছে সুবোধ্য সরল ভাষা প্রয়োগে। বিষয়ে এসেছে খুব কাছে থেকে দেখা অনুষঙ্গের সৃষ্ট চারুতা। এটিকে কাব্য নিরীক্ষাও বলা চলে। শুধু চমকের পর চমক, প্রতিটি লাইনে কিছু ম্যাজিক নয়। অন্তর্গত কাব্য স্বভাবে এসেছে ভারতবর্ষের বিবিধ মিথ কথন, রূপকের আড়ালে তৈরি হয়েছে গভীর জীবনবোধ। বিষয় বৈচিত্র্যে জীবনের পাঠ হয়েছে প্রভূত পরিমাণে ;
আহা! সাগর, একদিন হারালে তুমি আপন কক্ষপথ
এখন তোমার গর্ভাগারে ভাগাড় নিস্তব্ধতা।
-শাহীন মাহমুদ

তাকিয়েছি কতবার অনেক – অনেক দূরের মনন – শেকড়
পিতার বয়সী নাকি? প্রাচীন পাথর ভুলে ইতিহাস খুঁজি
আলোক প্রতিবেশী চম্পকনগরে দেখে দোয়েলের রঙ
হয়তো শোকের পাখি নির্দয় ফাগুনে পাবে কমলার মন
-শাহীদ হাসান

জগতের প্রাণী মরণ জাগিয়ে তোলে
সেই থেকে মানুষেরা পিতার প্রতিমা হয়।
-শেখর দেব

তবে কিছু নৈরাজ্য যে তৈরি হয়নি তা-ও না। কবিতা যে তীক্ষ্মভেদী অপরূপ ভাষাশিল্প তার প্রয়োগেও চরম অরাজকতা কখনো সোজা কখনো বা প্রচ্ছন্নভাবে দৃশ্যমান।
যেমন নাম উল্লেখ না করে নব্বই ও প্রথম দশকের দুই কবির কবিতা;
পাঁচ টন ওজনের একটি ট্রাক বিষ জর্জর দেহ নিয়ে আকাশের নীলে, ভাবছ প্রশান্তি বৃষ্টি হবে কিছু পরে।
অন্যজনের কবিতাভাষ্য ; মরুভূমির সেয়ানা বালুতে ঠাণ্ডা শীতল প্লাসেন্টা পাটকলের শ্রমিকের হাতে মেশিনে গড় গড় শুরু করেছে সেই কবে থেকে।
প্রথম পাঠেই একটা ধাক্কা লাগে। চমকে ওঠার মতো পংক্তি। কিন্তু উপলব্ধির সীমানা পেরিয়ে যখন ছুঁতে চাই সামাজিক অভীপ্সা থেকে তখন মনে হয় কোথাও বড়ো একটা ল্যাকিওনা, একটা অন্তঃসারশূন্যতা, নিস্ক্রিয় অনুসন্ধান। বলাবাহুল্য এখানে নির্ধারিত কোনো ছন্দ নেই। একটি শব্দকে কিস্টক (key stock) করে কিছু বাক্যের অসাড় এক্সারসাইজ। ভাষিক চেতনাভূতির তীক্ষ্ম একটি রঙ হয়তো সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু কোন সামাজিক সূচক ভাবনাগ্রহ থেকে তাকে আবিষ্কার করা যাবে! ঘর্মাক্ত হয়েছি। অনুভবে বিদ্ধ হয়েছি। চেতনার ভেতরে ডুবে যাওয়া পংক্তিগুলোর রেসকিউ করতে পারিনি। যে কবিতায় জীবনবোধের উৎসারণ নেই সে কবিতা নিছক শব্দ ব্যায়াম ছাড়া আর কী হতে পারে!!
কবিতার জন্য কিছু ব্যবস্থাপনা এ-রকম ভাবা যেতে পারে ;
১) অর্থগুণে ঋদ্ধ কবিতা যে কোনো মুহূর্তে বিবিধ অর্থে যাবার ক্ষমতা। ২) নতুন ধ্বনিময়তা যা আগের কবিতায় অনুপস্থিত। ৩) প্রচলিত ডিকশন ভেঙে নতুন টেক্সট তৈরি করবার ক্ষমতা। ৪) পরিমিত ভাষাজ্ঞানসহ চিত্রগুণের যথার্থ ব্যবহার। ৫) ইতিহাস ঐতিহ্যের পুনঃনবায়ন, ৬) কবিতার যথার্থ অন্তর্বয়ন, ৭) রূপকের আড়ালে মানবিক অনুভূতির সারৎসার, উপরোক্ত সাতটি প্রপঞ্চের উপস্থিতি একটি কবিতাকে পাঠমুগ্ধ করতে পারে। পাঠক সামাজিক অনুষঙ্গের সাথে কবিতার শাব্দিক দ্যোতনা যে কোনো একটি প্রপঞ্চের সাথে মিলিয়ে নিতে পারেন।
“জল পড়ে পাতা নড়ে” জীবনের এই সরল গভীর ছাউনি থেকে কবিতা অনেক পথ গড়িয়েছে। আরও গভীর ও জটিল হতেই পারে নতুন জীবনবোধ। তবে আরোপিত অসংযত অসংগতি না হলে কবিতার নান্দনিক স্থাপত্য নির্মিত হবে।
আমি তরুণদের কবিতা পড়ে উদ্বেলিত হই। আনন্দিত হই নতুন নির্মাণে। স্বপ্নজাগানিয়া হলে বিনির্মিত নতুন সৌন্দর্যে অবগাহন করি।
যে কবিতা নতুন স্বপ্নের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে না, তাকে কবিতার মতো উপস্থাপনের নাটকীয়তা গ্রহণ করতে সংকোচিত হই। কবিতার যে স্বভাবে সারল্য মুগ্ধতা আছে, জীবনের খুব গভীরে ডুব দিয়ে সারাংশ খোঁজার অভিপ্রায় আছে সে কবিতাতে আমার পক্ষপাত। জীবন কর্ষণ করে জীবনের উত্থান বেদনা ও আশার ভাষ্য হোক কবিতার ভূমিজ বিশ্বাস।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকখণ্ড মেঘ ও বালিয়াড়ি
পরবর্তী নিবন্ধজনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড ভোটারদের কাছে তুলে ধরতে হবে