একখণ্ড মেঘ ও বালিয়াড়ি

মূল গল্প: পাওলো কয়েকশো

অনুবাদ : শাহনাজ পারভীন সিঁথী | শুক্রবার , ৩০ অক্টোবর, ২০২০ at ৭:০৪ পূর্বাহ্ণ

ব্রুনো ফেরেরো লিখেছেন, ‘আমরা সবাই জানি যে, মেঘেদের জীবন খুব ব্যস্ততাময় ও সংক্ষিপ্ত।’ তার কথার সাথে সংগতি রেখেই আজকের গল্প।
কোনও এক ঝড়ের মাঝে ভূমধ্যসাগরে জন্ম নেয় ছোট্ট একটি মেঘ, কিন্তু সেখানে তার বেড়ে উঠার কোনও উপায় ছিল না, কারণ খুব জোরালো হাওয়া তাকে উড়িয়ে নিয়ে চলল আফ্রিকার পথে।
যে মুহূর্তে মেঘেদের দল সেখানে পৌঁছুলো, পরিবর্তিত হয়ে গেল সেখানকার জলবায়ু। আকাশ জুড়ে সুয্যি মামার উজ্জ্বল আলোর ঝলকানিতে বিস্তৃত সাহারাও সোনালু হয়ে গেল। যেহেতু এই বিশাল মরুভূমির বুকে বৃষ্টির ধারাপাত রচনা সম্ভব নয়, বাতাস তাদের ক্রমাগত দক্ষিণের বনভূমির দিকে ধাবিত করতে লাগল।
এরই মধ্যে যৌবনের পথ ধরে হাঁটা সেই মেঘখানি বাবা-মা এর আচঁল ছেড়ে “দেখবো এবার জগতটাকে” মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে “একলা চলো” নীতি অনুসরণ করার মনোবাসনা ব্যক্ত করলো।
বাতাস চিন্তিত হয়ে চিৎকার করে উঠলো, “কি করছো তুমি?” তাকে সাবধান করে বলে উঠলো, “মরুভূমির পুরোটা একই রকম। অন্য মেঘেদের সাথে যোগ দাও, এবং আমাদের সাথে চলো সেন্ট্রাল আফ্রিকা যেখানে তুমি চমৎকার পর্বতমালা ও নানান ধরনের বৃক্ষরাজি দেখতে পাবে।”
যৌবনের ধর্ম নিজের মত চলা, সে কারও বশ্যতা স্বীকারে অপারগ। যুবক মেঘটিও তার ব্যতিক্রম নয়। হালকা বাতাসের ভেলায় ভেসে সে অনেকখানি নেমে এলো সোনালী মরুভূমির কাছাকাছি। যখন সে বাতাসের দোলাচালে দুলছিল, হঠাৎই লক্ষ্য করলো মরুর বুকে এক বালিয়াড়ি তার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে!
বয়ে যাওয়া বাতাসের সময় মরুর বুকে জন্ম নেয়া এই বালিয়াড়িও যেন সদ্য যৌবনা। মেঘ সোনালী চুলের বালিয়াড়ির প্রেমে পড়ে গেল ঠিক তক্ষুনি।
“শুভ সকাল, ” মেঘ বলে উঠলো, “তোমাদের ওখানে কেমন চলছে জীবন?”
‘আমার বন্ধু হয়ে আছে আমার মতো আরও বালিয়াড়ি, সূর্য, এবং বাতাস, এবং কখনও কখনও পার হয়ে যাওয়া ক্যারাভ্যান। কখনও বা এখানে সূর্যের বেশ উত্তাপ, কিন্তু সহনীয়। তোমার ওখানে জীবন কেমন?’
‘আমারও সঙ্গী সূর্য ও বায়ু, কিন্তু ভাল দিকটি হলো পুরো আকাশ জুড়ে আমি ঘুরে বেড়াতে পারি এবং অনেক কিছুই দেখতে পারি।’
‘আমার জীবন’, বালিয়াড়ি বলে উঠলো, ‘খুব সংক্ষিপ্ত। বন থেকে বাতাস ফিরে এলেই আমি নিঃশেষ হয়ে যাবো।’
‘তুমি কি এজন্য কষ্ট পাচ্ছো?’
‘আমার মনে হচ্ছে আমার জীবনের কোনও উদ্দেশ্য নেই।’
‘আমিও তাই অনুভব করি। যখনই অন্য কোন হাওয়া আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে, আমি চলে যাবো দক্ষিণে, আর তারপর ঝরে পড়বো বৃষ্টি হয়ে; আর এটাই আমার নিয়তি।’
কিছুটা ইতস্তত করে বালিয়াড়ি বলল, ‘তুমি কি জানো মরুভূমির বুকে বৃষ্টি হলো আশীর্বাদ?’
গর্বের সাথে মেঘ বলল,’আমার কোনও ধারণাই ছিলোনা যে আমি এতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারি।’
‘আমি অন্য বালিয়াড়ির মুখে শুনেছি বৃষ্টি সম্পর্কে। তারা বলেছে যে বৃষ্টির পর আমরা ঘাস ও ফুলে ঢেকে যাই। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত কোনও অভিজ্ঞতা নেই, কারণ মরুভূমির বুকে সহজে বৃষ্টি হয়না।’
এখন মেঘের কিছুটা ইতস্তত ভাব দেখা দিয়েছে। তারপর, অট্টহাসি দিয়ে সে বলল, ‘তুমি যদি চাও এখন আমি তোমার কাছে বৃষ্টি হয়ে ঝরতে পারি। আমি জানি, তাহলে এখানেই আমার জীবন থেমে যাবে, কিন্তু আমি তোমাকে ভালবাসি, এবং এখানেই তোমার কাছে সব সময়ের জন্য থেকে যেতে চাই। ‘
‘তোমাকে প্রথম যখন আকাশে দেখেছিলাম, ঠিক তখনই আমিও তোমাকে ভালবেসে ফেলেছিলাম, ‘বালিয়াড়ির সরল স্বীকারোক্তি, ‘কিন্তু তুমি তোমার শুভ্র সুন্দর কেশ বৃষ্টিতে রূপান্তরিত করলে মরে যাবে।’
‘ভালবাসার মৃত্যু নেই,’ বলল মেঘ, ‘কেবল রূপান্তর আছে, তাছাড়া, আমি বৃষ্টি হয়ে ঝরে তোমাকে স্বর্গীয় সুখের অনুভূতি দিতে চাই।’
রংধনু আকাশে আবির্ভূত হওয়ার আগে পর্যন্ত ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি হয়ে সে বালিয়াড়িকে তার অনাবিল ভালবাসায় সিক্ত করে গেল।
ধীরে ধীরে বালিয়াড়ি ফুলে ফুলে ছেয়ে গেল। অন্য মেঘের দল ভুল করে ভাবলো এই বুঝি তারা আফ্রিকা চলে এলো, তারাও ঝরে পড়লো বৃষ্টি হয়ে।
বিশ বছর পর সেই বালিয়াড়ি রূপান্তরিত হলো সুশোভিত মরুদ্যানে যা কি না ক্লান্ত মরু যাত্রীদের ছায়া দিয়ে সামনে এগিয়ে চলার শক্তি যোগায়।
এবং এসবই সম্ভব হয়েছিল কারণ, একদিন একটি মেঘ ভালবেসেছিল, আর তার ভালবাসার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে ভয় পায়নি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধব্রেক আপ পর্ব
পরবর্তী নিবন্ধকবি ও কবিতা : স্বাপ্নিক উদ্বোধনের ভিন্ন নাম