গেলোবারের লেখায় ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির কারণসমূহ সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম। আজকের লেখায় থাকছে ওষুধের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি রোধে করণীয় সম্পর্কে।
ক. সরকারের করনীয়:
১. জাতীয় ওষুধনীতির প্রয়োগ: ক. ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ যথাযথভাবে প্রয়োগ করা এবং উক্ত অধ্যাদেশ অনুযায়ী ওষুধের দাম নির্ধারণের কর্তৃত্ব সরকারের নেয়া। খ. ওষুধনীতি ২০০৫ যত দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করতে হবে
২. কাঁচামালে স্বনির্ভরতা অর্জন: ওষুধের সব ধরনের কাঁচামাল দেশে তৈরি করা
৩. গবেষণা: ক. ওষুধের কাঁচামাল তৈরির গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন: জেনেরিক ওষুধের কাঁচামাল তৈরির প্রযুক্তি ও পদ্ধতি সহজ করতে পারে জাতীয় পর্যায়ের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এটিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিবেশী ভারত সহ প্রতিযোগী দেশগুলো কয়েক দশক আগেই এধরনের জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। (নিউজ বাংলাদেশ, ২৩-০৩-২২ )। খ. ফার্মাসিউটিকেল গবেষণাকে উৎসাহিত করা।
গ. মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ খেয়ে রোগীদের কি অবস্থা হয় তা গবেষণা করতে হবে,
৪.সরকারি ওষুধের উৎপাদন বাড়ানো: সরকারের ওষুধ কোম্পানী এসেনশিয়াল ড্রাগিস এর উৎপাদন বাড়াতে হবে
৫. ওষুধ শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা: ক. ওষুধ শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করা। খ. ওষুধের শিল্পাঞ্চল বা এপিআই পার্ক তৈরিতে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকা
৬. ওষুধ প্রশাসনকে যুগোপযোগী কার্যকর করা: ক. ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে বিচারিক ক্ষমতা দেয়া। খ. ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরে দক্ষ ফার্মাসিস্টদের নিয়োগ দেয়া। গ. ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের জনবল বৃদ্ধি ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা,
৭. ভেজাল ওষুধ প্রতিরোধে বৈশ্বিক পদক্ষেপকে সমর্থন দেয়া: ‘২০১০ সালের নভেম্বর মাসে ইউরোপীয় ট্রেড কমিশন’ এন্টি কাউন্টারফিটিং ট্রেডএগ্রিমেন্ট’ (নকলবিরোধী বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনের কাজ সম্পন্ন করেছে চুক্তিতে পেটেন্ট রুল সংরক্ষণ, নকল ওষুধ বিক্রি নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং এই সমস্যা সমাধানে বৃহত্তর সহযোগিতার দ্বার উন্মোচন করার বিধান রাখা হযেছে। অস্ট্রেলিয়া, জাপান, কোরিয়া, মেক্সিকো, মরক্কো, নিউজিল্যান্ড, সিংগাপুর, সুইজারল্যান্ড এবং যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তি সম্পাদনে অংশ গ্রহণ করে’ (বি ডি নিউজ ২৪ ডট কম,০৮-১১-১৪)।
খ. ওষুধ প্রশাসনের করণীয়: ১. ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণ: ক. বৎসরে দুইবার আন্তর্জাতিক মূল্যগুলো নিয়ে রিভিউ করলে জানা যায় আমাদের দেশে কোন ওষুধের দাম কমাতে হবে। খ. সকল ওষুধের খুচরামূল্য ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা। গ. অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা নবায়ন করা: ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা দুই বছর পর পর নবায়ন করতে হয়। তবে স্বাধীনতার পর মাত্র তিন বার নবায়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ করা হযেছে আট বছর আগে ২০১৬ সালে (নিউজ বাংলাদেশ ,২৩-০৩-২২)।
২.ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণ: ক. জিএমপি কঠোরভাবে মেনে চলা। খ. উন্নত দেশের নিবন্ধন মানদণ্ডের সাথে সংগতি রেখে নিবন্ধন প্রক্রিয়া সময় সময় হালনাগাদ করা। গ. কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগার হিসাবে ন্যাশনাল কনট্রোল ল্যাবরেটরীকে আধুনিকিকরণ ও পর্যায়ক্রমে সব বিভাগে কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগারের বা ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরীর শাখা স্থাপন করা এবং কেন্দ্রীয়ভাবে একটি স্বায়ত্বশাসিত জাতীয় রেফারেনস পরীক্ষাগার প্রতিষ্ঠা করা। ঘ. কাঁচামালের মান নিয়ন্ত্রণ করা: ‘২০২১ সালের জুনে প্রকাশিত বাংলাদেশ উন্নয়ন সমীক্ষার গবেষণা নিবন্ধে ওষুধ প্রশাসনের বরাত দিয়ে বরা হয়, দেশে ওষুধ তৈরির কাঁচামালের মধ্যে ৬৭.৫ শতাংশ আমদানী করা হয় ভারত থেকে, চীন ১৮.৪ শতাংশ, জার্মানী ২.৮ শতাংশ ও ইতালী ২.৬ শতাংশ, তাইওয়ান-সুইজারল্যান্ড-স্পেন-মালয়েশিয়া-জাপান-ফ্রানস-যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য-ডেনমার্ক ইত্যাদি ৮.৬ শতাংশ’ ( সংবাদভুমি,০৫-০৪-২২) ।
কাঁচামাল আমদানীর সময় দেখতে হবে: ক. মানের শর্তগুলি মানা হয়েছে কিনা।
খ. ’ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল ফর হারমোনাইজেশন’ দ্বারা তৈরিকৃত টেকনিকের রিকোয়ারমেন্টগুলো মানা হয়েছে কিনা। গ. ওষুধের কাঁচামাল কালোবাজারে বিক্রি বন্ধ করা।
৩. কাঁচামাল নিয়ে ওষুধ কোম্পানীর কারসাজি বন্ধ করা: ১. সস্তাদরের আমদানী: ক. দেশের বাজারের জন্য তারা ভারত ও চীন থেকে সস্তা দরের কাঁচামাল আমদানী করে। আর রপ্তানীর ওষুধের জন্য আনে বেশি দাম দিয়ে উন্নত মানেরটা,
২. মেয়াদ শেষ পর্যায়ে তেমনি কমদামী কাঁচামালের আমদানী: ক. যে কাঁচামালের মেয়াদ প্রায় শেষ পর্যায়ে, সেটা আরও সস্তা দরে নিয়ে এসে ওষুধ বানিয়ে নুতন উৎপাদনের তারিখ বসিয়ে বাজারে ছাড়ে।
৩. কাঁচামালের উৎপাদনকারী ও বিক্রেতারা দামের বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো তথ্য দেয় না।
৪. ওষুধের কাঁচামাল আমদানীর আড়ালে অর্থ পাচারের সুযোগও থেকে যায়।
৩. নকল, ভেজাল ও মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ প্রতিরোধ করা: আসল ওষুধের নামে ও অবয়বে মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রতারণামূলক ভাবে নকল উপকরণ দিয়ে, না দিয়ে বা ভেজাল দিয়ে উৎপাদিত ওষুধই নকল ওষুধ। ব্রান্ড ওষুধের মতো জেনেরিক ওষুধও নকল হয়। অনেক ওষুধে ঠিক উপকরণটি ব্যবহার করা হলেও তা পর্যাপ্ত পরিমানে থাকে না। এসব ওষুধকে নিম্নমানের ওষুধ বলা হয়।
ক. ভেজাল ওষুধ নিয়ন্ত্রণে সরকারি হাসপাতালে সরকারি ও বেসরকারি ওষুধ কোম্পানী সমূহের নিম্নমানের কাঁচামাল দ্বারা প্রস্তুতকৃত ওষুধ সরবরাহ রোধ করা। খ. মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ কিভাবে বাজারে আসছে তা অনুসন্ধান করতে হবে: বাংলাদেশের ফার্মেসীগুলোতে পুরো পাতা ওষুধ বিক্রি না করে তিনটা বা চারটি করে ওষুধ বিক্রির প্রবণতা রয়েছে। আর এই প্রবণতার কারণে ওষুধের মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখও অনেক সময় বুঝা সম্ভব হয় না। এতে করে মেয়াদ পার হয়ে গেলেও ওষুধগুলো ফার্মেসীতে বিক্রি হয়। সাধারণ মানুষের অধিকাংশের জানাই নেই যে কোথায় মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ লেখা থাকে।
৪. নিয়ন্ত্রিত ফার্মেসী প্রতিষ্ঠা:
ক. দেশে পর্যায়ক্রমে কমিউনিটি ফার্ম্মেসী প্রতিষ্ঠা করা। খ. সকল বড় হাসপাতালে ’হাসপাতাল ফার্ম্মেসী’ চালু করা।
৫.ওষুধ প্রশাসনকে সময়োপযোগী কার্যকর করা: ক. ওষুধ প্রশাসনের জনশক্তি ও অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা বাড়ানো,
৬.ওষুধের ক্রয়-বিক্রয় নীতিমালা প্রণয়ন: ক. রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ বিক্রয় ও বিতরণ নিষিদ্ধ করা। খ. সব ফার্মেসীতে স্নাতক ফার্মাসিস্ট এর উপস্থিতি নিশ্চিত করা
৭. আমেরিকার এফডিএ বা আমেরিকার খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন এর মতো রেগুলেটরী অথরিটি আমাদের দেশে চালু করা।
উপসংহার: আলোচনার সারমর্ম হিসাবে বলতে চাই যে, যেহেতু ওষুধ অত্যাবশ্যকীয় জীবনরক্ষাকারী দ্রব্য অতএব ওষুধের অযৌক্তিক মূল্য নিয়ন্ত্রণ অবশ্যই করতে হবে এবং এ জন্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসমূহের আশু পদক্ষেপ কাম্য।
লেখক: ডায়াবেটিস ও চর্মযৌনরোগে স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক