ঐতিহ্য ধরে রাখতে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন

পটিয়ার হাইদগাঁওয়ে পান চাষ

শফিউল আজম | সোমবার , ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৬:২৮ পূর্বাহ্ণ

পান’ সেই প্রাচীন যুগ থেকেই যার পরিচিতি। পান নিয়ে রচিত হয়েছে নানা গান কবিতা ও গ্রামীণ শ্লোক। যেমন বাংলা গানের বিখ্যাত গায়িকা রুনা লায়লার গাওয়া ‘পান খাইয়া ঠোঁট লাল করিলাম বন্ধুর খবর পাইলাম না’/ কিংবা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের সম্রাট খ্যাত শেফালী ঘোষের গাওয়া ‘যদি সুন্দর একখান মুখ পাইতাম, ‘মহেষখাইল্লা পানের খিলি তারে বানাই খাওইতাম’।

পান নিয়ে বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস অনেক পুরনো। বিয়ে বাড়ি কিংবা বেয়ায় বেয়ানদের জন্য পান সুপারি নেওয়া বাঙালি সমাজের সেই ঐতিহাসিক রেওয়াজ। বেয়ায় বেয়ানদের জন্য এবং বিয়ে বাড়িতে পান সুপারী না নেওয়ায় অনেক বিয়ে ভাঙ্গনের ঘটনাও এক সময় ঘটেছে।

এই পান নিয়ে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ও বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম তীর্থস্থান পটিয়ার হাইদগাঁওয়ের রয়েছে দুইশত বছরের পুরনো ঐতিহ্য ও ইতিহাস। আজ থেকে দুইশত বছর পূর্বে এখানে পান চাষের সূচনা হয়। ওই এলাকার মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু লোক পান চাষে এগিয়ে আসে। স্থানীয় বিভিন্ন পান চাষীদের সাথে কথা বলে জানাযায়, মুগল আমলে শায়েস্তা খান চট্টগ্রাম দখল করে মগ সম্প্রদায়কে বিতাড়িত করে। এসময় এ অঞ্চলে মুসলমান ও হিন্দুদের বসতি শুরু হয়। মূলত তখন থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা পান চাষ শুরু করেন।

৮০’র দশক পর্যন্ত হাইদগাঁও অঞ্চলে ২০০ হেক্টর জমিতে পান চাষ হতো। ৯১’র ঘুর্ণিঝড় পরবর্তী সময়ে পান চাষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এতে পান চাষিরাও বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এর পর পান চাষ ব্যয় বহুল হওয়ায় পর্যায়ক্রমে পান চাষ কমতে থাকে। তখন পুরো গ্রামের ৭০% মানুষ পান চাষের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। এসময় ওই অঞ্চলের ৩ হাজার মানুষ পান চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করতো।

বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে এ পান চাষের বিষয়ে কোনও ধরণের উদ্যোগ না থাকায় বর্তমানে দুইশত বছরের এ পান চাষ হুমকির মুখে পড়ছে। পান চাষে সরকারি ও বৃত্তর পরিসরে বেসরকারি পর্যায়ে গঠনমূলক উদ্যোগ নেয়া না হলে অচিরেই ঐতিহ্যবাহী ও কালের সাক্ষী এ পান চাষ বিলুপ্ত হয়ে পড়বে।

পান উৎপাদনকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ আমলে হাইদগাঁওতে গড়ে উঠেছিল ‘পান বাজার’ নামের বিশেষ পানের হাট। যে বাজারটি পরবর্তীতে সরকারিভাবে রেকর্ডিভুক্ত ও সরকারিভাবেই এই হাটের ইজারা দেয়া হয়। তাছাড়া পান চাষের সাথে ওথপ্রোতভাবে প্রয়োজনীয় বাঁশ, ছন (পাহাড়ি এক ধরণের লম্বাকৃতির বিশেষ পাতা, যা পান চাষে ছাউনি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে) নিয়ে সপ্তাহে দুইদিন ওই বাজার বসতো। যে বাজার থেকে স্থানীয় পান চাষীরা পানের বরজ বা খেতের জন্য বাঁশ ও ছন কিনে নিয়ে যেত। আজ সেই বাঁশ ও ছনের যেন দুর্দিন চলছে। পাহাড়ে নির্বিচারে গাছ বাঁশ নিধন করায় একটি একটি পাহাড় হয়ে উঠেছে যেন ‘ন্যাড়া পাহাড়’!

স্থানীয় পান চাষী তুষার তালুকদার, বাসু চৌধুরী ও মিদুল দত্তের সাথে কথা বলে জানা যায়, হাইদগাঁওয়ে মূলত রাজশাহী জাতের বাংলা পানের চাষ করা হয়। শ্রাবণ থেকে কার্ত্তিক মাস পর্যন্ত পানের চারা রোপন করার উপযুক্ত সময়। চারা রোপনের ছয়মাস পর থেকে পান বরজ থেকে ছিড়া বা খাওয়ার উপযোগী হয়। ৭২টি পান দিয়ে বা ১৮ গণ্ডা (৪টিতে এক গণ্ডা) একটি ‘পানের বিরা/ বান্ডেল’ বানানো হয়। পাইকারী দামে ৩০ টাকা থেকে ১৩০টাকা পর্যন্ত বিরা বিক্রি করা হয়। শীত মৌসুমে এর দাম বেড়ে যায়। এসময় প্রতি বিরা/বান্ডেল পান বিক্রি হয় ১৩০টাকা থেকে ২৬০টাকা পর্যন্ত। পানের বরজ ও ক্ষেতে প্রতিজন শ্রমিকের বেতন প্রতিদিন ৫শ থেকে ১২শ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এক একটি পানের বরজ বা ক্ষেতের বয়স ৭০৮০ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে। এক একটি পানের বরজ চারাগুলো কলপের মাধ্যমে চারা গজানো বা পানের লতা বৃদ্ধির এ প্রক্রিয়া চলমান থাকে।

২০১০ সালে রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের যোগসাজসে পাহাড় থেকে নির্বিচারে বাঁশ কেটে অন্যত্র নিয়ে যায়। ফলে স্থানীয় পান চাষীরা তাদের পানের বরজ বা চাষে বাঁশের সংকটে পড়ে। তখন পান চাষ হুমকির মুখে পড়ে। এসময় পান চাষীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে পটিয়ার পাহাড় থেকে বাঁশ পাচার রুধে আন্দোলন সংগ্রাম শুরু করেন। এক পর্যায়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য (বর্তমান জাতীয় সংসদের হুইপ) সামশুল হক চৌধুরী এমপির কাছে দাবী জানালে তিনি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে বাঁশ কাট ও পাচার বন্ধে বনবিভাগকে নির্দেশ দেন।

বর্তমানে পান চাষের উপকরণ বাঁশ, ছন ও খৈলসহ যাবতীয় জিনিসের দাম বেড়েছে কয়েক গুন। তাছাড়া কিছু স্বার্থন্বেষী মহল পাহাড়ে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠা বাঁশ নির্ধন করে গাছ বাগান করছে। কিছুদিন পর গাছের বাগান কেটে ফেলে। বাঁশ বাগান পাহাড়ের একটি অপরিহার্য অংশ। এ বাঁশ ও ছন বর্তমানে বিলুপ্তির পথে। তাছাড়া পান চাষে বেড়েছে রোগ ব্যাধিও।

নানা সংকট ও সমস্যার কারণে বর্তমানে চাষ কমে ১শ’ হেক্টর বা সাড়ে ৭শ’ কানি জমিতে পান চাষ হচ্ছে। হাইদগাঁওয়ের পান চাষ ঘিরে পটিয়ায় ৪টি বৃহৎ পানের আড়ৎ গড়ে ওঠেছে। এসব আড়তে প্রতিদিন কয়েক লক্ষ টাকার পান বেচা কেনা হয়। এ চারটি আড়তে হাইদগাঁওয়ের পান ছাড়াও মহেশখালীর মিষ্টি পান পাইকারী দরে বিক্রি হয়।

বর্তমানে হাইদগাঁওয়ে প্রতিবছর ১শত কোটি টাকার পান বেচাকেনা হয়। সপ্তাহে দুইদিন শনিবার ও বুধবার ৫৬টি ট্রাক ভর্তি করে চট্টগ্রাম উত্তর জেলার মিরসরাই মিঠাছড়ি বাজারে এ পান নিয়ে যাওয়া হয়। এছাড়াও হাইগাঁওয়ে উৎপাদিত পান নোয়াখালী, কক্সবাজারের টেকনাফ ও চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন হাট বাজারে যায়।

২০১০ সালে এ পান চাষীদের সংগঠিত করে করে ‘হাইদগাঁও কৃষক কল্যাণ পেশাজীবী সমবায় সমিতি গঠিত হয়। এ সংগঠনটি ২০২০ সালে এসে সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধন লাভ করে। বর্তমানে এ সমিতির সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন জয়নাল আবেদীন ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন পান চাষী রঞ্জিত চৌধুরী।

পান চাষীদের সংগঠক উজ্জল চৌধুরী ও চন্দন চৌধুরী জানান, সমিতির তালিকাভুক্ত ৮শ’ সদস্য রয়েছে। এরমধ্যে ৫ শ’ জন পান চাষী ও ৩শ’ জন সবজি চাষী রয়েছেন। এ সমিতির মাধ্যমে কৃষকদের সংগঠিত করে আধুনিকভাবে পান চাষ ও ফলন বাড়াতে এ সমিতি কাজ করছে বলে তারা জানান। তারা আরো বলেন, পান চাষ নিয়ে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে পূর্বে কোন কর্মসূচী ছিল না। এ চাষ নিয়ে অধিদপ্তরে কোন রেকর্ডও ছিল না। অথচ এ পান একটি অর্থকরী ফসল। এ পান চাষের মাধ্যমে শত শত চাষীর জীবন মান উন্নত হচ্ছে।

৯১’র ঘুণিঝড়ের পর বাংলাদেশ পান চাষী সমিতির তৎকালিন সাধারণ সম্পাদক, পটিয়ার কৃতি সন্তান এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবি এডভোকেট হরিসাধন দেব বর্মন পটিয়ার হাইদগাঁও সহ সারাদেশের পান চাষীদের নিয়ে ঢাকায় সমাবেশ করেন। পান চাষীদের বিভিন্ন দাবী দাওয়া কৃষি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকে স্বারকলিপির মাধ্যমে উত্তাপন করেন। তাদের এ দাবীর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ পান চাষ কে কৃষি ঋণের আওতাভুক্ত করেন। এর প্রেক্ষিতে বর্তমানে ঢাকা ব্যাংক পটিয়া শাখায় পান চাষীদের সহজশর্তে ও স্বল্প সুদে গ্রুপ ভিক্তিক ঋণ কার্যক্রম চালু রেখেছে। যার ফলে পান চাষীরা নিজেরা স্বচ্ছল হওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত ঋণের টাকা পরিশোধ করছেন। ফলে পান চাষীরা দাদন ও বিভিন্ন এনজি সংস্থার ছড়া সুদ থেকে পান চাষীরা রক্ষা পাচ্ছে। পান চাষীরা জানান, অন্যান্য ব্যাংকে যদি পান চাষীদের এ ঋণ কার্যক্রম চালু করে তাহলে চাষীরা আরো আগ্রহী বা পান চাষে উদ্বুদ্ধ হবে। তাছাড়া সরকারিভাবে ভুর্তিকী মূল্যে চাষীদের ২/৩টি পিকআপ দেয়, তা হলে পান চাষীরা স্বাশ্রয়ী মূল্যে পান বিক্রি ও সহজে পরিবহন করতে পারবে।

হাইদগাঁও কৃষক কল্যাণ পেশাজীবি সমবায় সমিতি’র সভাপতি জয়নাল আবেদীন বলেন, হাইদগাঁও পান চাষীদের যে সমস্যা রয়েছে, তা লাঘবে চাষীদের উন্নত প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে। সহজশর্তে ও স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা প্রদান, পান বাজার জাতের জন্য আধুনিক কৃষি মার্কেট স্থাপন, পান পরিবহনের ভুর্তিকী প্রদানের মাধ্যমে মিনি ট্রাক প্রদান, সর্বোপরি হাইদাগাঁও পান চাষকে রপ্তানিমূখী পণ্যে পরিণত করে এবং এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধি করে জাতীয় অর্থনীতিতে সহযোগিতা করার দাবী জানাচ্ছি। ‘হাইদগাঁও কৃষক কল্যাণ পেশাজীবি সমবায় সমিতি লি:’ পান চাষী ও অন্যান্য কৃষকদের সংকট নিরসনে ও তাদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছে। পাশাপাশি তাদের সন্তানদের পড়া লেখায় সহযোগিতাসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূখী কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে।

বিভিন্ন সূত্রে জানাযায়, সুপরিচিত এই খাবার পান যার বৈজ্ঞানিক নাম ‘পাইপার বিটল’ আর সংস্কৃত ভাষায় ‘ভূজঙ্গলতা পত্র’ অহমিয়া ভাষায় এর নাম ‘তাম্বূল’ বাংলা ও হিন্দি ভাষায় ‘পান’ বলে পরিচিত। পান সংস্কৃত পর্ণ যার অর্থ পাতাএটা সুপারি ও অন্যান্য মসলার সাথে সংমিশ্রনের একটি প্রস্তুতি প্রত্নতাত্ত্বিক, ভাষাতাত্ত্বিক এবং উদ্ভিদবিদ্যা সংক্রান্ত প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে পান চিবানো অস্টোনেশিয়ানের সাথে জোরালোভাবে জড়িত, অনেক ক্ষেত্রে ফিলিপাইনের উৎপত্তি বলে মনে করা হয়। পান চিবানোর প্রাচীনতম দ্ব্যর্থহীন প্রমাণ ফিলিপাইনের। খাবার ছাড়াও ঔষধ তৈরি এবং হিন্দু ধর্মের পূজাপার্বণে এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

পান চাষ পদ্ধতি এক বিশেষ রকমের যা ‘বরজ’ নামে পরিচিত। এই বরজ হল ভালো ভাবে ঘেরা ও উপরে ছন পাতায় ছাউনি দেওয়া বিশেষ ভাবে প্রস্তুত একটি ঘর। পান চাষে সাধারণত অন্যান্য ফসলের ন্যায় অনেক সমস্যা রয়েছে তাই এর চাষাবাদে যত্নশীল হতে হয়।

সাধারণত উঁচু অবস্থানের জল নিকাশি যুক্ত দোঁযাশ বা এঁটেল দোঁয়াশ মাটি পান চাষের জন্য উপযুক্ত। জমির পি.এইচ ৬..৫ থাকা বাঞ্ছনীয়। নোনা বা ক্ষার জাতীয় মাটি পান চাষের জন্য ছায়াযুুক্ত আর্দ্র্র বা স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া ও রসযুক্ত মাটি পান চাষের উপযুক্ত। পানের রয়েছে নানা জাত যেমনবাংলা পান, সাঁচি, মিঠা, কর্পুর, গ্যাচ, উজানী, মাঘী, দেশী, বরিশাল ও ঝালি প্রভৃতি

পানের রয়েছে কিছু উপকারী গুণ। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, পান বলকারক, কামোদ্দীপক, রাতকানা রোগের নিরাময়ের সহায়ক। এছাড়া মুখের দুগর্ন্ধ দূর করে, হজমশক্তি বাড়ায় ও উকুননাশক হিসাবে কাজ করে। সুপারিতে রয়েছে জীবানু নাশক, কৃমিনাশক শক্তি। চুনে রয়েছে ক্যালসিয়াম, রক্ত পরিষ্কার শক্তি তবে সেটা যদি ঝিনুকের চুন হয়।

লেখক : পটিয়া প্রতিনিধি, দৈনিক আজাদী

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘চাটগাঁর বেলা’ এক ঐতিহ্যের নাম
পরবর্তী নিবন্ধমনীষী আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার