এ কে মাহমুদুল হক : সততা ও সাহসের প্রতীক

মুহাম্মদ জাফর উল্লাহ্‌ | শুক্রবার , ১২ আগস্ট, ২০২২ at ৭:০২ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার বিকাশ ও বিস্তার, শিক্ষকদের দাবি আদায় এবং ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলনে বিশেষ অবদান রাখায় মরহুম এ কে মাহমুদুল হক সর্বত্র ছিলেন এক পরিচিত মুখ। সততা ও সাহসিকতায় এক উজ্জ্বল প্রদীপ। এ কে মাহমুদুল হক এর পুরো নাম আবুল কালাম মাহমুদুল হক। তিনি চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি থানার হাইদ চৌকিয়া গ্রামে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মাওলানা আমিনুল হক। মায়ের নাম ছফুরা খাতুন।
এ কে মাহমুদুল হক শৈশবে গৃহ শিক্ষকের কাছে পবিত্র কুরআন শরীফ ও শিশু পাঠ শেষে ফটিকছড়ি থানা কেন্দ্রে অবস্থিত জামেউল উলুম মাদরাসায় সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে সীতাকুণ্ড আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। দাখিল পাশ করার পর ভর্তি হন চট্টগ্রাম শহরের প্রাচীনতম মাদরাসা চন্দনপুরা দারুল উলুম আলিয়া মাদরাসায়। তাঁর পিতাও ছিলেন এই মাদরাসার প্রাক্তন ছাত্র। এখানে কিছুদিন লেখাপড়া করার পর তিনি কাগতিয়া এশায়াতুল উলুম মাদরাসা থেকে আলিম প্রথম বিভাগে পাশ করেন। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় দারুল উলূম আলিয়া মাদরাসায় ভর্তি হয়ে ফাজিল পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে এ কে মাহমুদুল হক হাটহাজারীর মির্জাপুর হাইস্কুলে প্রধান মওলভী হিসেবে শিক্ষকতায় যোগদান করেন। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষক (প্রাইভেট) হিসেবে তিনি হাই মাদ্‌রাসা পাশ করেন। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে লাকসাম ফয়েজুন্নিসা কলেজ থেকে নিয়মিত ছাত্র হিসেবে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় মেধা তালিকায় চতুর্থ স্থান অধিকার করার গৌরব অর্জন করেন। পরে শিক্ষক (প্রাইভেট) হিসেবে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে বি. এ. পাশ করেন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়মিত ছাত্র হিসেবে তিনি বাংলায় কৃতিত্বের সাথে এম. এ. পাস করেন।
মুক্তিযুদ্ধের কঠিনতম সময়ে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হন এ কে মাহমুদুল হক। প্রধান শিক্ষক হিসেবে শিক্ষা, প্রশাসন ও স্কুলের শ্রী বৃদ্ধির পর ২০০০ খ্রিস্টাব্দে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। এ বিদ্যালয়ে পরপর দু’বার এক্সটেনশনসহ দীর্ঘ ৪০ বছর শিক্ষকতা করেন। ন্যায্য দাবী আদায়ের লক্ষ্যে শিক্ষক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে চট্টগ্রাম কারাগারে ৩৬ দিন কারাবাস করতে হয়। আবার ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় পুরস্কার লাভ করে শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হিসেবে দুর্লভ সম্মানেও ভূষিত হন। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী শিক্ষকদের ন্যায্য দাবী আদায়ের মূর্ত প্রতীক, চট্টগ্রামের শিক্ষা উন্নয়নের পুরোধা জনাব এ কে মাহমুদুল হক যে কত উদার ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের মানুষ ছিলেন তা উনার বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের বক্তব্যে ফুটে উঠেছে। এ বিদায় অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন- মহান বিপ্লবী সূর্য সেনের সহযোগী শ্রী বিনোদ বিহারী চৌধুরী। অনুষ্ঠানের একজন অতিথি বাবু সলিল বিহারী বড়ুয়া তাঁর বক্তব্যে বলেন- ‘তিনি অন্যকে বড় করেছেন বলেই নিজে বড় হয়েছেন। তিনি অন্যকে সম্মান দিয়েছেন বলেই আজ সর্বত্র সম্মানিত হয়েছেন। এত বড় মাপের মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। এই স্কুলে তিনি পারস্পরিক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন।’
শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক এ কে মাহমুদুল হক ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে নয়াদিল্লীতে ২৯ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ‘গান্ধী পীস ফাউন্ডেশন’ হোস্টেলে অনুষ্ঠিত সার্ক শিক্ষক সম্মেলনে যোগদান করেন। তিনি বহুবার মক্কা, মদীনা যিয়ারত করেন।
তিনি সপরিবারে আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করেন। তাঁর ভ্রমণের আংশিক কাহিনী বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তিনি যখনই যেখানে সুযোগ পেয়েছেন, সমাজসেবায় অংশ নিয়ে সুন্দর সমাজ গঠনে তাঁর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। জীবন সায়াহ্নেও তাঁর উন্নত সমাজ গঠনের চেষ্টায় কোন শৈথিল্য প্রদর্শিত হয়নি। যখনই সুযোগ পেয়েছেন মনীষীদের সাহচর্য লাভে ধন্য হতে চেষ্টা করেছেন।
প্রধান শিক্ষক থাকাকালে বহু ভাষাবিদ ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ সাহেবের ছাত্র হয়ে একুশ দিন বাংলা ভাষায় বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। স্কুল, কলেজ ও মাদ্‌রাসা প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে যেয়ে সশস্ত্র হামলার শিকার হয়েছেন। চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড প্রতিষ্ঠা ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির আর্থিক সহায়তায় এবং সরকারি স্কুলের প্রধানদের আন্তরিক সহযোগিতায় তদানিন্তন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল কাশেম সাহেবের সক্রিয় কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে এ কে মাহমুদুল হক সাহেব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। জাতীয় পর্যায়ে স্কুল ও মাদ্‌রাসা ক্রীড়া কমিটির সদস্য থাকাকালীন ক্রীড়ার উন্নয়ন এবং স্কাউট আন্দোলনে তাঁর প্রশংসনীয় ভূমিকা পালনের জন্য তাঁকে প্রশংসা সনদ দেওয়া হয়।বায়তুশ শরফের প্রধান রূপকার শাহ্‌সূফী আলহাজ্ব হযরত মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল জব্বার (রহ.) এর সান্নিধ্যে এসে তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন পরিপূর্ণতা লাভ করে। পীর সাহেবের আধ্যাত্মিক স্পর্শে তিনি বনে যান অন্য এক মানুষ। হুজুর ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে তাঁকে সম্পাদকের দায়িত্ব প্রদান করে প্রকাশ করেন বহুল প্রচারিত মাসিক দ্বীন দুনিয়া। এ পত্রিকার শ্রীবৃদ্ধি ও প্রচার-প্রসারে তাঁর ভূমিকা অনন্য। পরবর্তীতে মরহুম পীর বাহ্‌রুল উলুম শাহ্‌সূফী হযরত মাওলানা মোহাম্মদ কুতুব উদ্দিন (রহ.) এর একান্ত ইচ্ছায় সম্পাদক রূপে প্রকাশ করেন মাসিক শিশু-কিশোর দ্বীন-দুনিয়া, যা সমগ্র দেশের শিশু-কিশোর; এমনকি বয়স্কদের নিকটও জনপ্রিয়। পত্র-পত্রিকা প্রকাশনার পাশাপাশি তিনি বায়তুশ শরফের প্রতিটি কাজের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিলেন।
এ কে মাহমুদুল হক-এর লেখা আত্মজীবনী ‘জীবন স্রোতের আঁকে বাঁকে’ একটি পাঠকপ্রিয় গ্রন্থ। উপন্যাসের আদলে লেখা বইটিতে তাঁর জীবনের অনেক ঘটনা সুনিপুণভাবে বিবৃত হয়েছে। জীবনে উন্নতি লাভের উপায় অনুধাবন করতে তরুণ পাঠকদের জন্য রয়েছে এতে অপরিসীম শিক্ষা।
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এ কে মাহমুদুল হক জাতির উন্নয়নে ও দেশ গঠনে সেবা দানের চেষ্টা অব্যাহত রেখে দেশবাসীকে উৎসাহ দিতে ও অনুপ্রাণিত করতে চেষ্টা করে গিয়েছেন। তাই ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক সবাই তাঁর কৃতিত্বে কৃতজ্ঞ ও আনন্দিত ছিলেন। দয়াময় মেহেরবান আল্লাহ্‌ আমাদের প্রাণপ্রিয় শিক্ষক মরহুম এ কে মাহমুদুল হককে জান্নাতুল ফেরদৌসের উচ্চ মাকামে দাখিল করুন। আমীন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতোমাকে শ্রদ্ধা হে পিতা
পরবর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা