রায়হানা হাসিব ঝুমুর রচিত প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘এসো কিংশুক ফাগুনে’র সাতটি ভিন্নধর্মী গল্প সন্নিবিষ্ট হয়েছে এই গ্রন্থে। চট্টগ্রামের স্বনামখ্যাত প্রকাশন ‘খড়িমাটি’ থেকে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে।
=রায়হানা হাসিবের লেখার সাথে এরই মধ্যে ফেইসবুকের পাঠক এবং তার পরিচিত মহল পরিচিত হয়ে উঠেছেন। তাঁর লেখালেখির শুরু অনেক আগে থেকেই। যদিও ২০২৪ এর একুশে বইমেলায় তার প্রথম গ্রন্থ প্রকাশিত হলো। বইটি সংগ্রহ করেছিলাম খড়িমাটির স্টল থেকে বইমেলায়। বইটি হাতে নিলেই মুগ্ধ হতে হয় প্রচ্ছদ শিল্পী আল নোমানের আঁকা চমৎকার প্রচ্ছদ দেখে যা বইটিকে দৃষ্টিনন্দন করেছে। নামের সাথে সঙ্গতি রেখে বাসন্তী রঙের ওপর লাল কিংশুক বা পলাশের ছোপ সত্যি চিত্তাকর্ষক। বইটির ফ্ল্যাপে কার লেখা জানা না গেলেও এই ফ্ল্যাপ পড়ে ভিতরের গল্পগুলো সম্পর্কে পাঠক কিছুটা হলেও ধারণা পাবেন। বইটি লেখক কথাসাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরীকে উৎসর্গ করেছেন।
সাতটি ছোট গল্পের সমন্বয়ে বইটি সাজানো হয়েছে। আসলে ছোট বললেও গল্পগুলো মোটেই ছোট না। ১৬২ পৃষ্ঠার বইয়ে সাতটি গল্পের পরিণয় ছোট কি করে হয়। তবে নানান রসবোধ নিয়ে রায়হানা হাসিব সাজিয়েছেন বইয়ের গল্পগুলো। প্রতিটি গল্পে আছে নতুনত্ব, নিজস্বতা, আপন ভাবনা, প্রেক্ষাপট এবং চিন্তাধারা। সাথে সাথে আছে গল্পের প্রাসঙ্গিকতা যা গল্পগুলো পাঠে পাঠককে নিরুৎসাহিত করবে না বরং উৎসাহিত করবে। এছাড়া আছে লেখকের লেখার সাবলীল গতি বিস্তার ও সহজ–সরল উপস্থাপনা। প্রতিটি গল্পে রয়েছে একাধিক পরিচ্ছদ।
পাঠকের কাছে একটা গল্পের চাহিদা কি? পাঠক হিসেবে আমার মনে হয় গল্পের বস্তুনিষ্ঠতা, বিষয়বস্তুর নতুনত্ব, সাবলীল প্রকাশ এবং গতিময়তা।
গল্পের অনুষঙ্গ বা বিষয়ে লেখিকা নতুনত্বের অনুসারী এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে অতীত এবং বর্তমানের বাস্তবতা দুটোই স্থান পেয়েছে তাঁর গল্পে। তাঁর গল্পে যেমন স্পষ্ট হয়েছে প্রেম, সম্পর্ক, বন্ধন, তেমনি তিনি তুলে ধরেছেন সমাজের অচিত্রিত কিছু দৃশ্যপট যা অত্যন্ত জীবনঘনিষ্ঠ হলেও অপ্রকাশ্য। গল্পগুলোতে একদিকে যেমন উঠে এসেছে নির্যাতিত মানুষের জন্য বিবেকবান মানুষের আর্তি, দায়বদ্ধতা অপরদিকে ধনিকশ্রেণি কর্তৃক নিন্মবিত্তের মানুষের উপর চাপিয়ে দেয়া গঞ্জনা, হীনতা চাটুকারিতাসহ আমাদের সমাজের সংকীর্ণ চিত্র।
গল্পতো মানুষ ও সমাজ জীবনের দর্পণতল। আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনার যুক্তিযুক্ত রসালো প্রতিরূপ। যা একজন ভাষাশিল্পীর কলমে হয়ে উঠে পানযোগ্য সুরা বা পাঠযোগ্য মীমাংসাদর্শন। রায়হানা হাসিব তাঁর মেধা ও প্রজ্ঞার বলে অতন্ত্য প্রাঞ্জলভাবে গল্পের চরিত্র, সংলাপ ও পরিবেশকে ফুটিয়ে তুলেছেন এবং সেই দর্পনের মুখোমুখি করেছেন তাঁর প্রিয় পাঠককে। সাতটি গল্পের প্রতিটিতে জীবনবোধ এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন লেখক।
সময় যত এগিয়ে যাচ্ছে মানুষের জ্ঞান তত উৎকর্ষ লাভ করছে। জীবন ও জগৎ সম্পর্কে জ্ঞানের পরিধি ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু একই সাথে মানুষ নিয়ত আক্রান্ত হচ্ছে মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় নামক ক্যান্সারে। যা থেকে উত্তরণের সম্ভাবনা ক্ষীণ থেকে ক্ষীয়মান। সেক্ষেত্রে নিয়ত পাল্টে যাচ্ছে জীবনের গতি। জীবন হয়ে উঠছে দুর্বিষহ। কাজেই প্রতিটি মানুষের এ–বিষয়গুলো সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন, প্রয়োজন শুধু জানার জন্যই নয়, জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্যও। রায়হানা হাসিবের গল্পগুলো কিছুটা হলেও পাঠককে উৎসাহিত করবে মানবিক মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতন হতে।
‘আপনার নাম কি টিনা’ ও ‘দিবস বিড়ম্বনা’ এই গল্প দুটি রায়হানা হাসিবের নিটোল প্রেমের চমৎকার গল্প। বেশ কিছু প্রেমপত্র সংযোজিত হয়েছে প্রথম গল্পটিতে, সাথে কবিতাও। পত্রগুলো পাঠে পাঠক আপ্লুত হবেন। কৈশোর ছেড়ে যৌবনে অবতীর্ণ হওয়া পাঠকের গল্প দুটি ভালো লাগাবে। যারা প্রেমের গল্প পছন্দ করেন তাঁরা গল্প দুটি পড়ে উদ্বেলিত হবেন নিঃসন্দেহে।
‘অপারেশন সার্চলাইট’ রায়হানা হাসিবের দ্বিতীয় গল্প। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ একটি ন্যক্কারজনক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়। বাংলার জনগণের স্বাধীনতা–স্বাধিকার আন্দোলনের গণজাগরণকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য পাকিস্তান সেনারা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সামরিক শাসকের নির্দেশে নিরস্ত্র, ঘুমন্ত বাঙালির উপর যে ঘৃণ্য, নৃশংস, বর্বরোচিত গণহত্যা চালিয়েছিল সেটাই অপারেশন সার্চলাইট নামে পরিচিত। রায়হানার এই গল্পটি সেই পটভূমির ওপর নির্মিতব্য। লেখিকার জন্মেরও আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রেক্ষিতে এমন একটি গল্পের অবতারণা লেখিকার প্রজ্ঞা ও সাহসিকতার পরিচয় রাখে বৈকি।
রায়হানা হাসিবের বাকি চারটা গল্পের মধ্যে ‘শেষ বিকেলের ক্লান্ত পাখিরা’ ‘অপত্য স্নেহ’ ‘মা যে আমার’ এবং ‘দ্বীপ জ্বেলে যায় যে জন’, শিরোনামের সব গল্পগুলো আমাদের নিত্যকার সমাজচিত্রের প্রতিফলিত রূপ। যেখানে রয়েছে এক শ্রেণির লোকের শৃঙ্খলা বা নিয়ম–শাসনহীন যথেচ্ছাচারিতা, অনিয়ন্ত্রিত জীবন, সম্পদ ও কুশিক্ষার আস্ফালন অপরদিকে নিম্ন আয়ের মানুষের কঠিন সংঘাতময় যাপিত জীবন। খুব সাবলীল এবং যথার্থ শব্দ চয়নে রচিত এই গল্পগুলো নানাদিক থেকে গুরুত্বপুর্ণ অর্থ বহন করে। এছাড়া ঘটনার ভিন্নতা, প্রাঞ্জল উপস্থাপনা শব্দের মোহজাল গল্পপাঠে পাঠককে ধরে রাখবে বলে মনে হয়েছে। কারণ আমি নিজেও গল্পে প্রবেশ করে শেষ হওয়া অব্দি বেরিয়ে আসতে পারিনি। একরকম গতিশীলতা গল্পের উৎকর্ষতা যেমন বাড়িয়ে দেয় তেমনি গল্প হয়ে উঠে পাঠকনন্দিত। তবে ‘শেষ বিকেলের ক্লান্ত পাখিরা’ এই গল্পে প্রায়শই খেই হারিয়ে যাওয়ার মতো নতুন অধ্যায় এসে সংযুক্ত হওয়ায় পাঠের মনোযোগ কিছুটা ছিন্ন হয়েছে ।
অনেক পূর্ণতার মাঝে কিছু শূন্যতা আছে কি? থাকতেই পারে আর এই অসম্পূর্ণতাগুলো বুঝতে পারলে এবং এগুলোকে বশে আনতে পারলে লেখক অচিরেই সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবেন। রায়হানা হাসিব অতন্ত্য তীক্ষ্ম ও দূরদর্শিতা সম্পন্ন নারী। তাই আশা করবো সাফল্য নিজেই এসে ধরা দিবে তার জীবনে।
নামকরণ নিয়ে কিছুটা খটকা বা প্রশ্ন জেগেছে আমার মনে গল্পগুলো পড়ার পর। সাতটি গল্পের কোনোটির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হয়নি বইটির নামকরণ। এক্ষেত্রে যদি ধরে নেই পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এই নাম নির্বাচন করেছেন লেখিকা রায়হানা হাসিব তাহলে হয়তো পুরোপুরি সঠিক হবে না। লেখকের ব্যক্তি চিন্তাধারার মধ্যে এর উত্তর নিশ্চয়ই থাকবে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে গল্পকে অহেতুক টেনে বাড়ানো, গল্পের যৎসামান্য প্রয়োজনে নতুন চরিত্র সংযোজন আমার কাছে বাহুল্য মনে হয়েছে। তবে এতে মূল গল্পের বৈশিষ্ট্যে কোনোরূপ নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি।
গল্প–উপন্যাস আমরা অনেকেই লিখছি–পড়ছি প্রতিনিয়ত, কিন্তু গভীরে ঢুকছি কতটুকু। একজন সুচারু শিল্পী হতে হলে হাতুড়ি বাটালির যেমন যত্ন নিতে হয়, শান দিতে হয় প্রতিদিন তেমনি একজন সত্যিকার সাহিত্যপ্রেমী রচয়িতা হতে হলে নিজেকেও নিয়মিত শান দিয়ে তৈরি করে নিতে হয়। যাঁরা সাহিত্যকে মনেপ্রাণে ধারণ করেন নিশ্বাসে–বিশ্বাসে আটকে রেখেছেন বাংলাদেশের শিল্পসংস্কৃতি ও সাহিত্যকে, যাঁদের ভাবনায় এবং গবেষণায় প্রতিনিয়ত সমৃদ্ধ হচ্ছে বাংলাসাহিত্য তাঁদের সাহিত্যসৃষ্টিগুলো আমাদের জানতে হবে, আত্মস্থ করতে হবে এবং ধারণ করতে হবে মনেপ্রাণে।
মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আমরা আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছি নাতো! আমরা ভুলে যাই আমাদের নিজস্বতা। ভুলে যাই আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি আছে আর সেই সংস্কৃতিতে অবগাহন করে বেড়ে উঠেছে আমাদের জীবন।
রায়হানা হাসিব প্রজ্ঞাবান স্থির চিত্তের উন্নত মানসিকতার মানবিক গুণাবলীর একজন শিক্ষক ও লেখক। তাঁর হাতে রচিত সাহিত্যকর্ম একদিন কুসংস্কারের দুঃস্বপ্ন পেরিয়ে আলোর দুয়ার খুলবে সেই প্রত্যাশা করি।